‘নন-লাইফ’ পলিসির ক্ষেত্রে পুনঃবীমার পরিধি বাড়ছে
বীমা দাবি পরিশোধের ক্ষেত্রে একক বীমা প্রতিষ্ঠানের ঝুঁকি কমাতে তৃতীয় কোনো বীমা প্রতিষ্ঠানে পুনঃবীমার সংখ্যা বাড়ছে।
বর্তমানে দেশের বেসরকারি খাতের বীমা কোম্পানিগুলোর বীমা পলিসির বিপরীতে পুনঃবীমা গ্রহণকারী একমাত্র রাষ্ট্রায়াত্ত্ব প্রতিষ্ঠান হল সাধারণ বীমা কর্পোরেশন (এসবিসি)।
প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে এখন 'নন-লাইফ' (জীবন বীমা ছাড়া অন্যান্য বীমা বা সাধারণ বীমা) বীমা খাতে বড় বড় অংকের বীমা পলিসি আসছে, যার দায় এককভাবে দেশিয় কোনো বীমা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে পরিশোধ করা সম্ভব নয়।
ফলে বিদেশি বীমাকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে পুনঃবীমা করতে হচ্ছে; বিগত কয়েক বছর ধরে এমন পুনঃবীমার পরিধি বাড়ছে বলে জানান কর্মকর্তারা।
পুনঃবীমা পলিসির কারণে দুই বীমাকারী প্রতিষ্ঠানই উপকৃত হয়। পুনঃবীমাকারী প্রতিষ্ঠান বিদেশি বীমা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বীমা করায় কমিশন পায়, আবার বিদেশি বীমাকারী প্রতিষ্ঠানও প্রিমিয়াম ও কমিশন পায়; ফলে লাভবান হয় উভয়েই। আবার পুনঃবীমার কারণে বীমা দাবির অর্থও বিদেশি প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া যায়।
উদাহরণস্বরূপ, 'ক' একটি বীমা কোম্পানি, যে 'এক্স' প্রতিষ্ঠানের পলিসি গ্রহণ করল। বীমার ঝুঁকি একার পক্ষে বহন করা সম্ভব নয় বলে, সে 'খ' বীমা কোম্পানির কাছেও বীমা করল।
প্রথমে 'এক্স' প্রতিষ্ঠানের প্রিমিয়াম নিয়ে 'ক' বীমা প্রতিষ্ঠান 'খ' বীমা প্রতিষ্ঠানে ঝুঁকি কাভারেজের অনুপাতে প্রিমিয়াম জমা দেবে। দায় পরিশোধের সময় উভয় কোম্পানি মিলে 'এক্স' প্রতিষ্ঠানের বীমা দাবি পরিশোধ করবে।
এর মাধ্যমে উভয়ই প্রতিষ্ঠানই লাভবান হবে। সম্প্রতি এই ব্যবস্থার উদহারণ হতে যাচ্ছে- বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের মালিকানাধীন জাহাজ 'বাংলার সমৃদ্ধি'।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে গত বছরের মার্চে ইউক্রেনের আলভিয়া বন্দরে নোঙর করা অবস্থায় রকেট হামলার শিকার হয় এই জাহাজ।
জাহাজটির বীমা ছিল সাধারণ বীমা কর্পোরেশনে। পরবর্তীতে, লন্ডনভিত্তিক বিশ্বের বৃহত্তম বীমা সংস্থা লয়েডস সিন্ডিকেটের সদস্য টাইজার্সের কাছে জাহাজটির পুনঃবীমা করা হয়।
সাধারণত বেসরকারি বীমা কোম্পানির ঝুঁকি কমাতে পুনঃবীমা পলিসি গ্রহণ করে সাধারণ বীমা কর্পোরেশন। তবে এখন নিজস্ব বীমা নীতির বাইরে গিয়ে একক প্রতিষ্ঠানের ঝুঁকি কমাতে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে পুনঃবীমা করছে এই প্রতিষ্ঠান।
দেশের সরকারি এবং বেসরকারি উভয় বীমা কোম্পানিই একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ প্রিমিয়াম জমার বিপরীতে লাইফ এবং নন-লাইফ বীমা পলিসির বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকি বহন করে থাকে।
ফলে বীমার বিপরীতে যখন ক্ষতি বা বীমা পরিশোধের বিষয় আসে, তখন উভয় বীমা প্রতিষ্ঠান আনুপাতিক হারে ঝুঁকি বহন করে, এতে করে কোনো একক প্রতিষ্ঠানের ওপর বীমা দাবির চাপ পড়ে না।
বিদেশি প্রতিষ্ঠানে পুনঃবীমা থাকায় বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের মালিকানাধীন জাহাজ 'বাংলার সমৃদ্ধির' জন্য প্রায় পুরো বীমা দাবিই বিদেশ থেকে পাচ্ছে বাংলাদেশ। যদিও এই বীমার বিপরীতে প্রিমিয়াম পরিশোধ করতে হয়েছে।
ইউক্রেনের বন্দরে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা বাংলার সমৃদ্ধির জন্য বীমা দাবি পরিশোধ হিসাবে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিএসসি ফেব্রুয়ারির শেষ নাগাদ ২২.৪৮ মিলিয়ন ডলার পেতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।
সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ বেলাল হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমরা কয়েক মাস ধরে টাইজার্সের সঙ্গে বীমা দাবি নিয়ে আলোচনা করছি। পুনঃবীমাকারী প্রতিষ্ঠানটি অবশেষে চলতি মাসের মধ্যেই বৈদেশিক মুদ্রায় দাবি পরিশোধের নিশ্চিয়তা দিয়েছে।"
প্রতিষ্ঠানটির পুনঃবীমা বিভাগের এক কর্মকর্তা টিবিএসকে জানান, "দেশিয় বীমা প্রতিষ্ঠানের বীমা গ্রহণ করার পর বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ঝুঁকি বণ্টন করতে পুনঃবীমা করা হয়।"
তিনি বলেন, "অগ্নি বীমার ক্ষেত্রে বীমা অংশ ৪০০ কোটি টাকার বেশি ও মেরিন বীমার ক্ষেত্রে ১০০ কোটি টাকার বেশি হলে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে পুনঃবীমা করতে হয়। ক্ষয়-ক্ষতির দায়ের পরিমাণের ওপর প্রিমিয়াম নির্ভর করে।"
বীমা খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নন-লাইফ অগ্নি, মেরিন বা যানবাহন বীমার ক্ষেত্রে একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান সাধারণ বীমা কর্পোরেশন পুনঃবীমা গ্রহণ করে।
সাধারণ বীমা কর্পোরেশন নিজে নন-লাইফ বীমা গ্রহণ করার পর, আবার তৃতীয় কোনো বীমা কোম্পানির কাছে পুনঃবীমা করে।
দেশের মধ্যে নন-লাইফ বীমার ক্ষেত্রে পুনঃবীমার সুযোগ থাকলেও লাইফ বা জীবন বীমার ক্ষেত্রে তেমন কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেনি, ফলে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে জীবন বীমার পুনঃবীমা করছে দেশিয় বেসরকারি বীমা কোম্পানি।
বীমা কর্পোরেশন আইন অনুযায়ী, পুনঃবীমার বিষয়ে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে নিবন্ধিত ও বীমা ব্যবসারত প্রত্যেক বীমাকারী তার নিজস্ব ধারণক্ষমতার অতিরিক্তপুনঃবীমা অংশের পুনঃবীমা করবে। নন-লাইফ বীমার ক্ষেত্রে পুনঃবীমাযোগ্য অংশের ৫০ শতাংশ সাধারণ বীমায় করতে হবে।
তবে জীবন বীমার ক্ষেত্রে পুনঃবীমাযোগ্য অংশের সম্পুর্ণ বা যেকোনো অংশ বাংলাদেশের ভিতরে বা বইরে অবস্থিত বীমাকারীর নিকট করতে হবে।
এতে 'বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে চলে যাচ্ছে' আখ্যা দিয়ে জীবন বীমা কর্পোরেশন বেসরকারি বীমা কোম্পানির ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত ৫০ শতাংশ পুনঃবীমা করার সুযোগ চেয়ে গত বছর অর্থ অর্থমন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছিল রাষ্ট্রায়াত্ত্ব প্রতিষ্ঠানটি। তবে সে বিষয়ে এখনো কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি।