লেভেল ক্রসিং দুর্ঘটনা এড়াতে সড়কই বন্ধ করে দিচ্ছে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল
বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ৪০০ কিলোমিটার রেলপথে ৫৩২টি লেভেল ক্রসিংয়ের ৩২০টিই অননুমোদিত। এসব লেভেল ক্রসিংয়ে প্রতিনিয়ত ঘটে দুর্ঘটনা। হতাহতের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় রেলের ইঞ্জিন।
গত বছরের ২৯ জুলাই তেমনই এক দুর্ঘটনা ঘটে চট্টগ্রাম জেলার মিরসরাই উপজেলার খইয়াছড়া এলাকার লেভেল ক্রসিংয়ে। আন্তঃনগর একটি ট্রেনের সাথে পর্যটকবাহী মাইক্রোবাসের সংঘর্ষে প্রাণ হারায় ১৪ জন।
যদিও দুর্ঘটনাটি ঘটেছিলো একটি অনুমোদিত লেভেল ক্রসিংয়ের গেটম্যানের অবহেলায়, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ দুর্ঘটনা রোধ করতে এখন সবকটি অননুমোদিত লেভেল ক্রসিংয়ের উপর দিয়ে যান চলাচল বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে।
এরই অংশ হিসেবে বিকল্প কোন ব্যবস্থা না করেই ইতোমধ্যে ৩৭টি লেভেল ক্রসিংয়ের দুই পাশে লোহার পাত পুঁতে সড়কগুলোতে যান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। এতে অনেকটা অবরুদ্ধ হয়ে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে ওইসব এলাকার বাসিন্দাদের।
পাশাপাশি বিকল্প পথে পণ্য পরিবহন করতে গিয়ে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন ওইসব এলাকার শিল্পমালিক, ব্যবসায়ী ও কৃষকরা।
তেমনই এক এলাকা চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুণ্ড পৌরসভার মৌলভীপাড়া গ্রাম, যেখানে প্রায় ৫ হাজার মানুষের বসবাস। ১০-১৫ ফুট প্রশস্ত একটি পাকা সড়ক ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাথে যুক্ত করেছে গ্রামটিকে। মহাসড়ক থেকে গ্রাম্য সড়কটি ধরে কিছুদূর এগোলেই ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইন। সেখানে আছে একটি অননুমোদিত লেভেল ক্রসিং।
দুর্ঘটনার ঝুঁকি এড়াতে ক্রসিংয়ের দুই পাশে মাত্র ২ ফুট জায়গা খালি রেখে ১৬টি করে লোহার পাত পুঁতে সম্প্রতি সড়কটিতে যান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল কর্তৃপক্ষ। এতে অনেকটা অবরুদ্ধ হয়ে বিপাকে পড়েছেন ওই এলাকার বাসিন্দারা। ওইসব এলাকায় পণ্য ও যান পরিবহন ব্যাহত থাকায় চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে বাসিন্দাদের।
এলাকার শতবর্ষী বাসিন্দা আবদুল গনি টিবিএসকে বলেন, 'ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি সরকারি এই সড়ক দিয়ে গাড়ি নিয়ে মানুষ চলাচল করছে। রেলওয়ের কোন গেটম্যান না থাকলেও এখানে কখনো কোন দুর্ঘটনা ঘটেনি। হঠাৎ এই সড়কটি বন্ধ করে দেয়ায় আমরা বেকায়দায় পড়ে গিয়েছি।'
তিনি বলেন, 'এ এলাকায় কোন বাড়িতে আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি যাবে সে উপায়ও নেই। এালাকায় কেউ অসুস্থ হলে অ্যাম্বুল্যান্সে করে হাসপাতালে নেয়ার রাস্তাও রাখেনি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।'
মোশাররফ হোসেন নামে ওই এলাকার এক যুবক বলেন, 'আমরা ইউএনও, ডিসি ও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বরাবর স্মারকলিপি দিয়ে সড়কটি খুলে দেয়ার দাবি জানিয়েছি। তবে, এতে কোন সুরাহা হয়নি। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ আমাদের কোন কথাই শুনতে রাজি না।'
আব্দুস সালাম নামের স্থানীয় এক মুদি দোকানি বলেন, 'আগে পিকআপে বা ট্রাকে করে পণ্য সরাসরি দোকানে নিয়ে যেতে পারতাম। সড়কটি বন্ধ করে দেওয়ায় ছোট রিকশা ভ্যানে করে নিয়ে যেতে হচ্ছে। এতে পণ্য পরিবহন খরচ বেড়ে গেছে এক থেকে দেড়গুণ। এলকায় ৩০টির মত দোকান আছে। সবাই এখন বেশ বেকায়দায় আছে।'
মৌলভীপাড়া থেকে ২ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত অরেকটি গ্রামের নাম দক্ষিণ মহাদেবপুর। সে গ্রামে রয়েছে হাজারখানেক মানুষের বাস, কয়েকটি কৃষি খামার, কয়েকশ একর কৃষি জমি ও দু'টি শিল্প কারখানা। গ্রামটিকে মহাসড়কের সাথে যুক্ত করা একমাত্র রাস্তা সিরাজ ভুঁইয়ার খামারবাড়ি সড়কটিও পিলার পুঁতে বন্ধ করে দিয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
ওই এলাকার খামারি নজমুন মঞ্জু টিবিএসকে বলেন, গ্রামের হাজার খানেক মানুষ চলাচল করার পাশাপাশি এই সড়ক দিয়ে পরিবহন করা হতো নানা কৃষি ও শিল্প পণ্য। সড়কটি বন্ধ করে দেয়ায় এ এলাকায় উৎপাদিত কৃষি ও শিল্পপণ্য বাজারে নিয়ে যাওয়া নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।
তিনি বলেন, 'আমাদের খামারে ১০ হাজার ব্রয়লার ও লেয়ার মুরগির শেড আছে। আগে পিকআপে করে সরাসরি মুরগি, ডিম ও পোল্ট্রি ফিড পরিবহন করতে পারতাম। বর্তমানে একবার রিক্সাভ্যানে করে ডিম-মুরগী রেললাইন পর্যন্ত এনে তারপর পিকআপে লোড করতে হচ্ছে। পরিবহন খরচ দ্বিগুণ বেড়ে যাওয়ায় লোকসান গুনতে হচ্ছে।'
'সড়কটি খুলে না দিলে খামারটি বন্ধ করে দেয়া ছাড়া কোন উপায় থাকবে না', তিনি আক্ষেপ করে বলেন।
ওই এলাকায় অবস্থিত এলবিয়ন ল্যাবরেটরিজের চেয়ারম্যান রাইসুল উদ্দিন সৈকত বলেন, 'এভাবে কোন ধরনের নোটিশ ছাড়া সড়ক বন্ধ করে দেয়ায় রেললাইনের পূর্বপাশে থাকা সব শিল্প প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমাদের কারখানায় যাওয়ার সড়কটি বন্ধ করে দেয়ায় পণ্য পরিবহন নিয়ে আমরা দুশ্চিন্তায় আছি। আমাদের কারখানাটি রপ্তানিনির্ভর হওয়ায় এ প্রতিবন্ধকতা বিদেশি ক্রেতাদের ভুল বার্তা দিবে।'
তিনি বলেন, সড়কটি বন্ধ করে দেয়ায় আমদানি ও রপ্তানি পণ্য পরিবহনে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ খরচ বেড়ে গেছে, যা সরাসরি পণ্যের দামের উপর প্রভাব ফেলছে।
বিকল্প সড়ক নির্মাণ করার সময় দিয়ে লেভেল ক্রসিংগুলো বন্ধ করলে সবার জন্য ভালো হতো বলে মনে করছেন এই শিল্প উদ্যোক্তা।
বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় প্রকৌশলী আব্দুল হানিফের দেয়া তথ্য মতে, এ অঞ্চলের ৬টি জেলা, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, ফেনী ও চট্টগ্রামের ওপর দিয়ে যাওয়া রেললাইনে ২০৩টি অনুমোদিত ও ৩২০টি অননুমোদিত লেভেল ক্রসিং রয়েছে। কোন গেটম্যান না থাকায় অননুমোদিত লেভেল ক্রসিংগুলোতে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। এতে জানমালের ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় রেলের ইঞ্জিনও। তাই দুর্ঘটনা এড়াতে অননুমোদিত লেভেল ক্রসিংয়ের ওপর দিয়ে যান চলাচল বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয় রেলপথ মন্ত্রণালয়।
তিনি বলেন, 'মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে যেসব এলাকায় জনবসতি কম সেসব এলাকার লেভেল ক্রসিংগুলোতে যান চলাচল বন্ধ করতেই রেললাইনের দু'পাশে ২ ফুট দূরত্বে পিলার পোঁতা হচ্ছে। শুধু চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডই নয়, পর্যায়ক্রমে সবগুলো অননুমোদিত লেভেল ক্রসিংয়ে যান চলাচল বন্ধের কাজ চলমান রয়েছে।'
তবে অননুমোদিত লেভেল ক্রসিংগুলোতে দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত হওয়ার কোন পরিসংখ্যান তিনি টিবিএসকে সরবরাহ করতে পারেননি।
তিনি বলেন, ট্রেন লাইনচ্যুত না হলে দুর্ঘটনার হিসাব রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ রাখে না।
এ বিষয়ে জানতে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় রেলওয়ে ম্যানেজার (ডিআরএম) আবিদুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি টিবিএসকে বলেন, 'বাংলাদেশ রেলওয়ের পক্ষে সবগুলো লেভেল ক্রসিংয়ে গেটম্যান দেয়ার মত জনবল নেই। তার ওপর প্রতিটি লেভেল ক্রসিংয়ে পাহারা দেয়া বেশ ব্যয়বহুল যার ব্যয় বহন করার মত অবস্থাও রেলওয়ের নেই। তাই দুর্ঘটনা এড়াতে অগুরুত্বপূর্ণ ও অননুমোদিত রেল ক্রসিংগুলো বন্ধ করা হচ্ছে।'
বিকল্প কোন ব্যবস্থা না করেই লেভেল ক্রসিংগুলো বন্ধ করায় সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দাদের ভোগান্তির বিষয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, 'আপাতত ভোগান্তি হলেও জানমালের ক্ষয়ক্ষতি রোধ করাই আমাদের লক্ষ্য। ভবিষ্যতে রেললাইনের সমান্তরালে সড়ক নির্মাণ করে অনুমোদিত লেভেল ক্রসিংয়ের সাথে সংযুক্ত করার পরিকল্পনা আছে রেলওয়ের।'
শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য লেভেল ক্রসিংয়ের অনুমোদনের বিষয়ে আবিদুর রহমান বলেন, লেভেল ক্রসিংয়ের অনুমোদনের জন্য কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট পরিমাণ ফি জমা দিয়ে আবেদন করলে মন্ত্রণালয় তা বিবেচনা করে অনুমোদন দিয়ে থাকে। অনুমোদন পাওয়া গেলে সেখানে গেট নির্মাণ করে জনবল নিয়োগ দেয়া হয়।
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক ও মানবাধিকার কর্মী এডভোকেট জিয়া হাবিব আহসান বলেন, 'কোন সরকারি জায়গার উপর দিয়ে ৬০ বছর ও ব্যক্তি মালিকানাধীন জায়গার উপর দিয়ে ২০ বছর সাধারণ মানুষ চলাফেরা করলে তার ওপর পথাধিকার তৈরি হয়। বাংলাদেশের আইন কাউকে ওই পথ বন্ধ করার অধিকার দেয় না।'
তিনি বলেন, 'দুর্ঘটনা রোধে লেভেল ক্রসিংয়ের উপর দিয়ে যান চলাচল বন্ধের এমন সিদ্ধান্তকে মাথা ব্যথার সমাধান করতে মাথাই কেটে ফেলার মতো। বিকল্প ব্যবস্থা না করেই এভাবে হঠাৎ করে সড়ক বন্ধ করে দেয়া শুধু মানবাধিকার লঙ্ঘনই নয়, বেআইনিও বটে।'
তিনি অবিলম্বে বন্ধ করে দেয়া সড়ক খুলে দেয়ার আহবান জানান।