জীবন ধারণের জন্য প্রকৃত ন্যায্য মজুরি এখনও অলীক স্বপ্ন
আন্তর্জাতিক অধিকার সংস্থাগুলো অনেকদিন ধরেই নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও ন্যায্য মজুরির দাবি জানিয়ে আসছে। বাংলাদেশে — যেখানে প্রধান শিল্পগুলোতে অনেক বছর ধরে ন্যূনতম মজুরির সমন্বয় হচ্ছে না — জীবনধারণের জন্য ন্যায্য মজুরি এখনও অলীক স্বপ্নই রয়ে গেছে।
বেসরকারি শিল্পের জন্য সরকারি সংস্থা কর্তৃক নির্ধারিত ন্যূনতম মাসিক মজুরি সেই ২০১৮ সাল থেকে আট হাজার টাকাতেই (৮০ ডলারের কম) আটকে আছে। ওই বছর দেশের বৃহত্তম উৎপাদন খাতে — তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইল — কর্মীদের জন্য এই ন্যূনতম মজুরি সংশোধিত হয়েছিল।
শ্রমিকদের ওপর দ্বৈত আঘাত
এরপর গত কয়েক বছরে অনেক কিছুই বদলে গেছে। দুনিয়াজুড়েই নিম্ন আয়ের মানুষ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় দুটি ধাক্কা খেয়েছে — প্রথমে করোনা মহামারিজনিত লকডাউন, তারপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ।
করোনার হানায় লাখ লাখ কর্মী চাকরি হারান। সেই ধাক্কা যখন তারা সামলে উঠছিলেন, তখনই এল দ্বিতীয় ধাক্কা। যুদ্ধের কারণে শুরু হলো অর্থনৈতিক গতিমন্থরতা। শুরু হলো কর্মী ছাঁটাই, কিংবা বেতন কমানো। আর সেইসঙ্গে বিশ্বজুড়ে শুরু হলো লাগামহীন মূল্যস্ফীতির ঢেউ। ধনী, দরিদ্র — কেউ রেহাই পেল না সে ধাক্কা থেকে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বলছে, চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক গতিমন্থরতায় আরও বেশিসংখ্যক কর্মী নিম্ন মানের, কম মজুরির চাকরিতে ঢুকতে বাধ্য হতে পারেন। এসব কাজে থাকবে না চাকরির নিরাপত্তা। ফলে করোনা সংকটের জেরে যে বৈষম্য বেড়েছিল, তা আরও বাড়বে।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে প্রকাশিত আইএলওর ওয়ার্ল্ড এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল আউটলুক: ট্রেন্ডস ২০২৩-তে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে, ২০২৩ সালে বৈশ্বিক কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি হবে মাত্র ১ শতাংশ। যা ২০২২ সালের অর্ধেকেরও কম। যুদ্ধ, মূল্যস্ফীতি ও ডলার সংকটের ধাক্কা আসার আগে ২০২২-এ শক্তিশালী প্রবৃদ্ধি হচ্ছিল, মানুষও চাকরি ফিরে পাচ্ছিল।
আইএলওর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেকারত্বের পাশাপাশি 'চাকরির মান নিয়েও বড় উদ্বেগ রয়েছে'। এতে আরও বলা হয়েছে, 'সামাজিক ন্যায়বিচারের মৌলিক ভিত্তি হলো ভালো চাকরি'। দারিদ্র্য কমানোর এক দশকের সাফল্য হোঁচট খেয়েছে করোনা সংকটের সময়।
নিরুপায় শ্রমিকরা
বর্তমান অর্থনৈতিক গতিমন্থরতার অর্থ হলো বহু কর্মীকে নিম্ন মানের চাকরি গ্রহণ করতে হবে। অধিকাংশ চাকরিতেই বেতন হবে খুব কম। তাছাড়া গড় মজুরি বৃদ্ধির গতির চেয়ে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির গতি অনেক বেশি। তাই জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় আরও বেশিসংখ্যক মানুষকে দারিদ্র্যের মধ্যে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি বেড়েছে। করোনা সংকটের সময় মানুষের আয় উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাওয়ার মধ্যেই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এটি বহু দেশে নিম্ন-আয়ের মানুষকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
দেশের ভেতরে-বাইরে দুই জায়গাতেই বৈষম্য বাড়ছে। এছাড়া মহামারি থেকে পুনরুদ্ধারেও ব্যাপক বৈষম্য দেখা গেছে। কম-দক্ষ অভিবাসী কর্মীদের চাইতে সর্বোচ্চ বেতন পাওয়া কর্মীদের চাকরিতে ফেরার সম্ভাবনা অনেক বেশি বলে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছিল।
এই প্রবণতার প্রতিফলন দেখা গেছে বাংলাদেশের সরকারি পরিসংখ্যানেও। সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশে গত ছয় বছরে দারিদ্র্য কমলেও বেড়েছে আয় বৈষম্য।
গত মাসে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত সর্বশেষ খানা আয়-ব্যয় জরিপের একটি ভালো খবর হচ্ছে, গত ছয় বছরে বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার কমে ১৮.৭ শতাংশে নেমে এসেছে। তবে এই পরিস্থিতির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে গিনি সহগে আয় বৈষম্যও বেড়েছে।
জরিপে দেখা গেছে, শহরের চেয়ে গ্রামে দারিদ্র্য বেশি। মানুষকে খাবারের চাইতে পণ্য ও অন্যান্য সেবার পেছনে বেশি ব্যয় করতে হয়। ২০২২ সালে ঋণ নেওয়া পরিবারের সংখ্যা শহরের চাইতে গ্রামে বেশি।
'মনখুশি করে দেওয়া তথ্য'
তবে আরেকটি সরকারি তথ্য নীতিনির্ধারকদের খুশি করতে পারে। মার্চে বিবিএস প্রকাশিত সর্বশেষ শ্রম শক্তি জরিপে উঠে এসেছে, নারী ও তরুণদের কর্মসংস্থান বাড়ার বদৌলতে ২০২২ সালে দেশে বেকারত্বের হার কমে ৩.৬ শতাংশে নেমে এসেছে।
গত পাঁচ বছরে দেশে বেকারের সংখ্যা কমেছে ৭০ হাজার। বর্তমানে দেশে মোট বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৩০ হাজার বলে উঠে এসেছে শ্রম শক্তি জরিপে।
বিবিএসের সংজ্ঞানুসারে, কেউ যদি সপ্তাহে এক ঘণ্টা মজুরির বিনিময়ে কাজ করার সুযোগ না পায়, তাহলে তাকে বেকার হিসেবে ধরা হয়।
জরিপ অনুসারে যেহেতু দেখা যাচ্ছে দেশের প্রতি ১০০ জন কর্মক্ষম মানুষের মধ্যে ৯৬ জনই কিছু না কিছু করছে, তাই এই সংখ্যাকে উৎসাহব্যঞ্জকই বলা যায়।
কিন্তু কাজের মান কেমন? কাজের মজুরিই বা কত?
স্থানীয় গবেষণা সংস্থা সানেমের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের কর্মীরা জীবন ধারণের জন্য ন্যূনতম যে পরিমাণ মজুরি প্রয়োজন, তার মাত্র অর্ধেক মজুরি পান।
জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় মজুরির পরিমাণ শহর বা জেলা কিংবা স্যাটেলাইট শহর ভেদে ভিন্ন ভিন্ন। ঢাকা ও এর আশপাশের শিল্প শহরগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় মজুরি ধরা হয়েছে ১৯ হাজার ২০০ টাকা থেকে ২২ হাজার ৯০০ টাকার। অথচ সানেমের চলতি বছরের জানুয়ারির এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ২০২২ সালে একজন শ্রমিকের গড় মজুরি ছিল নিয়মিত কাজের জন্য মাসিক ৯ হাজার ৯৮৪ টাকা।
এতে বলা হয়, মজুরির এই শূন্যস্থান পূরণের জন্যে শ্রমিকদের বেশি বেশি ওভারটাইম করতে হয়েছে।
মৌলিক কিন্তু ভদ্রস্থ জীবন ধারণের ব্যয়ের মধ্যে রয়েছে খাদ্য, বাসস্থান, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য এবং চারজনের পরিবারের জন্য যেকোনো জরুরি প্রয়োজন মেটানোর জন্য অল্প সঞ্চয়। সানেমের পাওয়া ফলাফলগুলো শ্রমিক অধিকার গ্রুপ গ্লোবাল লিভিং ওয়েজ কোয়ালিশনের একটি প্রতিবেদনের কাছাকাছি। তাদের হিসাব অনুযায়ী, জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় প্রকৃত মাসিক মজুরির পরিমাণ ২১ হাজার ৬৩৮ টাকা।
ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশে অধিকার গ্রুপ ইন্ডাস্ট্রিয়ালএএলএল-এর অঙ্গসংস্থাগুলো পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি আট হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৩ হাজার টাকা করার আহ্বান জানিয়েছিল, যাতে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির মধ্যে তাদের জীবিকা নির্বাহ একটু সহজ হয়।
বাংলাদেশের শ্রম আইন অনুযায়ী প্রতি পাঁচবছর পর পর মজুরি কাঠামো রিভিউ করতে হয়। কিন্তু পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের মজুরি সর্বশেষ ২০১৮ সালে রিভিউ করা হয়েছিল। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ৯ শতাংশে পৌঁছানো মূল্যস্ফীতির এ বাজারে পোশাক শ্রমিকদের পক্ষে পাঁচ বছর আগে ঠিক করা বেতনে ন্যূনতম ব্যয়েও জীবনযাপন করা সম্ভব নয় জানিয়ে তারা আর দেরি না করে মাসিক ন্যূনতম মজুরি রিভিউ করার জন্য একটি ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের দাবি করেছেন।
'ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি পোশাক শ্রমিকদেরকে শোচনীয় পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছে। পর্যাপ্ত সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ তাদের মজুরিও পাল্টাতে হবে,' বলেন ইন্ডাস্ট্রিয়ালএএলএল বাংলাদেশ কাউন্সিল-এর প্রেসিডেন্ট আমিরুল হক আমিন।
দেশের সর্বোচ্চ রপ্তানি আয়কারী ও উৎপাদন শ্রমিকদের নিয়োগের সবচেয়ে বড় খাতের দশা এটি।
অন্য শিল্প খাতের শ্রমিকেরা কেমন আছেন?
৪৪টি শিল্প খাতে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ ও নিয়মিত বিরতিতে তা রিভিউ করার কথা সরকারের। নিরাপত্তা সেবা, স মিল, প্রিন্টিং, রাবার ও বিড়িসহ কেবল অল্প কিছু খাতে গত দুই বছরে রিভিউ করা হয়েছে।
২০২৩ সালের সর্বশেষ রিভিউয়ে রাবার শিল্পের শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে ১২,৯১০ টাকা।
রিভিউ ছাড়াই পার কয়েক দশক
কিন্তু এগুলো আনুষ্ঠানিক শিল্প কর্মসংস্থানের একটি ছোট অংশ মাত্র। কয়েক দশক ধরেও মজুরি রিভিউ না হওয়ার নজিরও রয়েছে। যেমন ফাউন্ড্রি শিল্পে সর্বশেষ মজুরি রিভিউ করা হয়েছিল ১৯৮৩ সালে, মাসে ৫২১ টাকা হিসেবে।
শিল্পখাতে কর্মক্ষম জনবল কমে যাওয়া ও চাকরির পরিবর্তনশীল প্রবণতার মাধ্যমে মজুরি রিভিশনের ঘাটতি ব্যাখ্যা করা যায়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪০.৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২২ সালে ৪৫.৩৩ শতাংশে পৌঁছানোর মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি শ্রমশক্তি এখনো কৃষিখাতের সঙ্গেই যুক্ত রয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী শিল্পখাতে কাজ করা শ্রমিকের পরিমাণ ২০.৪ শতাংশ থেকে কমে ১৭.০২ শতাংশ এবং সেবা খাতে শ্রমশক্তি ৩৯ শতাংশ থেকে কমে ৩৭.৬৫ শতাংশ হয়েছে।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ এহছানে এলাহী উৎপাদনখাতে শ্রমশক্তি কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে দক্ষতার অভাবের কথা উল্লেখ করে বলেন, 'বর্তমানে শিল্পগুলো পর্যাপ্ত শ্রমিক, বিশেষ করে দক্ষ শ্রমিক পাচ্ছে না। বিজিএমইএ ও বিকেএমইএসহ অনেকেই এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।'
কিন্তু বছরের পর বছর ন্যূনতম মজুরি অপরিবর্তিত রেখে এবং শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর দাবিকে উপেক্ষা করে শিল্পখাতগুলো কি দক্ষ শ্রমশক্তির আশা করতে পারে?
তবে আনুষ্ঠানিক খাতের কর্মীদের তুলনায় আরও বেশি দুর্ভোগের শিকার অনানুষ্ঠানিক কর্মীদের নিজেদের স্বাধীনতা আছে। কৃষিশ্রমিক, রিকশাচালক, বাসাবাড়িতে সহায়তাকারী শ্রমিকগোষ্ঠী দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধির কথা বলে নিজেদের মজুরি বাড়াতে পারে।
নেই বেকার সুবিধা
কিন্তু এসব আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক শ্রমিকগোষ্ঠী যুক্তরাষ্ট্র বা তার মতো উন্নত দেশের শ্রমিকদের মতো সৌভাগ্যবান নয়। ওই সব দেশে কঠিন সময়ে শ্রমিকদেরকে বেকার সুবিধা দেওয়া হয়। মার্কিন শ্রমিকেরা এসব সুবিধা এত বেশি উপভোগ করেছেন যে তাদের অনেকেই দীর্ঘ সময় আর কাজে ফেরেননি। ফলে দেশটির পরিবহনসহ অনেক খাত কর্মীসংকটে পড়েছিল।
কিন্তু বাংলাদেশের শ্রমিকদের জন্য এ ধরনের কোনো সুবিধা নেই। এখানে কাজ না থাকলে পরিবারসহ না খেয়ে থাকতে হয়। তাই এখানে বাধ্য হয়ে যেকোনো মজুরিতে একাধিক কাজ করেন শ্রমিকেরা। এর ফলে বেকারত্বের তথ্যকে সুখবর মনে হয়, আর নীতিনির্ধারকদের মুখেও হাসি ফোটে — আমাদের বেকারত্ব কমে যাচ্ছে এবং আরও বেশি তরুণ ও নারীরা শ্রমশক্তির অংশ হচ্ছেন।