বড় কোম্পানির ত্রিমুখী চাপে লক্ষ্মীপুরে একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ছোট পোল্ট্রি খামার
বড় কোম্পানিগুলো কোন কারণ ছাড়াই মুরগির বাচ্চার দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি করছে, ফিডের দাম বাড়াচ্ছে এবং ছোট খামারে উৎপাদিত মুরগি বড় কোম্পানির নিয়মে বিক্রয় করতে বাধ্য করছে। বড় কোম্পানিগুলোর এরকম সংঘবদ্ধ ত্রিমুখী চাপে লোকসানে পড়ে ছোট খামারিরা ব্যবসা ছেড়ে দিচ্ছে। অনেক খামারি দেনায় পড়ে এখন বাড়ি থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
লক্ষ্মীপুর জেলার বিভিন্ন উপজেলায় গ্রামীণ পর্যায়ের স্থানীয় কয়েকজন পোল্ট্রি খামারি, ব্যবসায়ী এবং কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
এসময় খামারি ও ব্যবসায়ীরা জানান, কয়েকজন মাফিয়া ব্যবসায়ীদের দখলে চলে গেছে দেশের পোল্ট্রি শিল্প। যার প্রভাব পড়েছে লক্ষ্মীপুর জেলায়ও।
প্রান্তিক চাষীদের সাথে একমত পোষণ করে লক্ষ্মীপুর জেলা প্রাণীসম্পদ অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত এক বছরে জেলায় অন্তত তিনশোর অধিক নিবন্ধিত খামার বন্ধ হয়ে গেছে। এখনো গড়ে প্রতিদিনই খামার বন্ধ হচ্ছে।
মাঠ পর্যায়ে খামার বন্ধ হওয়ার চিত্র কেমন
কমলনগর উপজেলার তোরাবগঞ্জ ইউনিয়নের ৯ নং ওর্য়াডের পোল্ট্রি খামারি মোঃ মোস্তফা মিলন ২০০৬ সাল থেকে ব্রয়লার মুরগি পালন করে আসছিলেন। মুরগির খামার করেই সংসার চালান। তার তিন হাজার মুরগির খামারে এখন মাত্র ৫০০ মুরগি। বাকি পুরো খামার ফাঁকা। জিজ্ঞেস করতেই বললেন, 'জিম্মি হয়ে গেছি কয়েকটি কর্পোরেট কোম্পানির কাছে। যখন বাচ্চা নিতে যাই, তখন বাচ্চার দাম বেড়ে যায়, পোল্ট্রি ফিডের দাম বাড়িয়ে দেয়।'
জানালেন, শহর থেকে একেবারে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত সবখানে ছোট খামারিদের প্রতি হয় মুরগির বাচ্চা দিয়ে, না হয় খাদ্য দিয়ে চাপ তৈরি করছে বড় কোম্পানিগুলো। বাচ্চা কিনলে খাদ্য দেয়, বাচ্চা না কিনলে খাদ্য দেয় না। বাচ্চা আর খাদ্য কিনলেও কোম্পানির দেয়া দামেই বিক্রি করতে হবে মুরগি। নতুবা ছোট খামারিরা বাচ্চা পাবে না এবং খাদ্যও পাবে না। এ কারণে লোকসান ও ঝামেলায় পড়ে পোল্ট্রি খামার ছেড়ে দিচ্ছে অনেকে।
মিলন জানান, গত ২ বছর আগেও তার গ্রামে ১৬টি খামার ছিল। এখন আছে ২টি। আগামী বছর তিনিও বন্ধ করে দিবেন।
সদর উপজেলার আন্ধারমানিক গ্রামের জাহাঙ্গীর আলমের জোহান পোল্ট্রি খামারে ২৫ হাজার মুরগি ছিল। গত ৬ মাস আগে তিনি খামারটি বড় একটি কোম্পানীর নিকট ভাড়া দিয়ে ফেলেছেন। জাহাঙ্গীর জানায়, একই গ্রামের আশেপাশের আরো ১২টি খামার বন্ধ হয়েছে গত ৬ মাসের ব্যবধানে।
সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ ইউনিয়নের সুতার গোপ্টার এলাকার শরীফুল ইসলামের ফজর আলী পোল্ট্রি খামারে রয়েছে ২০ হাজার মুরগি। শরীফ জানায়, তার আশপাশের ১১টি খামার বন্ধ হয়ে গেছে গত ১ বছরে। যেগুলোর মধ্যে মিশু পোল্ট্রি খামার, জাকির পোল্ট্রি খামার, সিরাজ পোল্ট্রি, মুরাদ পোল্ট্রি খামারগুলো বড় ছিল।
কমলনগর উপজেলার বলিরপুল এলাকার মোঃ আলমগীর হোসেনের ৩টি খামার ছিল। গত এক বছরের মধ্যে লোকসানে পড়ে তার ২টি খামার বন্ধ হয়ে গেছে।
খামারিদের প্রত্যেকের বক্তব্য একই রকম- বড় কোম্পানিগুলোর অস্বাভাবিক বাচ্চার দাম, ফিডের দাম এবং কূটকৌশলে তারা সবাই অসহায় হয়ে খামার বন্ধ করে দিচ্ছেন। যার ধাক্কা লাগছে দেশের মুরগি বাজারে।
খামারি শরীফুল ইসলাম জানায়, করোনার সময় ২০২০ সালে ৫০ কেজির প্রতি বস্তা খাবারের দাম ছিল ১৫০০ টাকা। করোনার পর থেকে তা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে।
গত মাসের ১৮ তারিখে প্রতি বস্তা খাবার বিক্রি হচ্ছিল ৩৬০০-৩৭০০ টাকায়।
প্রতি কেজি মুরগি উৎপাদনে প্রান্তিক চাষীদের খরচ কত
খামারি মোস্তফা মিলন, জাহাঙ্গীর এবং শরীফ জানায়, খাবারের দাম বৃদ্ধি করা হয় ছোট খামারিদের জন্য। বড় কোম্পানিরা নিজেদের খামারে উৎপাদিত দরে খাদ্য পায়। সে কারণে তাদের উৎপাদন খরচ কম। তার দেয়া তথ্যমতে প্রতি ১ হাজার মুরগির জন্য ৩০-৩২দিনে ৫০ কেজি ওজনের ৪৫-৪৬ বস্তা খাদ্য লাগে। এসময় প্রতি মোরগের ওজন হয় ১৬০০-১৭০০ গ্রাম। তাদের দেয়া হিসেবে, প্রতি দেড় কেজি মুরগি উৎপাদনে ২.২৫ কেজি খাবার প্রয়োজন হয়। সে হিসেবে প্রতি কেজি মাংস উৎপাদনে দেড় কেজি খাবার ব্যবহৃত হয়। আর শুরুতেই ছোট খামারিদের জন্য একদিনের মুরগির বাচ্চার দাম এখন ৬০ টাকা।
প্রতি কেজি মুরগি উৎপাদনে কর্পোরেট চাষীদের খরচ কেমন
জোহান পোল্ট্রি কমপ্লেক্সের মালিক জাহাঙ্গীর আলম জানান, তিনি কিছু দিন খাদ্য তৈরি করেছিলেন। সয়াবিন আর ভুট্টার দাম যত তার সাথে প্রতি কেজি খাদ্যে ২-৩ টাকা বেশি খরচ যোগ হয়। আর তেমন খরচ নেই।
তার দেয়া তথ্যমতে, প্রতি কেজি খাদ্যে ২০-২৫ টাকা ছাড় পায় বড় কোম্পানিগুলো। কারণ তারা নিজেরাই খাদ্য উৎপাদন করে। একই সাথে তাদের হ্যাচারিতে উৎপাদিত নিজেদের বাচ্চার দাম পড়ে ১৫-২০ টাকা। একজন প্রান্তিক চাষীর জন্য তা ৬০-৬৫ টাকা। সে হিসেবে প্রতি কেজি মুরগির মাংস উৎপাদনে বড় কোম্পানির খরচ কমে ৭০ টাকা। বড় কোম্পানি প্রতি কেজি ১০ টাকা লাভে বিক্রি করলেও তাদের লাভ হয় কমপক্ষে ৮০ টাকা। কিন্ত প্রান্তিক খামারিদের লাভ মাত্র ১০ টাকাই। সে কারণে লাভের অংকেও ছোট খামারিরা বড় খামারিদের সাথে লড়াই করে টিকছে না।
কেউ কেউ ঝুঁকছেন কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ে
খামারি সাজেদা আক্তার সুমি জানান, অনেক ছোট খামারি প্রতিযোগিতায় না পেরে বর্তমানে বড় খামারিদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে শুধু ভাড়ায় মুরগী উৎপাদন করছে। যাকে বলা হয় কন্ট্রাক্ট ফার্মিং। এ পদ্ধতিতে কোম্পানিগুলো বাচ্চা, খাবার এবং ওষুধ সরবরাহ করে। এরপর সময়মতো কোম্পানিগুলোই সব মুরগি তাদের নিজস্ব স্টাইলে তৈরি করা বাজারে বিক্রি করিয়ে খামারিকে দেয় চুক্তিভিত্তিক কিছু লাভ।
সদর উপজেলার মিয়াবেড়ি এলাকার মুরগি ব্যবসায়ী আজিম জানায়, বাচ্চার দাম, খাবারের দাম বৃদ্ধির পরেও আরো কিছু কৌশল নেয় বড় কোম্পানি। তার মতে, 'যখন প্রান্তিক খামারিদের হাতে মুরগি থাকে, তখন করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো দাম কমিয়ে দেয়। যখন হাতে থাকে না, তখন দাম বাড়িয়ে দেয়। এতেও ছোট খামারিরা শেষ হয়ে যায়।'
প্রান্তিক চাষী শরিফুল ইসলাম জানান, চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত পাইকারি বাজারে তিনি ১৩৫ টাকায় মুরগি বিক্রি করেছিলেন। তাতেও তার সামান্য লাভ ছিল। ফেব্রুয়ারির শুরুতে এসএমএস আসলো দাম বাড়ানোর। ১১ ফেব্রুয়ারি বাজার হলো ১৬৫ টাকার, ১২ তারিখে ১৮১, ১৫ তারিখে ১৯২ এবং ১৭ ফেব্রুয়ারিতে ২০০ টাকা কেজিতে পাইকারি বিক্রি করেছিলেন তিনি। এভাবে বেশি মূল্যে বিক্রি করতে তাকে একপ্রকার বাধ্য করানো হয়।
মুরগির সেলস সেন্টার ব্যবসায়ী মোঃ আজিম হোসেন জানায়, ১১ ফেব্রুয়ারি থেকে প্রতিদিন দাম বেড়ে ৩ মার্চ তারিখে পাইকারি ২২৭, ৫ তারিখে ২৩৫ এবং ১ মাস পর ১১ মার্চ তারিখে দাম দাঁড়ালো পাইকারি ২৪১ টাকা। এর মাঝে দেশব্যাপী ব্যাপক সমালোচনার মাঝে ১৩ মার্চ থেকে সামান্য কমতে শুরু করে ২৭ মার্চ তারিখে হয় ১৬৬ টাকা। বর্তমানে পাইকারি দাম কেজি ১৯২ টাকা।
ওয়েবসাইট, ফেসবুক ও হোয়াটস অ্যাপে জমে সিন্ডিকেট
ব্যবসায়ী এবং প্রান্তিক খামারিরা জানায়, আগে প্রান্তিক খামারিরা উৎপাদন খরচ বাদে সামান্য লাভ ধরে মুরগি বিক্রি করতো। কিন্ত বর্তমানে প্রান্তিক চাষীদের বাজারও নিয়ন্ত্রণ হয় কেন্দ্রীয়ভাবে। তাতে কেন্দ্রীয়ভাবে প্রতিদিন যে দর উঠে তাতেই বিক্রি করতে হয়। কেন্দ্রীয় পুরো বাজারটি নিয়ন্ত্রণ করে বড় কোম্পানিগুলো।
প্রতিদিন বাজার কিভাবে নিয়ন্ত্রণ হয় তা জানতে চাইলে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আজিম হোসেন জানান, প্রতিদিন দুপুর ১২টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত ঢাকা এবং চট্টগ্রামে মুরগির বড় ব্যবসায়ী এবং দালালরা দাম নির্ধারণ করে সারাদেশের সকল ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ফেসবুক, হোয়াইটস অ্যাপ গ্রুপ এবং কৃষি বিষয়ক কয়েকটি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে জানিয়ে দেয়। পরের দিন বেলা ১২টা পর্যন্ত একই দর কার্যকর থাকে।
আজিমের ভাষ্যে, বড় ব্যবসায়ীরা এ ব্যবসাকে পুরোপুরি 'জুয়া'র আওতায় নিয়ে গেছে। agricare24.com নামের একটি ওয়েবসাইটে প্রতিদিনের বাচ্চা এবং মুরগির বাজারদর আপডেট দেয়ার তথ্য দেখা গেছে।
ছোট খামারি ও ছোট ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, বাচ্চার দাম, খাদ্যের দাম এবং শেষে মাংসের দাম, ডিমের দামের পাইকারি ও খুচরা বাজারে কারো কোন নিয়ন্ত্রণই নেই।
খামারি মিলন, হারুন, সুমি এবং আজীম জানান, বড় কোম্পানির হাত থেকে দেশের পোল্ট্রি শিল্প রক্ষা করতে হলে প্রতিটি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বাচ্চা উৎপাদনের সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে ছোট-বড় হ্যাচারি স্থাপন করতে হবে।
কৃষকদের মুরগির বাচ্চা উৎপাদনের যন্ত্রপাতি সরবরাহ করতে হবে। একই সময়ে ছোট পর্যায়ে খাদ্য উৎপাদন করার জন্য ছোট ব্যবসায়ীদের উৎসাহ দিতে হবে। এমন উদ্যোগ না নিতে পারলে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে কর্পোরেট কোম্পানিগুলো সবাইকে ৩০০ টাকা কেজিতে মাংস খেতে বাধ্য করবে।
মুরগির দামের কারণে সামাজিক জীবনে প্রভাব
মুরগির দাম বৃদ্ধির কারণে মানুষের খাদ্যাভ্যাস ও সামাজিক জীবনে নানা সমস্যা তৈরি হচ্ছে। কমলনগর উপজেলার মদিনাতুল উলুম এতিমখানার শিক্ষক মাওলানা মাকছুদের রহমান জানান, প্রতি বছর রমজানের সময় এতিম বাচ্চাদের দাওয়াত দিয়ে গ্রামবাসী খাওয়াতো। কিন্ত এ বছর ৩-৪ দিনের ব্যবধানেও একটি দাওয়াত হয়নি। মুরগির দাম বৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষ এবার রমজানের দাওয়াত করেনি বলে মনে করেন তিনি।
রাজধানী রেস্টুরেন্ট নামের এক রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী জানান, মুরগির দামবৃদ্ধির কারণে রেস্টুরেন্টে মুরগির মাংসের তৈরি খাদ্য অর্ধেক কমে গেছে।
লক্ষ্মীপুরে প্রান্তিক খামার কমে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে জেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ডা. যোবায়ের হোসেন জানান, লক্ষ্মীপুরে গত এক বছরে তিনশোর বেশি মুরগির খামার কমে বর্তমানে আছে ১২০০ খামার। বড় কোম্পানীদের চাপে পড়ে প্রান্তিক খামারিরা হারিয়ে যাচ্ছেন বলেও তিনি স্বীকার করেছেন।
এ সমস্যা সমাধানে স্থানীয় পর্যায়ে বাচ্চা উৎপাদন ও খাদ্য উৎপাদনের জন্য জাতীয়ভাবে ভাবনার কথা বলেছেন এ কর্মকর্তা।