সাত সড়কে ২৬ পশুর হাট বসাতে চায় চসিক, যানজট বৃদ্ধির শঙ্কা
চট্টগ্রাম নগরের বহদ্দারহাট থেকে বারিক বিল্ডিং মোড়ের দূরত্ব ৭ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার। শহর এলাকায় যানবাহনের স্বাভাবিক গতি (ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার) অনুযায়ী, এ পথ পাড়ি দিতে সর্বোচ্চ ১২ মিনিট লাগার কথা। কিন্তু বর্তমানে এ পথ যেতে ৪৫ মিনিটের বেশি সময় প্রয়োজন হচ্ছে। নগরের যানজটের এই যখন পরিস্থিতি, তখন নগরের প্রধান সাতটি সড়কের আশেপাশে ২৬টি পশুর হাট বসানোর প্রস্তাব করেছে সিটি কর্পোরেশন।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ ও নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, সিটি কর্পোরেশনের এই পরিকল্পনা শুধুই মুনাফানির্ভর; যা চট্টগ্রামের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাকে একেবারে ভেঙ্গে দেবে এবং সামাজিক অস্থিরতা তৈরী করবে।
গত ১১ মে সিটি করপোরেশনের রাজস্ব শাখা আসন্ন ঈদুল আজহায় তিনটি স্থায়ী পশুর হাটের সঙ্গে আরও ২৩টি অস্থায়ী পশুর হাট বসানোর অনুমতি চেয়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের কাছে চিঠি পাঠায়। যদিও ২০২২ সালে চসিকের ব্যবস্থাপনায় অস্থায়ী হাট বসেছিল মাত্র তিনটি। সে হিসেবে এবার গতবারের প্রায় আটগুণ অস্থায়ী পশুর হাট বসতে পারে নগরে।
জেলা প্রশাসনকে পাঠানো চিঠিতে অস্থায়ী পশুর হাটের সংখ্যা আটগুণ বৃদ্ধির কারণ হিসেবে 'স্থানীয় জনসাধারণ ও ওয়ার্ড কমিশনারদের' চাহিদার কথা বলা হয়েছে।
জানা গেছে, বর্তমানে নগরীতে তিনটি স্থায়ী পশুর হাট রয়েছে। এগুলো হচ্ছে সাগরিকা, বিবিরহাট ও পোস্তারপাড় বাজার। ২০২২ সালে ১০টি অস্থায়ী হাট বসানোর অনুমতি চেয়ে জেলা প্রশাসনে আবেদন করে চসিক। অনুমতি পাওয়ার পর চসিক চারটিতে ইজারাদার নিয়োগ দিলেও শেষ পর্যন্ত বাজার বসে তিনটিতে। এর আগে ২০২১ সালে স্থায়ীট-অস্থায়ী মিলে ছয়টি পশুর হাট বসেছিল চসিকের ব্যবস্থাপনায়। এর আগে ২০২০ সালে অস্থায়ী চারটিসহ মোট হাট বসেছিল সাতটি।
প্রতি বছর ১ থেকে ১০ জিলহজ্ব চসিকের ব্যবস্থাপনায় পবিত্র কোরবানির পশুর হাট বসে নগরে। চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী ২০ জুন থেকে ২৯ জুন পর্যন্ত এবার হাট বসতে পারে।
জেলা প্রশাসনকে চসিকের পাঠানো চিঠি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, চসিকের প্রস্তাবিত স্থায়ী ও অস্থায়ী হাটগুলোর প্রায় সবগুলোই নগরের প্রধান সাতটি সড়ক ঘিরে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আমদানি-রপ্তানি পন্য আনা-নেওয়ার কাজে ব্যবহৃত তিনটি সড়ককে ঘিরে ১২টি পশুর হাট বসানোর পরিকল্পনা করেছে চসিক।
সেগুলো হলো- ৪১নং দক্ষিণ পতেঙ্গা ওয়ার্ডের বাটারফ্লাই পার্কের দক্ষিণে টি কে গ্রুপের খালি মাঠ; ৪০নং উত্তর পতেঙ্গা ওয়ার্ডের খেঁজুরতলা বেড়িবাঁধ সংলগ্ন খালি মাঠ; স্টিল মিল বাজার; পূর্ব হোসেন আহম্মদ পাড়া সাইলো রোডের পাশে টিএসপি মাঠ; উত্তর পতেঙ্গা সিটি কর্পোরেশন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় মাঠ; মুসলিমাবাদ টি কে গ্রুপের খালি মাঠ এবং মুসলিমাবাদ রোডের সিআইপি জসিমের খালি মাঠ; ৩৬নং দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ডের আউটার রিং রোডস্থ সিডিএ বালুর মাঠ; ৩৮ নং ওয়ার্ডের সল্ডগোলা রেল ক্রসিং; ২৬ নং ওয়ার্ডের বড়পোল সংলগ্ন গোডাউনের গোডাউনের পরিত্যক্ত মাঠ; একই ওয়ার্ডের বারুনী ঘাটা ও ১ নম্বর দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ডের চৌধুরী হাট।
চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, '২০২২ সালে যেখানে মাত্র তিনটি অস্থায়ী পশুর হাট ছিলো, সেখানে ২৩টি অস্থায়ী হাট বসানোর চিন্তা অস্বাভাবিক। এটি হলে চট্টগ্রাম নগরে যান চলাচলে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসবে। এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দর ও শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আশপাশে যে ১২টি পশুর হাট বসানোর পরিকল্পনা, এটি দেশের আমদানি-রপ্তানিতে প্রভাব ফেলবে। তাই চট্টগ্রাম বন্দর ও ট্রাফিক বিভাগকে সিটি কর্পোরেশনের এই পরিকল্পনা নিয়ে জরুরীভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।'
চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক বলেন, 'আউটার রিং রোড, টোল রোড ও শেখ মুজিবুর রহমান সড়ক দিয়ে বন্দরের পণ্য আনা-নেওয়া করেন আমদানি ও রপ্তানিকারকরা। এক্ষেত্রে ট্রাফিক বিভাগের উচিত হবে বিষয়টি বিবেচনায় রেখে যেন হাট বসানোর অনুমতি দেওয়া হয়।'
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, 'স্থানীয় জনসাধারণ ও জনপ্রতিনিধিদের চাহিদার ভিত্তিতে কোরবানির পশুর চাহিদা মিটাতে অস্থায়ীভাবে পশু বাজার ইজারা প্রদানের জন্য সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এটি সিটি কর্পোরেশনের একটি আয়বর্ধক খাত।'
চসিকের রাজস্ব বিভাগের হিসেব অনুযায়ী, তিনটি অস্থায়ী পশুর হাট থেকে ২০২০ সালে ২ কোটি ৮৭ লাখ ২ হাজার ৪২০, ২০২১ সালে ২ কোটি ৫০ লাখ ৩৩ হাজার ৩৭৭ এবং ২০২২ সালে ৬ কোটি ৪৬ লাখ ৮০ হাজার টাকা রাজস্ব আয় করে।
সিটি কর্পোরেশনের এ সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে নগর পরিকল্পনাবিদ সুভাষ বড়ুয়া বলেন, 'সিটি কর্পোরেশন শুধু নিজেদের স্বার্থ চাইছে, জনগণের না। এই শহরের যিনি মেয়র তিনি একজন রাজনৈতিক নেতা, কাউন্সিলররাও তাই। মূলত দলীয় লোকজনকে সুবিধা দিতেই এত বিপুল পশুর হাটের বিষয়টি বলা হচ্ছে।'
এদিকে শহরের উত্তর-পূর্ব অংশে ৩ নম্বর পাঁচলাইশ ওয়ার্ডের ওয়াজেদিয়া মোড়; কয়লার ঘর ক্রিয়েটিভ স্কুলের সামনে, বকসু নগর মসজিদ সংলগ্ন মাঠ; মধ্যম শহীদ নগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠ; পশ্চিম শহীদ নগর কালু কোম্পানির বাড়ির পাশে; কামরাবাদ সামাদপুর মোড় এবং হাজী পাড়া বারেক শাহ মাজার সংলগ্ন মাঠ; ৫ নম্বর মোহরা ওয়ার্ডের জান আলী স্টেশন সংলগ্ন রেলওয়ের পরিত্যক্ত মাঠ এবং ১৭ নম্বর পশ্চিম বাকলিয়া ওয়ার্ডের বাকলিয়া এক্সেস রোডের পাশে খালি মাঠে পশুর হাট বসানোর পরিকল্পনা চসিকের।
ট্রাফিক উত্তরের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) জয়নুল আবেদীন বলেন, 'এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজের জন্য এমনিতেই নগরে যানজট কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। এর উপর শহরের মধ্যে এতগুলো পশুর হাট বসলে তা মানুষ চলাচলের উপযুক্ত থাকবে না।'
'আমার দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকায় বিবিরহাটসহ দুটি স্থায়ী পশুর হাট রয়েছে। এ অবস্থায় কোনোভাবেই অতিরিক্ত হাট বসানোর অনুমতি দেওয়া হবে না', বলেন জয়নুল আবেদীন।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান টিবিএসকে বলেন, 'আমরা এখনই এ নিয়ে মন্তব্য করতে চাই না, তবে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের সুপারিশের বাইরে কিছু হবে না।'