বছরের পর বছর কোনো নির্বাচন হয় না জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে
মেয়াদ শেষে নির্বাচন না হলে পুরোনোদের দায়িত্ব পালনের কথা বলা আছে অধ্যাদেশে। অভিযোগ রয়েছে, এ সুযোগ ব্যবহার করেই পর্ষদকে ব্যবহার করা হচ্ছে আধিপত্য বজায় রাখার স্বার্থে।
বলছি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। যেখানে অধ্যাদেশে গণতান্ত্রিক বিভিন্ন নির্বাচনের কথা বলা হলেও নির্বাচন দিতে গড়িমসি করা হয়, সময়মতো হয় না কোনো নির্বাচনই। যে কর্তৃপক্ষই বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করুক না কেন — সবারই এই সমস্যা রয়েছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকটি পর্ষদ রয়েছে। ১৯৭৩-এর অধ্যাদেশে অনুযায়ী, এসব পর্ষদের একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু কোনো পর্ষদেই সেটা মানা হচ্ছে না।
১৯টি পদের মধ্যে ৭টিই শূন্য, আরও ৭টি মেয়াদোত্তীর্ণ। পদাধিকারবলে তিন পদে রয়েছেন নিয়মিত সদস্য আর বাকি দুইজন সম্প্রতি চ্যান্সেলর কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত। নিয়মিত তিনজনের সঙ্গে মেয়াদোত্তীর্ণ সাতজন, নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত দুইজন — এই ১২ জনকে নিয়ে চলছে জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্ষদ; সিন্ডিকেট।
এদিকে নির্বাচিত কোনো ডিনেরই মেয়াদ নেই। অর্থ কমিটি এবং সিনেটের নির্বাচিত ও মনোনীত সদস্যদেরও সবার মেয়াদ শেষ হয়েছে। এসব পর্ষদে নির্বাচন দেওয়ার জন্য শিক্ষকদের মধ্য থেকে বিভিন্ন সময়ে দাবি উঠেছে। তবে বিগত প্রায় পাঁচ বছর যাবৎ সিনেট, সিন্ডিকেট, ডিন, ও অর্থ কমিটির জন্য নির্বাচন হয়নি। নির্বাচন হচ্ছে না জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদেরও (জাকসু)।
সিন্ডিকেট: সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্ষদ
২০১১ সালের পর থেকেই সিন্ডিকেটের কোনো না কোনো পদ ফাঁকা থেকেছে। তবে এটি প্রকট আকার ধারণ করে করোনাকালে। তখন কোরাম পূর্ণ (ছয়জন) না হওয়ায় সভা বিলম্বের মতো ঘটনাও ঘটেছে। বর্তমানে সিন্ডিকেটের সভাগুলো অনুষ্ঠিত হচ্ছে আট থেকে নয়জনকে নিয়ে — সেখানেই নেওয়া হচ্ছে নিয়োগ চূড়ান্ত করাসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ সব সিদ্ধান্ত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) পদে কেউ না থাকায় সিন্ডিকেটের এই পদটি খালি রয়েছে। '৭৩-এর অধ্যাদেশের ২২ (১)(ডি) ধারা অনুযায়ী, সিন্ডিকেটে অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল মনোনীত সরকারি কলেজের দু'জন অধ্যক্ষের মধ্যে একটি পদ খালি, আরেকটি মেয়াদোত্তীর্ণ। ডিন, প্রাধ্যক্ষ, অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক, ও প্রভাষক পদে একজন নির্বাচিত হয়ে সিন্ডিকেটের সদস্য হন। কিন্তু দীর্ঘদিন নির্বাচন না হওয়ায় শিক্ষকদের পদোন্নতি ও সংশ্লিষ্ট পদ হারানোর কারণে অধ্যাপক ক্যাটাগরি ছাড়া অন্য পাঁচটি পদ শূন্য হয়েছে।
২০১৬ সালের ৫ জুন বিশ্ববিদ্যালয়ে সবশেষ সিন্ডিকেট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে হিসেবে ২০১৮ সালের জুনে নির্বাচিত সব সদস্যের মেয়াদ শেষ হয়। তবে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, এবং কোষাধ্যক্ষের সঙ্গে বাকি আটজন মেয়াদোত্তীর্ণ সদস্য নিয়েই সিন্ডিকেট পরিচালিত হচ্ছে।
ডিন: নির্বাচন হয় না চার বছরের বেশি
বিশ্ববিদ্যালয়ে সবশেষ ডিন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৬ সালের ১০ মে। অধ্যাদেশের ২৫(৫) ধারা অনুযায়ী ডিনের মেয়াদ দুই বছর। সেই হিসেবে সকল ডিন মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছেন সাড়ে চার বছর আগেই। তবে নির্বাচিত ওই ডিনদের মধ্যে এখন মাত্র একজন দায়িত্ব পালন করছেন। বাকি পাঁচটিতেই ভারপ্রাপ্ত ডিনরা দায়িত্বে রয়েছেন।
সিনেট ও জাকসু
এদিকে অধ্যাদেশ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের সদস্য হবেন ৯৩ জন। এর মধ্যে গত আড়াই যুগ যাবৎ জাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন না হওয়ায় সিনেটে ছাত্র প্রতিনিধির পাঁচটি পদ খালি রয়েছে। বাকি ৮৮ জনের মধ্যে পাঁচজন হলেন সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। ২০১০ সালের পর সরকার থেকে এই ক্যাটাগরিতে নতুন করে কাউকে মনোনীত না করায় এই পদগুলো শূন্য রয়েছে। এ ছাড়া সিনেটে স্পিকার মনোনীত পাঁচজন সংসদ সদস্য, রাষ্ট্রপতি মনোনীত পাঁচজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সিন্ডিকেট মনোনীত পাঁচজন গবেষক এবং অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল থেকে পাঁচজন কলেজ অধ্যক্ষ রয়েছেন। তবে এদের মধ্যে শিক্ষাবিদদের মেয়াদ শেষ হয় ২০১৮ সালে। আর বাকি ২০ জনের মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৯ সালের জুলাইয়ের আগে।
সিনেটের বাকি ৬৩ সদস্যের মধ্যে ৫৮ জন নির্বাচিত হয়ে আসেন। এর মধ্যে ২৫ জন রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি এবং ৩৩ জন শিক্ষক প্রতিনিধি। ২০১৭ সালের ৩০ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বশেষ রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি নির্বাচন হয়। তিন বছর মেয়াদী এই সিনেট সদস্যদের মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর। আর শিক্ষক প্রতিনিধিদের নির্বাচন হয়েছে সবশেষ ২০১৫ সালের ১১ অক্টোবর। সে হিসেবে চার বছর আগে মেয়াদ শেষ হয়েছে তাদের। সিনেটের বাকি পাঁচজন সদস্য (পদাধিকারবলে) হলেন উপাচার্য, উপ-উপাচার্যদ্বয়, ট্রেজারার, এবং ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান।
তবে অধ্যাদেশের ১৯ (২) ধারা অনুযায়ী 'সিনেটরদের দায়িত্ব ততক্ষণ পর্যন্ত বহাল থাকবে, যতক্ষণ না তাদের উত্তরাধিকার নির্বাচিত, মনোনীত ও নিয়োগপ্রাপ্ত না হয়।' এই ধারাবলে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন মেয়াদোত্তীর্ণ ৮৩ জন সিনেটর।
অর্থ কমিটি
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন উপ-উপাচার্য থাকায় বর্তমানে অর্থ কমিটির সদস্য হওয়ার কথা নয়জন। তবে এর মধ্যে অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল মনোনীত একজন ডিন এবং সিনেটের একজন প্রতিনিধির পদ খালি। বাকিদের মধ্যে শিক্ষক সমিতির একজন প্রতিনিধি, সিন্ডিকেট মনোনীত একজন শিক্ষক এবং দু'জন অর্থ বিশেষজ্ঞের মেয়াদ শেষ হয়েছে। অর্থ কমিটিতেও পদাধিকারবলে বৈধ মেয়াদে রয়েছেন শুধু উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, এবং কোষাধ্যক্ষ।
কোনো নির্বাচনই হয় না
পদ খালি ও মেয়াদোত্তীর্ণ হলেও কেন নির্বাচন হয় না — এমন প্রশ্নের উত্তরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সিন্ডিকেট সদস্য (ডিন ক্যাটাগরি) ও বিএনপিপন্থী শিক্ষক সৈয়দ কামরুল আহছান বলেন, 'মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পরও সিন্ডিকেট নির্বাচন না দেওয়া বর্তমান গণতান্ত্রিক উপাচার্যের অগণতান্ত্রিক মনোভাবের পরিচয়। নির্বাচন না দিলে স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা থাকে না, লুটেপুটে খাওয়া যায়। যারা প্রশাসনে থাকে তারা অন্যায় করতে ভয় পায় না, অনেকটা ফ্যাসিস্ট আচরণের মতো।'
অধ্যাপক পদমর্যাদার শিক্ষক প্রতিনিধি হিসেবে সিন্ডিকেটে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে আছেন গণিত বিভাগের লায়েক সাজ্জাদ এন্দেল্লাহ। তিনি জানান, 'প্রত্যেকটা নির্বাচন সঠিক সময়ে হওয়া উচিত। সিন্ডিকেট সদস্য নির্বাচনে শুধু অধ্যাপক না, শিক্ষকদের অন্যান্য ক্যাটাগরিতেও নির্বাচন নিয়মিত হওয়া উচিত।'
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নূরুল আলমকে দীর্ঘদিন ধরে কোনো নির্বাচনই না হওয়া বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, 'সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলে নির্বাচনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে নির্বাচন শিগগিরই হবে বলে আমি আশাবাদী।'
বর্তমান উপাচার্য যেহেতু গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত হয়ে উপাচার্য মনোনীত হয়েছেন; সুতরাং বাকি পর্ষদগুলোর নির্বাচন শীঘ্রই দেবেন বলে আশা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের।
আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের সদস্যসচিব অধ্যাপক বশির আহমেদ বলেন, '২০২২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর অধ্যাপক ড. নুরুল আলম নির্বাচিত উপাচার্যের দায়িত্ব পাওয়ার পর মেয়াদোত্তীর্ণ সব পর্ষদে নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সিনেট কর্তৃক নির্বাচিত উপাচার্য সব স্তরে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় সচেষ্ট আছেন বলে মনে করি।'
এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মঞ্চের আহ্বায়ক ও দর্শন বিভাগের অধ্যাপক রায়হান রাইন বলেন, 'নিজেদের ক্ষমতাকে নিরবচ্ছিন্ন রাখার জন্য মূলত কর্তৃপক্ষ হিসেবে যারা আসে তারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যেতে চায় না। আর সেজন্যই গণতান্ত্রিক নির্বাচনগুলো কর্তৃপক্ষ দিচ্ছে না। নির্বাচন মূলত স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে। এজন্য প্রত্যেকটা পর্ষদের নির্বাচন হওয়া জরুরী।'