ইস্পাত বর্জ্যকে যেভাবে পরিবেশ-বান্ধব নির্মাণ সামগ্রীতে রূপান্তর করলো বিএসআরএম
ইস্পাত তৈরির প্রক্রিয়ায় উত্পন্ন বর্জ্যকে ইটের বিকল্প হিসেবে পরিবেশ-বান্ধব নির্মাণ সামগ্রীতে রূপান্তর করার উদ্যোগ নিয়েছে দেশের শীর্ষস্থানীয় ইস্পাত নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম। পরিবেশের ওপর (দূষণের) চাপ কমাতে বিএসআরএম'র এই উদ্যোগের ব্যাপক প্রশংসা করছেন শিল্প সংশ্লিষ্টরা।
দেশের ইস্পাত শিল্পের প্রধান কাঁচামাল হলো স্ক্র্যাপ। এই উপাদানটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গলিয়ে বিলেট তৈরি হয়। প্রক্রিয়ায় বিলেট (লোহার খণ্ড) পরিণত হয় ব্যবহারযোগ্য ইস্পাতে। স্ক্র্যাপ থেকে বিলেট তৈরির প্রক্রিয়ায় স্লাগ (ইন্ডাকশন ফার্নেসেস স্লাগ) নামে এক ধরনের বর্জ্য সৃষ্টি হয়। মাটির মতো, তবে কঠিন এ বর্জ্যকেই ইটের বিকল্প হিসেবে নির্মাণ সামগ্রীতে রূপ দিয়েছে বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলস (বিএসআরএম)।
প্রায় এক দশকের প্রচেষ্টায় বর্তমানে তা বাণিজ্যিক পণ্যে রূপ দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। অথচ এসব বর্জ্য ডাম্পিং করা হলে জমির উর্বরতা কমে। আর নদী বা সাগরে ফেললে জীববৈচিত্র হুমকিতে পড়ে।
গাজীপুরের ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ইটের পরিবর্তে স্লাগ ব্যবহার করে কংক্রিট তৈরিতে উৎপন্ন কার্বনের পরিমাণ ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত কমানো যেতে পারে; এবং এতে খরচও কমপক্ষে ৩০ শতাংশ কমবে।
বিএসআরএমের তথ্যমতে, ক্রাশার মেশিনের মাধ্যমে উৎপাদিত স্লাগ বিভিন্ন আকারে ভাঙা যায়। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি অন্তত তিন ধরনের কংকর (স্লাগ চিপস) তৈরি করছে, যা ইট ও পাথরের কংকরের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
এছাড়া, স্লাগ দিয়ে তৈরি পেভমেন্ট ব্লক কারখানা বা বাড়ির অভ্যন্তরীণ সড়কে পাতানো ইটের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। কারখানায় চলাচলকারী ভারী যানবানের ভার বহনে এটি সক্ষম ও মজবুত। আর (হলো ব্লক) দেওয়াল নির্মাণের ইটের বিকল্প হিসেবেও এটি ব্যবহার করা হচ্ছে।
এছাড়া, স্লাগ ক্রাশার মেশিনে ভাঙার সময় বালির মতো মিহি উপাদান বের হয়ে আসে। বালির পরিবর্তে তা ব্যবহার করে সড়ক ডিভাইডার তৈরি হয়।
এমনকি, এটি রেলওয়েতে পাথর হিসেবেও ব্যবহার করা যেতে পারে বলে জানিয়েছে বিএসআরএম। এমন ব্যবহারের ফলে বর্জ্য পরিণত হচ্ছে নির্মাণ সামগ্রীতে।
বিশ্বে ক্রমবর্ধমান শিল্প দূষণ এবং পরিবেশগত বিপর্যয়ের মধ্যে বিএসআরএম'র এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়। আজ সোমবার (৫ জুন) সারা বিশ্বের সঙ্গে একযোগে বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালন করছে বাংলাদেশ।
যেভাবে পণ্যে পরিণত হলো স্লাগ
দেশের অন্যতম এই ইস্পাত উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম ২০১২ সালের দিকে স্লাগের ব্যবহার নিয়ে কাজ শুরু করে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের মাধ্যমে স্লাগ ব্যবহারের উপযোগিতা নিরীক্ষা করা হয়।
প্রায় চার বছর বর্জ্যটি নিয়ে কাজ করার পর ২০১৬ সালে তা আলোর মুখ দেখে। ওই বছর আনুষ্ঠানিকভাবে স্লাগ নিয়ে শুরু হয় কাজ। পরের বছর ২০১৭ সালে স্লাগ ভাঙানোর জন্য ক্রাশার মেশিন স্থাপন করা হয় দুটি কারখানায়। ২০১৮ সালে পেভমেন্ট ব্লক এবং ২০১৯ সালে হলো ব্লক সফলভাবে তৈরি সম্ভব হয়।
২০২০ সালে একটি রাস্তা নির্মাণের জন্য এই উপাদান ব্যবহারের অনুমতি দেয় সরকার।
বর্তমান বিএসআরএমের নাসিরাবাদ শিল্প এলাকার দুটি, ভাটিয়ারী ও মিরসরাইয়ের দুটিসহ মোট চারটি কারখানায় স্লাগ প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এরমধ্যে দুটি কারখানায় প্রায় ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে স্লাগ ভাঙার জন্য দুটি ক্রাশার মেশিন স্থাপন করা হয়েছে।
বিএসআরএম এখন প্রতি বছর প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার টন স্লাগ উত্পাদন করে, যার শতভাগই নির্মাণ সামগ্রী হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
এই উদ্যোগের জন্য 'এসডিজি ব্র্যান্ড চ্যাম্পিয়ন অ্যাওয়ার্ডস ২০২৩' পেয়েছে বিএসআরএম।
মানিকগঞ্জের সরকারি সড়কে স্লাগের কংকর
সড়ক নির্মাণে কংকরের পরিবর্তে স্লাগ কংকর ব্যবহারে বাংলাদেশ সড়ক গবেষণাগারের সঙ্গে যৌথভাবে একটি পাইলট প্রকল্প হাতে নেয় বিএসআরএম।
২০২১ সালের দিকে ২৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের মানিকগঞ্জের অভ্যন্তরীণ সড়ক গোলরা-সাটুরিয়া সড়কে এটি ব্যবহার করা হয়। ২৫০ মিটারের মধ্যে মোট ১০০ মিটার সড়কে স্লাগের কংকর বিছানো হয়।
বাংলাদেশ সড়ক গবেষণাগারের পরিচালক আহসান হাবিব দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ছোট একটি সড়কের স্টিল স্লাগ চিপস ব্যবহার করা হয়েছিল। নির্মাণের এক বছর পর আমরা পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। ভালো ফলাফল পেয়েছি।"
"ওই সড়কে যেহেতু কম যানবাহন চলে, তাই বড় পরিসরের ব্যবহারের পরিকল্পনা করছি। আর অন্যান্য সামগ্রী ব্যবহারের সঙ্গে এটি একটি বিকল্প হিসেবে তালিকায় যুক্ত করা হচ্ছে," যোগ করেন তিনি।
পরিবেশসম্মত টেকসই এই সামগ্রী সাশ্রয়ীও
অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশজুড়ে অবকাঠামো উন্নয়নের কাজও চলছে। তাই ইটের চাহিদা বাড়ছে দিন দিন। সারাদেশে মোট ৫ হাজার ইটভাটায় বছরে ১২ বিলিয়ন আগুনে পোড়া ইট তৈরি হয়। এতে কার্বন নির্গমনে হয় প্রায় ১৭ শতাংশ।
বিপরীতে স্ক্র্যাপ থেকে ইস্পাত উৎপাদনের সময় স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় স্লাগ আসে। এরপর তা শুধু ক্রাশার মেশিনে ভাঙানো হয়। এজন্য শতভাগ পরিবেশসম্মত পণ্য হিসেবে এটি স্বীকৃতি পেয়েছে। শুধু পরিবেশসম্মত নয়, ব্যয়ও কম পাশাপাশি তুলনামূলক মজবুতও স্লাগের ব্লক বা সামগ্রী।
বিএসআরএমের তথ্যমতে, নির্মাণ সামগ্রী হিসেবে স্লাগ ইটের চেয়ে গুণগত দিক দিয়ে মানসম্মত। স্লাগ কংকরের পানি শোষণ ক্ষমতা সর্বোচ্চ ২ শতাংশ। অপরদিকে, ইটের কংকরের সর্বোচ্চ ১৩ শতাংশ। ফলে নির্মাণকাজের জন্য বেশি টেকসই স্লাগ। স্লাগের মান অনেকটা পাথরের কাছাকাছি।
বর্তমান বাজারে প্রতি সিএফটি ইটের কংকরের দাম গড়ে ১২০ টাকা, পাথরের কংকর ২০০ টাকা এবং স্লাগের কংকর ৭০ টাকা।
বিএসআরএমের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত টিবিএসকে বলেন, "আমাদের স্টিল স্লাগ শতভাগ রিসাইক্লিং করে ব্যবহার করা হচ্ছে। মিরসরাইয়ে আমাদের নিজস্ব কারখানার ভিত্তি (বেইজমেন্ট) এবং কারখানার সড়কে স্লাগ ব্যবহার করা হয়েছে। এটি শতভাগ সবুজ পণ্য। ফলে একদিকে যেমন পরিবেশদূষণ কমছে; অন্যদিকে নতুন পণ্য ও বাজারও দাঁড়াচ্ছে।"
নতুন সম্ভবনার হাতছানি
সংশ্লিষ্টরা জানান, এ খাতে বছরে ৭.৫ মিলয়ন টন ইস্পাত উৎপাদন হয়। প্রতি টন ইস্পাতের বিপরীতে প্রায় ৪০-৭০ কেজি স্লাগ উৎপাদিত হয়। এ হিসেবে প্রায় ৪ লাখ ৫০ হাজার টন স্লাগ উৎপাদিত হয় এ খাতে। শুধু বিএসআরএম এই বর্জ্য ব্যবহার উপযোগী সামগ্রীতে রূপ দিচ্ছে। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো বর্জ্য হিসেবে ডাম্পিং করছে। ফলে বাড়ছে পরিবেশ দূষণ।
বিএসআরএমের প্রতি টন স্লাগের বিক্রয় মূল্য ১৭০০ থেকে ১৭৫০ টাকা। পুরো খাতের স্লাগ ব্যবহার উপযোগী করা গেলে প্রাথমিক হিসেবে প্রায় ৮০ কোটি টাকার বাজার দাঁড়াবে।
ফখরিস গ্রিন বিল্ডিং রিসোর্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুসেনি টি ফাখরি টিবিএসকে বলেন, "আমরা পরিবেশ-বান্ধব নির্মাণ পণ্য তৈরি করে থাকি, এ কারণেই আমরা এই খাত থেকে উৎপন্ন কার্বনের পরিমাণ কমাতে পাথরের পরিবর্তে স্টিলের স্লাগ ব্যবহার করছি।"
"এতে আমাদের খরচ কমছে; এছাড়া, ইস্পাত স্লাগ চূড়ান্ত পণ্যের গুণমানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে না," যোগ করেন তিনি।