রূপপুরের ইউরেনিয়াম আসবে সেপ্টেম্বরে, পরিবহন হবে সড়কপথে
সম্প্রতি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান জানিয়েছেন, রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রে পরীক্ষামূলকভাবে চালানোর জন্য এ বছরের সেপ্টেম্বরে পারমাণবিক জ্বালানির প্রথম চালান আসবে।
তবে পারমাণবিক জ্বালানি ঢাকার বিমানবন্দর থেকে প্রকল্প এলাকায় পরিবহনের ক্ষেত্রে সরকার শুরুতে কোনো বিমা করছে না বলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। তারা জানান, প্রকল্পের ব্যয় ও বিদ্যুতের দামের ওপর প্রভাব বিবেচনাসহ বেশ কিছু কারণে এখনই বিমা করা হচ্ছে না।
তার বদলে কর্তৃপক্ষ এখন পরিহবন প্রক্রিয়া চলাকালে পারমাণবিক ঘটনার ক্ষতির জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের 'আর্থিক নিশ্চয়তাপত্র'-এর ওপর নির্ভর করছে।
এর ফলে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে সড়কপথে প্রকল্প এলাকায় পরিবহনের সময় রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য আমদানি করা জ্বালানির কোনো ক্ষতিজনিত কারণে সম্ভাব্য আর্থিক লোকসানের পুরো ঝুঁকিই সরকারকে বহন করতে হতে পারে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুটি ইউনিটে বছরে ৭০-৮০ টন ইউরেনিয়াম প্রয়োজন হবে। প্রতি ১৮ মাস পরপর চুল্লিতে (রিয়্যাক্টর) ইউরেনিয়াম লোড করা হবে। প্রতি কেজি ইউরেনিয়ামের জন্য সরকারের খরচ পড়বে ৫৫০ ডলার।
আশা করা হচ্ছে আগামী বছর থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরীক্ষামূলকভাবে চালু হবে।
রাশিয়া থেকে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসবে ইউরেনিয়াম। বিশেষ উড়োজাহাজে বিশেষায়িত কনটেইনারে আনা হবে এই ইউরেনিয়াম। ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সড়কপথে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ইউরেনিয়ামভর্তি বিশেষায়িত কনটেইনার নেওয়া হবে প্রকল্প এলাকা পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার রূপপুরে। এজন্য বেশ কিছু জনশক্তিকে প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে মন্ত্রণালয় সূত্রে।
নিরাপত্তা প্রটোকল সঠিকভাবে মানা হচ্ছে, তা নিশ্চিত করার জন্য আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) পুরো কার্যক্রমটি তত্ত্বাবধান করবে।
মঙ্গলবার এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান টিবিএস বলেন, নিরাপত্তার কারণে পারমাণবিক জ্বালানির পরিবহন পদ্ধতিকে একটি গোপনীয় বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ কারণে এ সম্পর্কে নির্দিষ্ট বিবরণ দেওয়া সম্ভব নয়।
মন্ত্রী বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশও নিরাপত্তার কারণে এ ধরনের জ্বালানি পরিবহনের বিষয়ে গোপনীয়তা বজায় রাখে।
বিমা কাভারেজের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে মন্ত্রী কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
তবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো মূলধনঘন (ক্যাপিটাল ইনটেনসিভ) ও প্রযুক্তিঘন স্থাপনার জন্য বিমা কাভারেজ না থাকা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
ওই কর্মকর্তা বলেন, এরকম জটিল প্রকল্পের বিমা করার অভিজ্ঞতা ও সক্ষমতা বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি বিমা প্রতিষ্ঠানগুলোর নেই। এছাড়া রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বর্তমান পর্যায়ে বিমা করা হলে প্রতি বছর প্রিমিয়াম হিসেবে যে ব্যয় হবে তা প্রকল্পের বিনিয়োগ ব্যয় হিসেবে বিবেচিত হবে এবং বিদ্যুতের দামে তার প্রভাব পড়বে। এ কারণে এখনই বিমা করা হচ্ছে না বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ অ্যাটমিক এনার্জি রেগুলেটরি (বিএইআর) অ্যাক্ট-২০১২-র আওতায়, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি পরিবহন, সংরক্ষণ, ব্যবহার এবং বিদ্যুৎকেন্দ্রের কমিশনিং, পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ পর্যায়ে প্রতিটি পারমাণবিক ঘটনার জন্য আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ সর্বোচ্চ ৩০০ মিলিয়ন স্পেশাল ড্রয়িং রাইটস-এর (এসডিআর) সমান বাংলাদেশি টাকা। বর্তমান বিনিময় হারে বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা। এসডিআর হলো আইএমএফের সদস্য দেশগুলোর অন্যান্য রিজার্ভ সম্পদের পরিপূরক একটি রিজার্ভ ব্যবস্থা। এটি মূলত আইএমএফের এক ধরনের মুদ্রা, যা আবার পাঁচটি মুদ্রায় রূপান্তরিত করা যায়।
বিএইআর অনুযায়ী, আর্থিক নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক নির্ধারিত বা চিহ্নিত দায়িত্বপ্রাপ্ত বিমা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক আন্তর্জাতিকভাবে প্রচলিত ন্যাশনাল নিউক্লিয়ার ইনস্যুরেন্স পুল তৈরি অথবা অন্যান্য আর্থিক নিরাপত্তার মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে।
গত ৫ জুন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি পরিবহনকালে যেকোনো পারমাণবিক ঘটনাজনিত ক্ষতির জন্য আর্থিক নিশ্চয়তাপত্র জারির অনুরোধ জানিয়ে অর্থ বিভাগকে চিঠি দিয়েছে।
এর আগে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন থেকে এ বিষয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেন সংস্থাটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. অশোক কুমার পাল।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ও রাশান ফেডারেশনের মধ্যে স্বাক্ষরিত আন্তঃসরকারি চুক্তি (আইজিএ) এবং রাশান ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান এটমস্ট্রয়এক্সপোর্টের সঙ্গে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের স্বাক্ষরিত সাধারণ চুক্তি অনুযায়ী, পারমাণবিক ক্ষয়ক্ষতির সিভিল লায়াবিলিটি-সংশ্লিষ্ট আর্থিক দায় বাংলাদেশের ওপর বর্তায়।
সিভিল লায়াবিলিটি ফর নিউক্লিয়ার ড্যামেজ অ্যান্ড ন্যাশনাল রেগুলেটরি ল-এর আন্তর্জাতিক কনভেনশনের আলোকে, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ অথবা পরিচালনাকারী প্রতিটি দেশের পারমাণবিক স্থাপনার কমিশনিং, পরিচালন, রক্ষণাবেক্ষণ, পারমাণবিক পদার্থ ও জ্বালানি পরিবহনকালে যেকোনো পারমাণবিক ঘটনাজনিত ক্ষতির দায় বিমোচনের জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের অপারেটর বা লাইসেন্সধারীকে সম্পূর্ণরূপে দায়বদ্ধ করার বিধান রয়েছে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশ সরকার ও রাশান ফেডারেশনের মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে বাস্তবায়নাধীন একটি উল্লেখযোগ্য প্রকল্প। এটি দেশের প্রথম ও একমাত্র পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র।
১৩.৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে নির্মাণাধীন এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ শুরু হয় ২০১৭ সালে। ২০২৪ সালে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরীক্ষামূলকভাবে চালু হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের আগাম খরচ অনেক বেশি হলেও, প্রকল্পটির আয়ুষ্কাল হবে ৬০ বছর। এই দীর্ঘ আয়ুষ্কালের ফলে এখান থেকে দীর্ঘমেয়াদে সাশ্রয়ী ও নিঃসরণমুক্ত বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।