দুদককে সব ধরনের বাণিজ্যভিত্তিক অর্থপাচারের অপরাধ তদন্তের ক্ষমতা দেওয়ার উদ্যোগ
দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) বাণিজ্যভিত্তিক সব ধরনের অর্থপাচার-সংক্রান্ত অপরাধ তদন্ত করার ক্ষমতা দিচ্ছে সরকার, যার সুবাদে সংস্থাটির ক্ষমতা বাড়বে। পুঁজিবাজারে জালিয়াতি, শুল্ক-কর ফাঁকি দিয়ে বিদেশে অর্থপাচার, আমদানি-রপ্তানির আড়ালে অর্থপাচার; দেশি-বিদেশি মুদ্রাপাচার, হুন্ডি, জালিয়াতি ও প্রতারণার মতো অপরাধের তদন্ত করতে পারবে দুদক।
বিদ্যমান মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে চিহ্নিত ২৭ ধরনের অপরাধের মধ্যে মাত্র একটি অপরাধ তদন্ত করার ক্ষমতা রয়েছে দুদকের। শুধু সরকারি কর্মচারীদের ঘুষ ও দুর্নীতি থেকে উদ্ভূত অর্থপাচারের অপরাধ তদন্ত করতে পারে সংস্থাটি।
সরকারি কর্মচারী নয়, এমন নাগরিকের অর্থপাচারের অভিযোগ তদন্ত করতে পারে না প্রতিষ্ঠানটি।
এজন্য মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ও সংশ্লিষ্ট বিধিমালা সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
প্রাইসওয়াটারহাউস কুপার্স ও গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্সসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সমীক্ষার বরাত দিয়ে দুদকের কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচারের ৮০ শতাংশ সম্পন্ন হয় আমদানি-রপ্তানির আড়ালে।
কিন্তু আইনি এখতিয়ার না থাকায় দুদক এ ধরনের অর্থপাচারের অভিযোগের অনুসন্ধান বা তদন্ত করতে পারে না।
বিদ্যমান আইন ও বিধিমালায় পুঁজিবাজারে ইনসাইডার ট্রেডিং ও মার্কেট ম্যানিপুলেশন-সংক্রান্ত সব ধরনের অপরাধ তদন্তের একমাত্র ক্ষমতা রয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি)।
কর ও শুল্ক ফাঁকির মাধ্যমে অর্থ পাচার, চোরাচালান, দেশি-বিদেশি মুদ্রা পাচারের ঘটনা তদন্ত করতে পারে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। আর দলিল-দস্তাবেজ জালকরণ, প্রতারণা ও জালিয়াতির ঘটনা তদন্ত করার এখতিয়ার সিআইডির।
নানা পরিবর্তন
দুর্নীতি দমন ও অর্থপাচার প্রতিরোধে দুদকের ক্ষমতার এই দুর্বলতা দূর করতে সব ধরনের অপরাধ তদন্তের ক্ষমতা দিয়ে আইন ও বিধিমালা সংশোধন করার পদক্ষেপ নিতে গত ২১ জুন বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে চিঠি দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।
এর আগে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে চিহ্নিত সব ধরনের অপরাধ তদন্তের ক্ষমতা দুদককে দিতে আইন ও বিধিমালা সংশোধন করে তা অবহিত করতে গত ৩০ মে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে চিঠি দেয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
গত বছরের ডিসেম্বরে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ এর সভাপতিত্বে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা হয়। ওই সভার মূল এজেন্ডা ছিল বিদ্যমান মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ও বিধিমালা সংশোধন করে দুদককে এ আইনে চিহ্নিত সব ধরনের অপরাধ তদন্ত করার ক্ষমতা দেওয়া।
ওই সভার কার্যবিবরণী পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৭ সালে এক মামলায় দুদক সমস্ত অর্থপাচার অপরাধের তদন্ত করবে বলে রায়ে উল্লেখ করেন হাইকোর্ট। কিন্তু সব ধরনের অর্থপাচারের তদন্ত করার এখতিয়ার না থাকায় ওই রায় বাস্তবায়নে সমস্যায় পড়ে প্রতিষ্ঠানটি।
তার পরিপ্রেক্ষিতেই মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিধিমালার তফসিলে উল্লেখিত সব ধরনের অপরাধ তদন্তের ক্ষমতা চেয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কাছে চিঠি লেখে দুদক।
২০০২ সালে যখন পাশ হয়, তখন আইনটিতে কোনো তদন্তকারী সংস্থা নির্ধারণ করা ছিল না।
২০০৯ সালে আইনটিতে একটি সংশোধনী এনে এককভাবে দুদকের ওপর তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তখন প্রথমবারের মতো ১৬ ধরনের অপরাধ ওই আইনে সম্পৃক্ত করা হয় এবং দুদককে সেগুলো তদন্তের এখতিয়ার দেওয়া হয়।
ওই আইন রহিত করে ২০১২ সালে নতুনভাবে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন প্রণয়ন করে সরকার। এ আইনে ২৭টি অপরাধ নির্ধারণ করা হয়।
এছাড়া নতুন আইনে তদন্তকারী সংস্থা হিসেবে দুদক ও দুদকের কাছ থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত অন্য কোনো তদন্তকারী কর্মকর্তাকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়।
২০১৫ সালে আইনটি আরেক দফা সংশোধন করা হয়। এর ফলে দুদকের এখতিয়ার শুধু সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ ও দুর্নীতি-সংক্রান্ত মামলার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।
২০১৯ সালে প্রণীত মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিধিমালা অনুসারে, অন্যান্য অপরাধের তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় সিআইডি, এনবিআর, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিএসইসির মতো বিভিন্ন সংস্থাকে।
২০১৫ সালে এশিয়া-প্যাসিফিক গ্রুপ অন মানি লন্ডারিং (এপিজি) বাংলাদেশের মিউচ্যুয়াল ইভ্যালুয়েশনের সময় লক্ষ করে যে, দুদক ঘুষ ও দুর্নীতি বাদে অন্য কোনো সম্পৃক্ত অপরাধ থেকে উদ্ভূত অর্থপাচারের অপরাধ তদন্ত করেনি। এ কারণে অর্থপাচারের অপরাধ তদন্তের ক্ষেত্রে এপিজি বাংলাদেশকে সর্বনিম্ন রেটিং দেয়।
তবে দুদকের কর্মকর্তারা বলেন, ঘুষ ও দুর্নীতি ছাড়াও সংস্থাটি ইউনিপেটুইউ, ডেসটিনিসহ বেশ কিছু অর্থপাচারের ঘটনার তদন্ত ও মামলা করেছে।
গত বছর আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে তারা বলে, মানি লন্ডারিং আইন ২০১২ দুদকের জন্য দুর্নীতি ও দুর্নীতির মামলার বাইরেও অন্যান্য অর্থপাচার-সংক্রান্ত অপরাধ তদন্তের পথ খুলে দিয়েছে। কিন্তু ২০১২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ঘুষ ও দুর্নীতি ছাড়া অন্যান্য অপরাধের মাধ্যমে অর্থপাচারের ঘটনার কোনো তথ্য সরকারের অন্যান্য তদন্ত সংস্থা দুদককে সরবরাহ করেনি।
এ পরিবর্তনে কি সাফল্য আসবে?
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ-এর (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'মানি লন্ডারিং-সংক্রান্ত সব ধরনের অপরাধ তদন্তের ক্ষমতা দুদকের হাতে থাকা উচিত বলে আমরা মনে করি।
'প্রথম যখন মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন হয়েছিল, তখন দুদকের এখতিয়ার ছিল। পরবর্তীতে কেন দুদকের ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে, তা আমাদের জানা নেই।'
তিনি আরও বলেন, দুদক মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে চিহ্নিত সব ধরনের অপরাধ তদন্তের ক্ষমতা পেলেই অর্থপাচার বন্ধ হয়ে যাবে, তা নয়।
'তবে আমরা মনে করি, অন্যসব সংস্থার পাশাপাশি দুদকেরও তদন্ত করার ক্ষমতা থাকা উচিত। এবং দুদক অন্য সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে তদন্ত পরিচালনা করলে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে সফলতা আসতে পারে,' টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, দুদকের জন্য দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল প্রয়োজন, যারা কার্যকরভাবে বাণিজ্যভিত্তিক অর্থ পাচারের জটিলতাগুলো মোকাবেলা করতে পারবে।
আইনি উপায়ে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে অন্য যেকোনো তদন্তকারী সংস্থার চেয়ে দুদক বেশি সাফল্য পেয়েছে বলে দাবি করেন দুদক কর্মকর্তারা।
তবে দুদকের সাবেক কমিশনার নাসির উদ্দিন বলেন, সব ধরনের অর্থপাচার-সংক্রান্ত অপরাধের তদন্ত করার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির সক্ষমতায় এখনও ঘাটতি রয়েছে।
তিনি বলেন, 'আমি দুদকে পাঁচ বছর কাজ করেছি। ওই সময়ের তুলনায় দুদক এখন উন্নতি করেছে, তাবে তাদের সক্ষমতায় এখনও ঘাটতি রয়েছে।
'বাণিজ্যভিত্তিক মানি লন্ডারিং খুবই টেকনিক্যাল বিষয়। এসব বিষয়ে দক্ষতার সঙ্গে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করার ক্ষেত্রে আমার দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে ঘাটতি দেখা গেছে। দুদকে প্রশিক্ষিত জনবল কম। প্রশিক্ষিত যেসব কর্মকর্তা আছেন, তাদেরও যথাযথ দক্ষতা আছে কি না, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে।'