ধার করা ল্যাপটপে ফ্রিল্যান্সিং শুরু, এখন হাজারও মানুষের অনুপ্রেরণা জুনায়েদ
ছোটবেলা থেকেই মিউজিশিয়ান হওয়ার স্বপ্ন জুনায়েদ আমান জুনুর। শিশু একাডেমি থেকে গিটার শেখার পর তার সেই স্বপ্ন আরো প্রবল হয়। ২০১৬ সালে নিজের লেখা গানের সুর করেছিলেন। গানটি কম্পোজ করতে ১২ হাজার টাকা লাগবে বলে জানান একজন মিউজিক কম্পোজার। কিন্তু নিজের কাছে টাকা না থাকায় গানটি আর রেকর্ড করা হয়নি তার।
গান রেকর্ডিং এর ইচ্ছা থেকেই সফটওয়্যারের মাধ্যমে মিউজিক কম্পোজের কাজ শিখতে একটি স্টুডিওতে যায় জুনায়েদ। তাদের পরামর্শ অনুযায়ী এই কাজ শিখতে নিজের জন্য একটি ভালো মানের, প্রায় ৫০ হাজার টাকার কম্পিউটার প্রয়োজন। নিজের কোন আয় না থাকায় এতেও স্বপ্নভঙ্গ হয় জুনায়েদের।
মামার কম্পিউটারে ছবি এডিট, ভিডিও এডিটিং শেখার হাতেখড়ি চট্টগ্রামের হাটহাজারীর জুনায়েদ আমান জুনুর। একপর্যায়ে ভিডিও এডিটিং, থাম্বনেইল ডিজাইনের মতো কাজগুলো শিখে ফেলে জুনায়েদ।
২০১৭ সালে তার মামার কাছ থেকে পুরানো ধীরগতির কম্পিউটার নিয়ে ফাইভারে একাউন্ট খুলে জুনায়েদ। ওয়েবসাইটটি ঘুরে দেখে অনেকেই ফ্রিল্যান্সিং করে ইনকাম করছে। তখন জুনায়েদের চিন্তায় এলো, ছবি এডিট, থাম্বনেইল ডিজাইন, বিভিন্ন ব্যানার, ভিডিও এডিটের কাজ বিক্রি করার। তা ভেবেই নিজের সার্ভিস সেখানে দিলো জুনায়েদ। এরপর ক্লায়েন্টরা তাকে 'হায়ার' করা শুরু করলো। টাকা রোজগার শুরু হওয়ায় ফ্রিল্যান্সিংয়ে তার মনোযোগ আরো বেড়ে গেলো।
মিউজিক ক্যারিয়ার শুরু করতে প্রথমে প্রচুর টাকা বিনিয়োগের প্রয়োজন। নিজের স্টুডিও থেকে শুরু করে সব ধরনের উপকরণ সংগ্রহ করার মতো মূলধন তার তখন নেই। জুনায়েদের ভাবনায় তাই তখন ফ্রিল্যান্সিং।
তবে মামার কাছ থেকে ধার নেওয়া ধীরগতির পিসিতে হাইস্পিডের কাজ করা সম্ভব হচ্ছিলো না।
জুনায়েদ বলেন, "আমার কয়েকজন বন্ধুর ভালো ল্যাপটপ ছিল কিন্তু তা তারা ব্যবহার করতো না। তাদের কাছ থেকে মাসভিত্তিক আমি ল্যাপটপ ভাড়া নিয়ে কাজ শুরু করি। নিজে ল্যাপটপ কেনার জন্য প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে সময় ও শ্রম ব্যয় করতে থাকি। ২০১৮ সালের শেষ দিকে ১ লাখ টাকার বেশি দামে নিজের প্রথম কম্পিউটার কিনি।"
আয় রোজগার বাড়াতে দিনে একটানা ১৬-১৮ ঘণ্টা কাজ করতে হতো জুনায়েদকে। অতিরিক্ত পরিশ্রম ও রাত জাগার ফলে ২০১৯ সালের এপ্রিলে অসুস্থ হয়ে পড়েন জুনায়েদ। হাসপাতালে ভর্তিও হতে তাকে। ব্রেইন স্ট্রোক কিংবা কোমায় চলে যাওয়ার আশংকা করেছিলেন চিকিৎসকরা। হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরে পুরোপুরি সুস্থ হতে সময় লাগে ৮ মাস। কাজে না থাকায় সব ক্লায়েন্ট হারিয়ে ফেলেন জুনায়েদ।
লাইফস্টাইল পরিবর্তন করে আবার নতুন করে ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ার শুরু করেন জুনায়েদ। তার অফিসে এখন কাজ করে ৫ জন। গ্রাফিক ডিজাইন, ভিডিও এডিটিং করে কখনো কখনো তার মাসিক আয়ের পরিমাণ ছাড়িয়ে যায় দুই থেকে তিন লাখ টাকার বেশি। গত ৬ বছর বাসায় বসে কাজ করলেও সম্প্রতি চট্টগ্রাম নগরীর আতুরার ডিপো এলাকায় একটি অফিস নিয়েছেন জুনায়েদ।
তবে ফ্রিল্যান্সিংয়ে শুধুমাত্র নিজের আয় করেই ক্ষান্ত দেননি জুনায়েদ। তরুণদের ফ্রিল্যান্সিংয়ে উদ্বুদ্ধ করতেও প্রশিক্ষণ দেন তিনি। 'আইএফ একাডেমি' নামে নিজের একটি ই-লার্নিং ইনস্টিটিউট আছে যেখানে শিক্ষার্থীদের লাইভে ফ্রিল্যান্সিং বিষয়ক ফ্রি ও পেইড বিভিন্ন স্কিল ট্রেইনিং দেওয়া হয়।
এছাড়াও জুনায়েদ আমান নেতৃত্ব দিচ্ছেন চট্টগ্রাম ফ্রিল্যান্সার কমিউনিটিতে। ফেসবুক ভিত্তিক এই গ্রুপে ফ্রিল্যান্সার রয়েছে আট হাজারের বেশি। ফ্রিল্যান্সিংয়ের পাশাপাশি প্রিন্টিং সহ নিজের ২টি ব্যবসা রয়েছে জুনায়েদের। এছাড়া আরেকটি যৌথ অংশীদার ভিত্তিক ব্যবসার সাথেও জড়িত জুনায়েদ। ফ্রিলান্সিং, ব্যবসার পাশাপাশি এখনও কিন্তু তার একাডেমিক শিক্ষা অব্যাহত রয়েছে।
২০২১ সালে বইমেলাতে দেশের ১৫ জন সফল ফ্রিল্যান্সারকে নিয়ে একটি বই লেখা হয়েছিল। ফয়সাল মোস্তফার লেখা 'ফাইভারে ফ্রিলান্সিং' বইতে জুনায়েদের ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ারের সফলতা নিয়েও লেখা হয়েছিলো। ২০২২ সালে ঢাকায় দেশের ৮টি বিভাগের সেরা ৮ জন ফ্রিল্যান্সারকে দেওয়া হয় 'রেসিং ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড'। চট্টগ্রাম বিভাগ থেকে এই অ্যাওয়ার্ড জেতেন জুনায়েদ আমান। সম্প্রতি 'হ্যালো চিটাগাং' আয়োজিত অ্যাওয়ার্ড শোতে চট্টগ্রামের বেস্ট ফ্রিল্যান্সার হিসেবেও অ্যাওয়ার্ড পান তিনি।
জুনায়েদ জানান, কেউ ফ্রিল্যান্সিং শুরু করতে চাইলে কিংবা ফ্রিল্যান্সিং বিষয়ে কোন সমস্যার সম্মুখীন হলে সব সময় তিনি সহায়তা দিয়ে থাকেন।
দেশের মধ্যে ফ্রিল্যান্সারদের সবচেয়ে সক্রিয় ও বৃহৎ গ্রুপ 'ফ্রিল্যান্সার অফ বাংলাদেশ (এফ.ও.বি)' এর সাথেও জড়িত জুনায়েদ আমান।
জুনায়েদ টিবিএসকে বলেন, "নতুনদের যেকোনো প্রয়োজনে সব সময় পাশে থাকি। তারই ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রামে গঠিত চট্টগ্রাম ফ্রিল্যান্সার কমিউনিটির মধ্যে ৫ জন লিডার নির্বাচনের ভোটে আমিও নির্বাচিত হই।"
তিনি আরো বলেন, "মিউজিক ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয় শখ। আমি গিটার, পিয়ানো, বাঁশি, কাহন ইত্যাদি বাজাতে পারি। চলতি বছরের জুলাইয়ের দিকে নিজের স্টুডিও দেওয়ার চিন্তাভাবনাও ছিল। তবে বর্তমানে মিউজিক থেকে দূরে আছি।"