ভারী বর্ষণে ডুবেছে চট্টগ্রাম, বিপর্যস্ত জনজীবন, ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা
টানা ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে পানিতে ভাসছে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। গত তিনদিনের ভারী বর্ষণের ফলে নগরীর বেশিরভাগ এলাকা ডুবে গেছে। সড়কগুলোতে যান চলাচল করতে পারছে না। সড়ক ছাড়িয়ে অলিগলিও তলিয়ে গেছে। নগরীর নিম্নাঞ্চল, নিচু এলাকাগুলোর ভবন, বাসা-বাড়ি, অফিসেও পানি ঢুকেছে। বিপর্যস্ত জনজীবন। ভারী বর্ষণের কারণে জলপথে পণ্য পরিবহন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা বিরাজ করছে।
চট্টগ্রাম আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ জহিরুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "উপকূলীয় এলাকা থেকে শহরের দিকে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি। রবিবার (৬ আগস্ট) বিকাল ৩টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় পতেঙ্গা আবহাওয়া স্টেশনে ২৩১ দশমিক ৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এটি চলতি মৌসুমের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত। মৌসুমি বায়ু, খন্ড মেঘ এবং সমুদ্রে বায়ুর চাপের আধিক্যের কারণে ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। আরো দুই থেকে তিন দিন এমন ভারী বর্ষণ থাকার সম্ভবনা রয়েছে। বৃষ্টিপাতের কারণে চট্টগ্রামে বিভাগে ভূমিধসের শঙ্কা রয়েছে।"
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত মঙ্গলবার (১ আগস্ট) থেকে চট্টগ্রামে বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে। তবে শুক্রবার (৪ আগস্ট) থেকে ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত আছে। গত শনিবার (৫ আগস্ট) বিকাল ৩টা থেকে পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় পতেঙ্গা আবহাওয়া স্টেশনে ৬৫ দশমিক ২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। একইসময়ে শহরের আমবাগান স্টেশনে রেকর্ড হয়েছে ৭৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত। এর আগের ২৪ ঘণ্টায় পতেঙ্গায় ৪২ দশমিক ৮ মিলিমিটার এবং শহরে ১২৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।
বর্ষা মৌসুম শুরুর পর দেড় মাসে চট্টগ্রামে তেমন বৃষ্টিপাত হয়নি। চলতি বছরের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে গত কয়েকদিনে। ফলে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন শহরের মানুষ। শহরের সড়ক থেকে শুরু করে অলিগলি পর্যন্ত ডুবেছে পানিতে। মানুষ অনেকটা ঘরবন্দী। পরিবহন সংকট দেখা দিয়েছে।তুলনামূলক বেশি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ রয়েছে রিকশা-অটোরিকশা চালকদের বিরুদ্ধে। এছাড়া নগরীর বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। ভারী বর্ষণের কারণে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সব ফ্লাইট স্বাভাবিক রয়েছে। তবে অভ্যন্তরীণ রুটের ফ্লাইটগুলো কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে।
নগরীর মুরাদপুর, বহাদ্দারহাট, চকবাজার, বাকলিয়া, দুই নম্বর গেট, হালিশহর, আগ্রাবাদ, সিডিএ আবাসিক এলাকা, পতেঙ্গাসহ বিভিন্ন এলাকায় হাঁটু থেকে কোমরসমান পানি উঠেছে। ঘরবাড়িতে পানি ঢুকে পড়েছে। ফলে দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে মানুষকে।
নগরীর হালিশহর এলাকার বাসিন্দা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "পানির কারণে গাড়ি বের করতে পারিনি। ১৫০ টাকার সিএনজি অটোরিকশার ভাড়া ৩০০ টাকা দিতে হয়েছে। খুব কঠিন অবস্থা। সব সড়কে পানি আর পানি।"
এদিকে পুরো নগরী পানিবন্দী হওয়ায় প্রভাব পড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যে। পাইকারি বাজার থেকে ভোগ্যপণ্য সরবরাহ তুলনামূলক কম রয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। যান চলাচল বাধাগ্রস্ত হওয়ায় পণ্য বেচাবিক্রি কম হচ্ছে। অন্যদিকে বন্দর থেকে পণ্য পরিবহনের লাইটার চলাচলেও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
লাইটার জাহাজ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের নির্বাহী পরিচালক মাহবুব রশিদ খান টিবিএসকে বলেন, "ভারী বর্ষণের কারণে পণ্য পরিবহন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। শুধু কয়লা ও পাথর ছাড়া অন্যান্য পণ্য পরিবহন হচ্ছে না।"
খাতুনগঞ্জের আজিজ ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী আজিজুল হক টিবিএসকে বলেন, "পানির কারণে মানুষ ঘরবন্দি। ফলে খুচরা দোকানেও বেচাবিক্রি কম। তাই আমাদের এখানেও ক্রেতারা আসছেন না। জরুরি হলে, দুই-চারজন ক্রেতা একসঙ্গে ট্রাকে করে অল্প-স্বল্প মাল নিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া শহরের বাইরের ক্রেতাও কম।"
পাহাড় থেকে সরানো হচ্ছে মানুষ
এদিকে ভারী বর্ষণের কারণে বৃষ্টিপাতের শঙ্কায় নগরীর বিভিন্ন পাহাড়ের ঝুঁকিপূর্ণ বসতি থেকে বাসিন্দাদের সরাচ্ছে জেলা প্রশাসন ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক (ডিসি) আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান টিবিএসকে জানান, শনিবার থেকে প্রায় ৮০০ পরিবারকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসন ১৯টি আশ্রয় কেন্দ্র খুলেছে। মাইকিং চলছে।
চসিকের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মুহাম্মদ আবুল হাশেম টিবিএসকে বলেন, "দুটি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। আকবরশাহ, লালখান বাজার, খুলশী, পাহাড়তলী, বায়েজিদ এলাকার বিভিন্ন পাহাড়ের বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।"
প্রকল্পের সুফল পাচ্ছে না মানুষ
চট্টগ্রাম শহরে গত আট বছরে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে জলাবদ্ধতা নিরসনে অন্তত চারটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবি) ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) তিন সংস্থা। তবুও অল্প বৃষ্টিতেই নগরী ডুবে যাওয়ায় হতাশ সাধারণ মানুষ। বর্ষা মৌসুম শুরুর আগে চলতি বছরের ২ মে সংবাদ সম্মেলনে সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ বলেছিলেন, "এবার তেমন জলাবদ্ধতা হবে না।"
তবে গত কয়েক দিনের বৃষ্টিপাতের ধকল সইতে পারেনি নগরী।
অন্যদিকে জলাবদ্ধতার ফলে সৃষ্ট দুর্ভোগের জন্য সিডিএকে দায়ী করছেন চসিক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। তিনি বলেন, "আমরা শুরু থেকেই বলেছিলাম, কাউন্সিলরদের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে জলাবদ্ধতা প্রকল্পের কাজ করা হোক। কিন্তু তা করা হয়নি। এজন্য আজ দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।"
চট্টগ্রামে মোট ৫৭টি খালের মাধ্যমে পানি নিষ্কাশন হয় বঙ্গোপসাগর, কর্ণফুলী নদী ও হালদা নদীতে। এরমধ্যে প্রধান ৩৬টি খালে সংস্কার, পুনরুদ্ধার, খনন, দেয়াল নির্মাণ, জোয়ার-ভাটা নিয়ন্ত্রণে রেগুলেটর স্থাপনের কাজ চলছে। সিডিএ দুটি, পাউবি একটি ও চসিক একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, জলাবদ্ধতা নিরসনে গত ৮ বছরে চট্টগ্রামে বড় চারটি প্রকল্প পেলেও সুফল মিলছে না। কারণ সমন্বয়হীনতা, সঠিকভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই না করা, দীর্ঘসূত্রিতা, মাঝপথে নকশা পরিবর্তন ও প্রকল্পকাজের ধীরগতি।
'চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন' শীর্ষক সিডিএ'র প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সেনা বাহিনী। ৯ হাজার ৫২৬ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটির মেয়াদ চলতি বছরের ডিসেম্বরে শেষ হবে। প্রকল্পটির অগ্রগতি ৮০ শতাংশের কাছাকাছি।
চট্টগ্রামে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও জলাবদ্ধতা নিরসনে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) এক হাজার ৬২০ কোটি টাকার প্রকল্পটির চার বছরে অগ্রগতি ৩০ শতাংশের বেশি।
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট ব্রিজ থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত বেড়িবাঁধ সড়ক নির্মাণ প্রকল্পটি দুই হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়ন হচ্ছে। সিডিএর প্রকল্পটির মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। প্রকল্পটির অগ্রগতি ৭০ শতাংশের বেশি।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) ১ হাজার ৩৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে নগরীর বাড়ইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত খাল খনন প্রকল্প ৯ বছরেও শেষ হয়নি। ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। প্রকল্পটির অগ্রগতি প্রায় ৫০ শতাংশ।
ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট (আইইবি) চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক সভাপতি প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার টিবিএসকে বলেন, "প্রকল্পকাজ শুরুর পর থেকে প্রতি বছর বলা হয়েছিল, আগামী বছর জলাবদ্ধতা হবে না। কিন্তু প্রতি বছরই জলাবদ্ধতা হয়েছে। এজন্য জনগণ এখন তাদের বিশ্বাস করে না।"