চট্টগ্রামে পাহাড় ধস: বাবার বুকে ঘুমানো জান্নাত আর চোখ খোলেনি
"বড় মেয়েটা আমার সঙ্গে ছিল। জান্নাত রাতে ঘুমাতো না। তাই তার বাবার সঙ্গেই থাকতো বেশি। গতকাল (শনিবার) রাতে বৃষ্টি থাকায় তাড়াতাড়ি ঘুমিয়েছিল আমার ছেলের পরিবার। আট মাসের জান্নাত তার বাবার বুকেই ছিল। কিন্তু হঠাৎ নেমে আসা মৃত্যুতে বাবা-মেয়ে আর কেউ জাগেনি।"
এভাবেই বিলাপ করছিলেন চট্টগ্রামের ষোলশহরে পাহাড় ও নির্মাণাধীন দেয়াল ধসে নিহত মো. সোহেলের (৩৫) মা ও জান্নাতের দাদী আয়শা আক্তার। তিনি টিবিএসকে বলেন, "৬০ বছর ধরে এই কলোনিতে বসবাস করছি। সোহেলসহ তিন সন্তানের জন্ম এখানেই হয়েছে। এখানেই তাদের বিয়ে দিয়েছি। সোহেল ছিল সবার ছোট। আজ সেই সন্তান বাড়ির ভেতরেই লাশ হল।"
"তিন ভাইয়ের মধ্যে সমস্যা হলে আমি ভাত খেতাম না। তখন আমার সোহেল কোলে তুলে নিয়ে গিয়ে ভাত খাওয়াতো। এখন আমাকে কে এভাবে খাওয়াবে," বলতে বলতে আবারো বিলাপ শুরু করেন আয়শা আক্তার।
এর আগে রোববার সকাল ৭টার দিকে নগরের ষোলশহর পাহাড় সংলগ্ন আই ডব্লিউ কলোনির একটি বাড়ির উপর পাহাড়সহ নির্মাণাধীন সীমানা দেওয়াল ভেঙ্গে পড়ে। এতে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সোহেল (৩৫) এবং তার আট মাস বয়সী মেয়ে বিবি জান্নাত নিহত হয়। দুর্ঘটনায় নিহত সোহেলের স্ত্রী শরীফা (২৫) ও বড় মেয়ে মিমিকে (১১) গুরুতর আহত অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
নিহত সোহেলের মা আয়েশা আক্তার অভিযোগ করেন বলেন, "এখানে পাহাড় ধসের মত কোনো পরিস্থিতি ছিল না। মূলত, আবদুল খালেক নামে এক রেলকর্মী পাহাড় দখল করে দেয়াল নির্মাণ করছিল। শনিবার বিকেলে সোহেল দেয়াল নির্মাণে বাঁধাও দিয়েছিল। কিন্তু তার অতি লোভের কারণে শিশুসহ আমাদের ছেলেটাকে জীবন দিতে হল।"
পাহাড়ে দেয়াল নির্মাণে বাধা দিলেও শোনেননি 'ভূমিদস্যু' খালেক
রোববার দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় দুর্ঘটনাকবলিত বাড়িটি ষোলশহর পাহাড়ের একেবারে কোল ঘেঁষে গড়ে উঠেছিল। শুধু এই একটি নয়, একইভাবে নির্মাণ করা হয়েছে কয়েকশ কাঁচাঘর। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, রেলওয়ে কর্মচারীদের কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে নিম্ন আয়ের মানুষগুলো ষোলশহর পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করে আসছে বছরের পর বছর ধরে।
নিহত সোহেলের খালাতো বোন শারমিন টিবিএসকে বলেন, 'গতকাল (শনিবার) সকালে যখন খালেকের লোকজন পাহাড় কাটছিল, তখন আমার খালা ও খালাতো ভাই বাধা দিলেও তারা শোনেননি। এই ভূমিদস্যুর লোভের বলি হয়েছে আমার ভাই-ভাগনী।"
স্থানীয় বাসিন্দা গীতা খাস্তগীর বলেন, "খালেক মানুষ না। সে পাহাড় কেটে গত ৪০ বছরে পাহাড়ের অনেক জায়গা দখল করেছে। গতকাল দেয়াল করার সময় আমরা সবাই বলেছি। সোহেল বলেছিল তাদের অসুবিধা হবে। কিন্তু খালেক শোনেননি।"
সরেজমিনে দেখা যায়, দশ ইঞ্চি ব্যাসের দেয়ালের অর্ধেকই সোহেলদের বাড়ির উপর ধসে পড়েছে। দেওয়ালের আরেকটি অংশ এখনো ঝুলে আছে।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় ফায়ার সার্ভিসের উপ সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ হারুন পাশা টিবিএসকে জানান, আই ডব্লিউ কলোনির পাহাড়টি অন্তত ৫০ ফুট উচুঁ। সেখানে নতুন তৈরি করা রিটেইনিং ওয়ালের কারণেই দুর্ঘটনা। আমরা ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের সরে যেতে বলেছি। ঝুঁকিপূর্ণ দেওয়াল অপসারণে কাজ চলছে।
পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সন্তোষ কুমার চাকমা বলেন, "আমরা স্থানীয়দের কাছ থেকে আবদুল খালেক নামে একজনের বিরুদ্ধে পাহাড় কাটার অভিযোগ পেয়েছি। ঘটনার পর থেকে তিনি পলাতক আছেন।"