অভিমানে আত্মহত্যা করেছেন সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী: জরিপ
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশে ৩৬১ জন শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা করেছেন। মূলত অভিমানের কারণেই তারা আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন বলে উঠে এসেছে আঁচল ফাউন্ডেশন পরিচালিত এক জরিপে।
আত্মহত্যার অন্যান্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- প্রেম ঘটিত ব্যাপার, পারিবারিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন, একাডেমিক চাপ, মানসিক অস্থিতিশীলতা, পারিবারিক সমস্যাসহ আরও বিভিন্ন বিষয়।
শনিবার (৯ সেপ্টেম্বর) এক সংবাদ সম্মেলনে সমাজকল্যাণ সংস্থার রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস ইউনিটের টিম লিডার ফারজানা আক্তার লাবণী জানান, ১০৫টি জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত আত্মহত্যা সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে জরিপটি করা হয়েছে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের শিশু, কিশোর এবং পারিবারিক মনোরোগবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, "শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা প্রতিরোধে আমাদের বেশি গুরুত্ব দিতে হবে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত রেজিলেন্সি বাড়ানোর ক্ষেত্রে। কারও প্রেমে ভেঙে যেতে পারে বা রেজাল্ট খারাপ হতেই পারে, কিন্তু সেটি থেকে বের হয়ে এসে যেনো ভালোভাবে বাঁচতে পারে, সেই মানসিক জোর তারমধ্যে তৈরি করতে হবে।"
"শিক্ষার্থীরা কেউ যদি হঠাৎ চুপচাপ হয়ে যায়, বাসায় সবার সাথে খেতে বসতে না চায়, দরজা বন্ধ করে একা থাকে- তাহলে তার সাথে কথা বলতে হবে, কাউন্সেলিং করতে হবে," বলেন তিনি।
ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, আত্মহত্যার ঘোষণা দিলে কেউ আত্মহত্যা করেনা এ ধারণা ভুল। কেউ যদি কখনো রাগ করে, অভিমান করে এমনকি হাসতে হাসতে আত্মহত্যার কথা বলে সেটিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। তার কাউন্সেলিং করাতে হবে।
"আমাদের উচিত শিক্ষার্থীদের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি মনোযোগী হওয়া। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের পরিবারের সদস্যদের এবং শিক্ষকদেরও নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে হবে, যেন তারা শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে যত্নবান হতে পারেন," যোগ করেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে ফারজানা আক্তার বলেন, ২০২১ সালে মোট ১০১ জন এবং ২০২২ সালে ৫৩২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন।
স্কুল শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি
ফারজানা আক্তার বলেন, স্কুল শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি। আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়াদের মধ্যে ১৯৪ জনই স্কুল শিক্ষার্থী।
গড়ে প্রতি মাসে ৪৫ জনেরও বেশি শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে। আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি ১৩-১৯ বছর বয়সীদের মধ্যে, যারা মোট সংখ্যার ৬৭.৩ শতাংশ। এরমধ্যে মেয়ে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ১৫৯ জন এবং ছেলে শিক্ষার্থী ৮৪ জন।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০-২৫ বছর বয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার ২১.৬ শতাংশ; ২৬-৩০ বছর বয়সীদের মধ্যে ২.৮০ শতাংশ এবং ১-১২ বছর বয়সীদের মধ্যে এই হার ৮.৩০ শতাংশ।
জরিপ অনুসারে, এই সময়ের মধ্যে মোট ৯৬ জন কলেজ শিক্ষার্থী এবং ৬৬ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন।
জরিপে দেখা গেছে, আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে প্রায় ৩০ জন মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় ঢাকা বিভাগে আত্মহত্যার হার বেশি।
সংবাদ সম্মেলনে লাবণী বলেন, আত্মহত্যার ক্ষেত্রে ছাত্রদের তুলনায় ছাত্রীদের সংখ্যা বেশি; আলোচ্য সময়ে আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫৯.৩০ শতাংশ।
অভিমানে আত্মহত্যা বেশি
আঁচল ফাউন্ডেশনের গবেষক দল আত্মহননকারী শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার পিছনের কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখেছেন শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার পিছনে সবচেয়ে বেশি দায়ী অভিমান। অভিমানের কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন ৩১.৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী।
প্রেম ঘটিত কারণে আত্মহত্যা করেছেন ১৫.৮০ শতাংশ; পারিবারিক সমস্যার কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৬.৯ শতাংশ; মানসিক অস্থিতিশীলতার কারণে ১১.৪ শতাংশ; যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে ৩.৩০ শতাংশ এবং ৪.৪ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন একাডেমিক চাপের কারণে।
সংবাদ সম্মেলনে হাইওয়ে পুলিশের ইন্টেলিজেন্স প্ল্যানিং এন্ড রিসার্চ বিভাগের অতিরিক্ত ডিআইজি ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, "এখন শিক্ষার্থীরা অনেক স্মার্ট, তাদের অ্যাডোলেসেন্ট টাইম (বয়ঃসন্ধিকাল) বোঝার মন নেই শিক্ষকদের। অভিভাবকেরাও অনেক চাপ দেন ছেলে-মেয়েদের ওপর। শিক্ষার্থীদের হতাশা, একাকিত্বের সময়ে যদি আমরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারি তাহলে তাদের ওই জায়গা থেকে তাদের বের করে আনা যায়।"
স্বাস্থ্য সেবা অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. শহিদুল ইসলাম, "বর্তমানে আত্মহত্যা এবং আত্মহত্যার প্রচেষ্টা প্রতিরোধ বিষয়টিকে 'অসংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি' অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কম্পোনেন্ট হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। আগামী অর্থবছর থেকে ৫ম হেলথ, পপুলেশন অ্যান্ড নিউট্রিশন সেক্টর প্রোগ্রামের আওতায় সরকার এই প্রথমবারের মত একটি ডেডিকেটেড অপারেশনাল প্ল্যান 'মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড ডিজঅ্যাবিলিটি (এমএইচডি)' অনুমোদন করতে যাচ্ছে। যেখানে আগামী ৫ বছরের মানসিক স্বাস্থ্যের অন্তর্ভুক্ত আত্মহত্যা ও এর প্রচেষ্টা প্রতিরোধে অত্যাধুনিক এবং বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থাপনা হাতে নেওয়া হচ্ছে। যার সুফল দেশবাসী অচিরেই উপভোগ করবেন।"
আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা তানসেন রোজ বলেন, গত বছর শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার মূল কারণ ছিল প্রেম ঘটিত কারণ।
মাদকাসক্তদের আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি: ঢাকা আহছানিয়া মিশন
২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের নারী মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে আসা সেবাগ্রহণকারী নারীদের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৩২২ জন সেবাগ্রহণকারী নারীর মধ্যে ১৭৭ জনের আত্মহত্যার প্রবণতা ছিল।
এরমধ্যে ৯৮ জন কখনো না কখনো আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন এবং ৫ জন চিকিৎসা নেওয়ার পরও শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করেছেন।
এই ১৭৭ জন নারী আত্মহত্যাপ্রবণ রোগীর মধ্যে ১২২ জনই মাদকাসক্ত ছিলেন।
শনিবার রাজধানীর শ্যামলীতে প্রতিষ্ঠানটির স্বাস্থ্য বিভাগের সভাকক্ষে সংবাদ এক সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়।
আজ ১০ সেপ্টেম্বর, বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে 'কর্মের মাধ্যমে আশা তৈরি করো'।