নিম্নমানের ইটে বাড়ছে নির্মাণ ব্যয়, মান ঠিক থাকছে না অবকাঠামোর
নির্মাণখাতের অন্যতম উপকরণ ইটের মান ও আকার ঠিক না থাকায় সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে পরিকল্পনার চেয়ে অনেক বেশি। আবার ব্যয় বেশি হলেও উপকরণের মান নিম্ন হওয়ায় অবকাঠামোর মানও যথাযথ বজায় থাকছে না।
স্থানীয় সরকার বিভাগের এক পর্যালোচনায় ইটের আকৃতি ছোট হওয়ার এর প্রভাব উঠে এসেছে। বিভাগের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে অধিকাংশ স্থাপনায় সাধারণ ভাটার ইটের ব্যবহার করা হয়। কিন্তু পণ্যটির আকার ও গুণগত মান ঠিক না থাকায় ভবন বা স্থাপনা বা রাস্তার স্থায়িত্ব কম হয়। কংক্রিটের কাজে ইটের চিপস বা খোয়া ব্যবহার করা হয়ে থাকে। চিপস মানসম্মত না হলে নির্মাণ করা কংক্রিট দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর বলছে, একটি স্ট্যান্ডার্ড ইটের সাইজ হচ্ছে ৯.৫ ইঞ্চি লম্বা, ৪.৫ ইঞ্চি চওড়া আর উচ্চতা ২.৭৫ ইঞ্চি। অন্যদিকে, স্ট্যান্ডার্ড বা মানসম্মত ইটের উপাদান হচ্ছে ৫৫ শতাংশ সিলিকা, ৩০ শতাংশ অ্যালুমিনা, ৮ শতাংশ আয়রন অক্সাইড, ৫ শতাংশ ম্যাগনেশিয়া, ১ শতাংশ চুন ও ১ শতাংশ জৈব পদার্থ।
কিন্তু দেশের বেশিরভাগ প্রচলিত ইটভাটাগুলোতে এই গুণগত মান ও আকারের ইট তৈরি হচ্ছে না। নিম্নমানের ইট সহজে ভেঙ্গে যায়। নিম্নমান ও ছোট আকারের কারণে প্রতি হাজারে কমপক্ষে ৫০ থেকে সর্বোচ্চ ১০০টি পর্যন্ত ইট বেশি লাগছে।
রিহ্যাবের সাবেক সভাপতি তানবীরুল হক প্রবাল টিবিএসকে বলেন, ঢাকাতে মেশিন মেইড (যন্ত্রের সাহায্যে তৈরি) ইটের ব্যবহার বেশি। মেশিন মেইড ইটের মান ও সাইজ ঠিক থাকে। কিন্তু জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে এ ধরনের ইটের সরবরাহ খুবই কম এবং দামও তুলনামূলকভাবে বেশি। ফলে স্থানীয় ঠিকাদাররা যে ইট পান, সেটি দিয়েই কাজ করেন।
জেলা উপজেলা পর্যায়ে যেসব ইটের সরবরাহ রয়েছে সেগুলোর বেশিরভাগের মান ঠিক থাকে না। আকারেও ছোট হয় বলে উল্লেখ করেন তিনি।
তানবীরুল হক নিজের কাজের উদাহরণ দিয়ে বলেন, "আমি যশোরে কাজ করছি। সেখানে আমাকে ভাটা মালিকদের বলে কয়ে বেশি দাম দিয়ে মান ও আকারে সঠিক ইট নিতে হচ্ছে।"
খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমানে সাধারণ ভাটার প্রতি হাজার ইট ১২,০০০ থেকে ১৩,০০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ, প্রতিটি ইটের দাম পড়ছে ১২-১৩ টাকা।
এ বিষয়ে বেসরকারি খাতের শীর্ষস্থানীয় ডেভেলপার কোম্পানি আনোয়ার ল্যান্ডমার্কের জেনারেল ম্যানেজ্যার (কনস্ট্রাকশন অপারেশন) মো. তরিকুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "প্রচলিত ভাটাগুলোর ইটের আকারে তারতম্য থাকে। আমরা যতটা লম্বা, চওড়া ও উচ্চতার ইট চাই, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেটা পাওয়া যায় না। ইটের মানও অনেক ক্ষেত্রে ঠিক থাকে না।"
"ইটের মানের ওপর কতটা ভাঙ্গবে তা নির্ভর করে। মান খারাপ হলে ভাঙে বেশি। এতে বাড়তি ইট ব্যবহার করতে হয়। যে কারণে নির্মাণ খরচ বেড়ে যায়," বলেন তিনি।
বাংলাদেশ ইট প্রস্তুতকারক মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "মাটির কারণে ইটের আকার ও মানে পরিবর্তন হয়। এটেল মাটির হার বেশি হলে, ডাইসে সঠিক পরিমাণ দিলেও ইট পোড়ানোর সময় তা কিছুটা ছোট হয়ে আসে। আবার কোনো কোনো ভাটা পরিকল্পিতভাবে ছোট ইট প্রস্তুত করে।"
"আর মান নির্ভর করে কোথা থেকে কি মাটি পাওয়া যাচ্ছে তার ওপর। ভাটায় মাটির মান ঠিক করার জন্য বালিসহ অন্যান্য উপাদান মিশ্রণ করা হয়। তবে ইটের বেশিরভাগ যেহেতু মাটি, সেজন্য মাটির গুণাবলীর ওপর ইটের গুণাবলী বা মান নির্ভর করে," যোগ করেন তিনি।
ইট ভাটার লাইসেন্স দেয় সংশ্লিষ্ট জেলার জেলা প্রশাসক কার্যালয়। ইটের গুণগত মান ও সাইজ নিশ্চিত করার কাজও তাদের।
আবার বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট(বিএসটিআই) ইটের গুণগত মান নিশ্চিত করে থাকে। জেলা প্রশাসন ও বিএসটিআইয়ের বিভিন্ন সময়ে ইটভাটায় চালানো অভিযানে আকারে ছোট ও যথাযথ মান নেই এমন ইট তৈরির ঘটনা ধরা পড়েছে।
বিএসটিআইয়ের পরিচালক (মেট্রোলজি) সাজ্জাদুল বারী টিবিএসকে বলেন, "বিএসটিআই থেকে ভাটায় সারপ্রাইজ ভিজিট করা হয়। বাজার থেকে ইট সংগ্রহ করেও পরীক্ষা করা হয়। প্রচলিত ভাটায় তৈরি ইটে মান ও আকৃতি সবক্ষেত্রে ঠিক থাকে না।"
এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, সাইজের চেয়ে বেশি সমস্যা গুণগত মান নিয়ে। গুণগত মান ঠিক না থাকলে স্থাপনার স্থায়িত্ব কমে যায়। এজন্য ভাটাগুলো যাতে যথাযথ মান ও আকারের ইট প্রস্তুত করে সেটা নিশ্চিত করতে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
"জেলা প্রশাসকরা তাদের আওতাধীন ইটভাটায় যাতে মানসম্মত ইট প্রস্তুত হয়– সেটি নিশ্চিতে কাজ করছেন," বলেন তিনি।
একজন জেলা প্রশাসক বলেন, ভাটাগুলোতে ১,২,৩ নম্বর ইট থাকে। ক্রেতারা যেটি কিনছেন, ভাটা মালিকরা সেভাবে দাম নেন। ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী ভাটার মালিকরা ইট তৈরি করেন।
ইটের মান ও আকারের স্ট্যান্ডার্ড বজায় রাখতে হলে প্রকল্প বাস্তবায়নকারীদের আগে ঠিক হতে হবে। বাস্তবায়নকারী সংস্থা চাইলে ঠিকাদাররা খারাপ মানের ইট দিয়ে কাজ করতে পারবে না উল্লেখ করেন তিনি।
এদিকে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইনে ইটের সাইজ নিয়ে কোনো কিছু বলা নেই। যে কারণে ইটের আকার ছোট করার জন্য বড় কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় না। স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে ইটের পরিমাপ উল্লেখ করে আইনটি সংশোধন করার সুপারিশ করা হয়েছে।
জেলা পর্যায়ের প্রকৌশলীরাও বলছেন, ঠিকাদার যে মানের ইট পাবেন তা দিয়েই নির্মাণ কাজ করবেন। এ কারণে মানসম্পন্ন ইটের সরবরাহ নিশ্চিত করা জরুরি।
রংপুর এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মাদ শাহজাহান আলী টিবিএসকে বলেন, "ট্রাডিশনাল ইটভাটার ইটের সাইজ ছোট। ভাটারমালিকদের সাথে মিটিং করে, মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেও এটা ঠিক করা যায় না। এটা সারা দেশের বাস্তবতা।"
ভালো মানের ইটের বৈশিষ্ট্য
ভালো মানের ইটের রং সমস্বত্ত্ব হবে। ধারালো চৌকোণা থাকবে, ফাটলবিহীন হবে। দুটো ইটকে পরষ্পর আঘাত করলে ধাতব শব্দ হবে।
ভালো ইটের পানি শোষণ ক্ষমতা ১৫ শতাংশের বেশি হবে না। ভালো মানের খোয়া তৈরির ক্ষেত্রে এস-গ্রেড(স্পেশাল) ইট ব্যবহৃত হয়। যার পানি শোষণ ক্ষমতা ১০ শতাংশের কম হবে।
দেশে ইটের চাহিদা
বাংলাদেশ বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম ইট উৎপাদনকারী দেশ। দেশে ৭ হাজারের বেশি ইটভাটা রয়েছে। এসব ভাটায় বছরে ২৩ বিলিয়ন ইট উৎপাদন করা হয়। প্রায় ১০ লাখ মানুষ সরাসরি এই খাতে সম্পৃক্ত।
এ শিল্প থেকে জিডিপির প্রায় ১ শতাংশ আসে। দেশে যত ইট উৎপাদন হয় তার প্রায় ৩৫ শতাংশই ব্যবহৃত হয় সরকারি কাজে। বাকিটা হয় বেসরকারি খাতের বাড়িঘর, শিল্প কারখানা নির্মাণ ইত্যাদি কাজে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, অটো ব্রিকস ভাটা– যাদের ইটের সাইজ ও মান ঠিক থাকে, তারা বর্তমানে চাহিদার মাত্র ১০ শতাংশ ইট সরবরাহ করতে পারে। ফলে বাধ্য হয়ে প্রচলিত ভাটায় তৈরি ইট ব্যবহার করতে হচ্ছে নির্মাতদের।
যদিও সরকার মাটি দিয়ে ইট তৈরির প্রক্রিয়া থেকে সরে এসে ব্লক তৈরির নীতিমালা করেছে; আগামী ২০২৫ সালের পরে মাটি থেকে তৈরি ইটের ব্যবহার বন্ধ করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।