বিদেশি ঠিকাদাররা প্রকল্পের মাঝপথে চলে যায় কেন
বিদ্যুৎ ও রেল অবকাঠামো খাতের তিনটি উন্নয়ন প্রকল্প থেকে মাঝপথে কাজ ছেড়ে দিয়েছে বিদেশি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, সময়মতো বিল পরিশোধ না করা, সময়মতো সাইট বুঝিয়ে না দেওয়া ও অগ্রিম বিলের বিপরীতে ব্যাংক গ্যারান্টি দিতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে তারা কাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের সঞ্চালন লাইন, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন নির্মাণ এবং কুলাউড়া –শাহবাজপুর রেললাইন পুনর্বাসন প্রকল্পের কাজ ফেলে রুশ, চীন ও ভারতের ঠিকাদারদের চলে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এতে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব হচ্ছে, ব্যয় বাড়ছে, সেইসঙ্গে বাড়ছে জনভোগান্তি।
শাহবাজপুর-কুলাউড়া রেলপথ প্রকল্পের ভারতীয় ঠিকাদার কোভিডের অজুহাতে কাজ অর্ধেক রেখে চলে গেছে। অন্যদিকে চীনা প্রতিষ্ঠান সাইট হস্তান্তরে বিলম্বের কারণ দেখিয়ে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেললাইনের কাজ ছেড়ে চলে গেছে। আর আন্তর্জাতিক বিধিনিষেধের কারণে রূপপুর সঞ্চালন লাইনের কাজে নিয়োজিত রুশ কোম্পানির অর্থ পরিশোধে জটিলতা ছিল।
বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তাদের মতে, পরাশর্মক ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পাওনা সময়মতো পরিশোধ না করার দায় মূলত প্রকল্প পরিচালকদের ওপর পড়ে। কাজ অর্ধেক ফেলে রেখে চলে গেলে বিদেশি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নিয়ম রয়েছে, কিন্তু এক্ষেত্রে কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিকভাবে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, চুক্তি করেও কাজে যোগ না দেওয়া, দেরিতে আসা কিংবা কাজের মাথপথ থেকে চলে যাওয়ার মতো কিছু ঘটনা উন্নয়ন প্রকল্পগুলো ঘটেছে। এতে উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন জটিলতায় পড়ছে।
তিনি বলেন, 'এ ধরনের কাজের জন্য দেশীয় ঠিকাদারদের শাস্তির আওতায় আনা হলেও বিদেশি ঠিকাদাররা ছাড় পেয়ে যাচ্ছে।
'সরকার এখন বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নিয়েছে। এ অবস্থায় চুক্তি করেও সাইটে না আসা বা মাঝপথে চলে যাওয়া ঠিকাদারদের কালো তালিকাভুক্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়ায় নতুন একটি গাইডলাইন করা হচ্ছে। এ বছরের মধ্যে এই গাইডলাইন তৈরির কাজ শেষ হবে।'
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম ব্যস্ততার কারণে কোনো মন্তব্য করে রাজি হননি।
রূপপুর পারমাণকি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঞ্চালন লাইন নির্মাণ
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিদ্যুৎ ইভাকুয়েশনের জন্য সঞ্চালন অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ফ্রিকোয়েন্সি কন্ট্রোল ও ফ্রিকোয়েন্সি ড্রপ প্রটেকশন কাজের জন্য একটি রুশ পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ করা হয় ২০২১ সালের ৩১ জানুয়ারি।
গত ২০ জুন অনুষ্ঠিত প্রকল্পের স্টিয়ারিং কমিটির সভার কার্যবিবরনী সূত্রে জানা গেছে, নিয়োগপ্রাপ্ত রুশ প্রতিষ্ঠান জেএসসি এনার্জোসেটপ্রজেক্ট ইন্সটিটিউট ৩৪ মাস সময়ে কাজের ডিজাইন তৈরি, বিল অভ কোয়ানটিটিজ প্রস্তুতি, টেন্ডার ডকুমেন্ট প্রস্তুতি, দরপ্রস্তাব মূল্যায়ন এবং বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায়। কিন্ত তারা কোনো কাজ করেনি, ফলে বিলও পরিশোধ করতে হয়নি বলে জানান পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অভ বাংলাদেশের (পিজিসিবি) কর্মকর্তারা।
কিন্ত করোনা মহামারির কারণে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বন্ধ থাকা, অগ্রিম বিলের বিপরীতে ব্যাংক গ্যারান্টি দিতে ব্যর্থ হওয়া, ইন্সুরেন্স গ্রহণে বিলম্ব, এলসির (ঋণপত্র) মাধ্যমে বিল গ্রহণে আন্তর্জাতিক বাধার কারণে পরামর্শক সেবা দিতে পারেনি বলে জানায় প্রতিষ্ঠানটি। পরে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে 'ইনসলভেন্সি' ও 'প্রি-ব্যাংকরাপ্টসি'র কারণে প্রতিষ্ঠানটি চলে যায়।
পিজিসিবির কর্মকর্তারা জানান, শর্ত অনুযায়ী এই কাজে রুশ পরাশর্মকই নিয়োগ দিতে হবে। রাশিয়ার ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা, রুশ ব্যাংকের বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ বাধ্যবাধকতাসহ নানা কারণে প্রায় ২ বছরেও নতুন পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়নি। এই অবস্থায় সীমিত দরপত্রের মাধ্যমে নতুন রুশ ঠিকাদার নিয়োগের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
সঞ্চালন অবকাঠামো নির্মাণের কাজ ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও রুশ পরামর্শককে আরও দুই বছর সময়ের বাড়তি সময় দিতে হতে পারে বলে পিজিসিবি সূত্রে জানা গেছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিদ্যুৎ ইভাকুয়েশনের জন্য সঞ্চালন অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালে। এ প্রকল্পের আওতায় আমিনবাজার-কালিয়াকৈর ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন, রূপপুর-ঢাকা (আমিনবাজার-কালিয়াকৈর) ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন, ৪০০ কেভি রূপপুর-গোপালগঞ্জ, ৪০০ কেভি রূপপুর বগুড়া এবং ২৩০ কেভি রূপপুর-ধামরাই সঞ্চালন লাইন এবং যমুনা ও পদ্মা নদীর ওপর দিয়ে ২০ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইনসহ বেশ কয়েকটি সঞ্চালন লাইন নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে।
ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ডুয়েলগেজ রেললাইন নির্মাণ
ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ মিটারগেজ রেললাইনের সমান্তরালে একটি ডুয়েলগেজ রেললাইন নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। প্রকল্পটি কয়েকটি প্যাকেজে বিভক্ত।
এ কাজে প্যাকেজ ১-এর জন্য চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পাওয়ার কনস্ট্রাকশন কর্পোরেশন অভ চায়না এবং বাংলাদেশ রেলওয়ের মধ্যে ২০১৭ সালের জুনে চুক্তি স্বাক্ষর হয়। কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি ২০২৩ সালের ১৫ মার্চ একতরফাভাবে চুক্তিটি বাতিল করে।
জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক মো. সেলিম রউফ বলেন, এ প্রকল্পে নারারণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের এলাকার একটা অংশে রেলওয়ের খুবই স্বল্প জায়গা ছিল। নতুন করে ভূমি অধিগ্রহণ করে ঠিকাদারকে সাইট বুঝিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি। এছাড়া ২০২২ সালে চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যায়, ফলে ঠিকাদারের বিলও আটকে পড়ে।
ওই সময় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি আর্থিক সংকটেও ছিল। এছাড়া ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তির সময় নির্মাণসামগ্রীর যে মূল্য ছিল, পরে তা বেড়ে যাওয়ায় রেট অভ শিডিউল পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। এসব কারণে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানটি কাজ ছেড়ে চলে গেছে বলে জানান তিনি।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, এ প্রকল্পের অনুমোদিত ব্যয় ৩৪৮.১৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ঠিকারদারকে ইতিমধ্যে ১৫৯.৩৫ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে, বকেয়া বিলের পরিমাণ ১৭.৪০ কোটি টাকা।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, বাংলাদেশ রেলওয়ে প্রথমে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার পরিকল্পনা করলেও পরে এ সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে আসে। এ অবস্থায় নতুন করে প্রকল্পের দরপত্র আহ্বানের প্রস্তুতি শুরু করেছে কর্তৃপক্ষ। আগামী চার থেকে ছয় মাসের মধ্যে নতুন দরপত্র আহ্বান প্রক্রিয়া শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজও পিছিয়ে যাবে বলে জানান রেলওয়ের কর্মকর্তারা।
শাহবাজপুর-কুলাউড়া রেলওয়ে পুনর্বাসন
এদিকে কোভিড পরিস্থিতিতে একটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠান রেলের একটি প্রকল্পের কাজ বন্ধ রেখেছিল। কিন্তু করোনা মহামারির পর প্রতিষ্ঠানটি এখনও কাজে ফিরছে না। এ অবস্থায় ২৫.৮২ শতাংশ ভৌত অগ্রগতিতে আটকে থাকা প্রকল্পটি আদৌ বাস্তবায়ন হবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, মৌলভীবাজেরর কুলাউড়া থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শাহবাজপুর রেললাইন পুনর্বাসনে ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কালিন্দী রেল নির্মাণের (টেক্সম্যাকো রেল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের একটি বিভাগ) সঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ের চুক্তি সই হয় ২০১৭ সালের নভেম্বরে। চুক্তি অনুযায়ী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির ২০২০ সালের মে মাসে নির্মাণকাজ শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু এমনিতেই প্রকল্প এলাকায় দেরিতে আসে ভারতীয় ঠিকাদার। পরে করোনা মহামারির অজুহাতে তারা বাংলাদেশ থেকে চলে যায়।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ফিরিয়ে আনতে নানা উদ্যোগ নিয়েও রেলওয়ে ব্যর্থ হয়। এ বিষয়ে ২০২১ সালের এপ্রিলে ভারতীয় দূতাবাসকে চিঠি দিয়েও খুব বেশি কাজ হয়নি বলে জানান রেলওয়ের কর্মকর্তারা ।
প্রকল্প পরিচালক মো. সুলতান আলী জানান, গত আগস্ট থেকে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের কিছু লোক প্রকল্প এলাকয় রয়েছে। তবে বৃষ্টির কারণে বাস্তবায়ন কাজে গতি নেই। কবে পুরোদমে কাজ শুরু হবে, তা এখন বলা যাচ্ছে না।
৬৭৮.৫ কোটি টাকার ব্যয়ের এই প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কাজ শুরু হয়েছিল ২০১১ সালে। এখন পর্যন্ত এই প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ১৪০ কোটি টাকা। তবে বিল বাবদ কী পরিমাণ টাকা ঠিকাদারকে দেওয়া হয়েছে, তা জানা যায়নি।
পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সচিব মো. মামুন-আল-রশীদ বলেন, ঠিকাদার বা পরমর্শক প্রতিষ্ঠানকে কখন বিল পরিশোধ করা হবে এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব প্রকল্প পরিচালকের। সময়মতো উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে কিস্তির অর্থ ছাড়ের ব্যবস্থা করা গেলে এসব সমস্যা এড়ানো যেত। ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তিতে কী কী থাকে, তা অনেকসময় জানেন না প্রকল্প পরিচালকরা।
তিনি বলেন, সরকারি তহবিলের অর্থায়নের প্রকল্পে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অর্থ বিভাগকে চিঠি দিয়েও দ্রুত অর্থছাড়ের ব্যবস্থা করা সম্ভব। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে অনেকসময়ই প্রকল্প পরিচালকের অবহেলা থাকে।
'প্রকল্প থেকে ঠিকাদার চলে যাওয়ার দায় প্রকল্প পরিচালকতে নিতে হবে এবং এর জন্য প্রকল্পে বিলম্ব হওয়ার কারণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে শাস্তির আওতায় আনা উচিত,' বলেন তিনি।
প্রকল্পের সাইট বুঝিয়ে দিতে না পারার প্রসঙ্গে মামুন-আল-রশীদ বলেন, যেসব প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণ থাকবে, সেই ক্ষেত্রে আগে থেকে ব্যবস্থা নিয়ে সহজে সমস্যা সমাধন করা সম্ভব।
তিনি বলেন, ভারতীয় অর্থায়নের প্রকল্পে ভারতীয় ঠিকাদারে কারণে প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্যায় পড়ে। ভারতীয় ঋণের প্রায় সব প্রকল্পে একই সমস্যা রয়েছে। সময়মতো ঠিকাদার সাইটে আসে না। কাজ শুরু করে দেরিতে। কোভিডের অজুহাতে বেশ কয়েকটি প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ ছিল বা আছে। এক্ষেত্রে দুই দেশের মতো আলোচনা আরও বাড়ানো দরকার বলে মনে করেন মামুন-আল-রশীদ।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, যেসব প্রকল্পে ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সাইটে আসতে বিলম্বে এসেছে কিংবা মাঝপথে কাজ বন্ধ করে দিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে: খুলনা-মোংলা রেললাইন উন্নয়ন এবং আখাউড়া-আগরতলা রেললাইন প্রকল্প।