আজ একনেকে অনুমোদনের জন্য উঠছে ৬২,৯৬০ কোটি টাকার নতুন প্রকল্প
বর্তমান সরকারের শেষ সময়ে ও নির্বাচনের ঠিক আগে আগে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় আজ (৩১ অক্টোবর) উপস্থাপন করা হচ্ছে রেকর্ড ৬২,৯৬০ কোটি টাকার ৩১টি নতুন প্রকল্প, যা দুটি পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয়ের সমান।
এরমধ্যে ২৭টি প্রকল্প জ্বালানি ও ভৌত অবকাঠামো খাতের বলে জানা গেছে পরিকল্পনা কমিশনে সূত্রে।
আরও জানা গেছে, এসব নতুন প্রকল্প ছাড়াও ১৩টি প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাবও আজ একনেকের সভায় উপস্থাপন করা হবে। শুরুতে সংশোধিত ১৩ প্রকল্পের মূল অনুমোদিত ব্যয় ছিল ১১,২৫৭.৫৮ কোটি টাকা। এসব প্রকল্পে এখন আরও ১২,১০৩.৬৫ কোটি টাকা ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। ব্যয় বৃদ্ধির পর এসব প্রকল্পের মোট ব্যয় দাঁড়াবে ২৩,৩৬১ কোটি টাকায়।
এছাড়া, ৬টি প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাবও তোলা হচ্ছে বলে জানা গেছে। আজ মঙ্গলবার শেরে বাংলানগরের এনইসি সভাকক্ষে প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে একনেকের সভায় এসব প্রস্তাব তোলা হবে।
পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সচিব মো. মামুন-আল-রশিদ বলেন, এক বৈঠকে এত বেশি প্রকল্প অনুমোদনের জন্য উপস্থান করা উচিত নয়। এতে পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষে ঠিকভাবে প্রকল্প যাছাই-বাছাই করা সম্ভব হয় না।
তিনি জানান, ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে সরকার একেকটি বৈঠকে ৪০টি করে প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে। ওই সময় কোনো কোনো প্রকল্প প্রস্তাবের ওপর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভাও (পিইসি) অনুষ্ঠিত হয়নি। পরে এসব প্রকল্প বারবার সংশোধন করতে হয়েছে।
তিনি বলেন, যেসব প্রকল্প এখন তড়িঘড়ি করে একনেকে উপস্থাপন করা হচ্ছে, সেগুলো শেষ মুহূর্তে এসেছে। এসব প্রকল্প আগে কমপক্ষে ৬ মাস আগে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হলে, সঠিকভাবে যাচাই করা সম্ভব হতো। সব সংস্থাই নির্বাচনের আগে শেষ মুহূর্তে প্রকল্প নিয়ে আসে। নির্বাচনে পর এসব প্রকল্প নিয়ে আসলে খুব বেশি সমস্যা হতো বলে মনে হয় না।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের সাবেক মহাপরিচালক মোস্তফা কে মুজেরি বলেন, রাজনীতিবিদ, আমলা এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিদের খুশি করার জন্য নির্বাচনের আগে একগাদা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এই প্রকল্পগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত; এগুলো অনুমোদিত হয় যাতে রাজনীতিবিদরা এলাকা পরিদর্শন করতে গিয়ে বক্তৃতা দিতে পারেন।
তিনি আরও বলেন, নির্বাচনের আগে তড়িঘড়ি অনুমোদন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাব থেকে যায় এবং যথাযথ মান বা সরকারি বিধিবিধানকে তেমন বিবেচনায় নেওয়া হয় না। প্রকল্পগুলোর দ্রুত অনুমোদনে উৎসাহিত হন সুবিধাবাদীরা।
মোস্তফা কে মুজেরি বলেন, নির্বাচনের আগে প্রকল্প অনুমোদন পেলেও, এরমধ্যে অনেকগুলোরই শেষ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। এ জাতীয় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা জটিল হয়ে পড়ে এবং বারবার সংশোধনের ঝামেলা এড়াতে সাবধানে এসব প্রকল্প বাছাই করা উচিত। প্রায়ই দেখা যায়, এ ধরনের প্রকল্প থেকে তেমন সুফলও আসে না; তাই নির্বাচনের আগে তড়িঘড়ি করে প্রকল্প অনুমোদন না দেওয়াই ভালো।
সড়ক ও সেতু প্রকল্প
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, আজকের একনেক সভায় সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ এবং সেতু বিভাগের ৭টি প্রকল্প অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে।
এরমধ্যে ৮,৫৫৬ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদনের জন্য একনেক সভায় উঠবে। এই প্রকল্পে ৫,৭০৯ কোটি টাকা ঋণ দেবে জাপান সরকার।
ভাঙ্গা-যশোর-বেনাপোল মহাসড়ককে ৪-লেনে উন্নীতকরণের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ ও ইউটিলিটি স্থানান্তরে ৬,১৪০ কোটি টাকার আরেকটি প্রকল্পও অনুমোদনের জন্য সভায় উপস্থাপন করা হবে বলে পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে।
এছাড়া, ১,৪৪২ কোটি টাকা ব্যয়ে রহমতপুর-বাবুগঞ্জ-মুলাদি-হিজলা মহাসড়কের ৮ম কিলোমিটারে ফেরি সার্ভিসের স্থলে আড়িয়াল খাঁ নদীর ওপরে মীরগঞ্জ সেতু নির্মাণের একটি প্রকল্প একনেক সভায় উপস্থাপন করা হবে । এর মাধ্যমে বরিশাল বিভাগীয় শহরের সাথে মুলাদি ও হিজলা উপজেলার নিরবচ্ছিন্ন সড়ক স্থাপন হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
রেল প্রকল্প
পরিকল্পনা কমিশনে সূত্রে জানা গেছে, একনেক সভায় আজ রেলের তিনটি প্রকল্প অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে। এরমধ্যে দুটি নতুন প্রকল্প রয়েছে।
ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত দ্রুতগতির ট্রেনের নিরবচ্ছিন্ন যাতায়াতের সুবিধার্থে চট্টগ্রাম-দোহাজারী সেকশনের ৮৫ বছরের পুরাতন মিটারগেজ রেলপথটি ডুয়েলগেজে রূপান্তরের একটি প্রকল্প সভায় উপস্থাপন করা হবে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১০,৭৯৭ কোটি টাকা, যার মধ্যে এশীয় উন্নয়ন ব্যংক ৭,০৮৫ কোটি টাকা ঋণ দেবে।
পরিকল্পনা কমিশন বলছে, ভবিষ্যতে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দরের সাথে বাণিজ্যিক যোগাযোগ ও কক্সবাজারের পর্যটন শিল্প প্রসারে এই ট্রেন যোগাযোগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে দুই প্রকল্প
২ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং বার্ষিক রপ্তানিতে ২.৪ বিলিয়ন ডলার অর্জনের জন্য যশোরে দেশের ১০তম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া শুরু করেছে সরকার।
বিদেশি বিনিয়োগ আনতে ১,৮৯২.৭২ কোটি টাকা ব্যয়ে যশোর রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা স্থাপনের একটি প্রকল্প একনেকে উপস্থাপন হবে আজ। প্রস্তাবনা অনুযায়ী, এর মাধ্যমে ৪৩৮টি শিল্প প্লট তৈরি করা হবে এবং প্রস্তাবিত রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের উন্নয়ন আগামী ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে শেষ হবে।
এছাড়া, মহেশখালী অর্থনৈতিক অঞ্চল-৩ (ধলঘাটা)-এর গ্যাস, বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ অবকাঠামো নির্মাণে ১,১৯৫ কোটি টাকার প্রকল্পও একনেকে উপস্থাপন করা হবে আজ।
গ্যাস মিটার স্থাপনের তিন প্রকল্প
গ্যাস মিটার স্থাপনে ৬,৪৩৭.৫৪ কোটি টাকা ব্যয়ে গ্যাস মিটার স্থাপনের তিনটি প্রকল্পও একনেকে উস্থাপন করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা।
প্রকল্প তিনটি হলো– পিজিসিএল ফ্র্যাঞ্চাইজি এলাকায় স্মার্ট প্রিপেইড গ্যাস মিটার, এসসিএডিএ এবং জিআইএস স্থাপন; গ্যাস সেক্টর এফিসিয়েন্সি ইমপ্রুভমেন্ট অ্যান্ড কার্বন অ্যাবেটমেন্ট প্রজেক্ট এবং স্মার্ট মিটারিং এনার্জি এফিসিয়েন্সি ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট।
কর্মকর্তারা জানান, তিতাসের দুটি প্রকল্প শেষ হলে বাসাবাড়িতে ব্যবহারকারীদের জন্য রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানির প্রিপেইড মিটারিং কভারেজ বৃদ্ধি পাবে ৮১.৭৯ শতাংশ।
৩২টি অনুমোদিত প্রকল্প অবগতির জন্য একনেক সভায় তোলা হবে।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, ৫০কোটি টাকা বা তার চেয়ে কম ব্যয়ের ৩২টি প্রকল্প সম্প্রতি পরিকল্পনা মন্ত্রী অনুমোদন করেছেন। এসব প্রকল্পের বিষয়ে একনেক সভায় জানানো হবে। এরমধ্যে সড়ক অবকাঠামো বিভাগের ৭টি প্রকল্প, আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের ১৬টি এবং কৃষি পানি সম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের ৮টি প্রকল্প রয়েছে।