সিনোভ্যাক ৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিচ্ছে, অনুমোদন বিলম্ব কারণ
বাংলাদেশে প্ল্যান্ট স্থাপন এবং প্লাজমা-বেজড ওষুধ ও টিকা তৈরির জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রকল্প থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে করোনার টিকা উৎপাদনকারী চীনা প্রতিষ্ঠান সিনোভ্যাক বায়োটেক। অনুমোদনের জন্য প্রায় এক বছর অপেক্ষার পর এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
সিনোভ্যাকের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, প্রকল্প অনুমোদনে বিলম্বের কারণে কোম্পানিটি বিনিয়োগের পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছে। তবে অন্যান্য সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশে এরকম উদ্যোগকে সহাতা দেওয়ার মতো আইনি কাঠামোর না থাকায় এবং প্লাজমা-বেজড ওষুধ তৈরির অনুমতি পাওয়া আরও দুটি স্থানীয় কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় যেতে চায় না এ বিনিয়োগের পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছে প্রতিষ্ঠানটি।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে গত কয়েক বছরের মধ্যে এটিই ছিল সবচেয়ে বড় বিদেশি বিনিয়োগ।
কোম্পানিটির একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, সিনোভ্যাক রাজধানীর গুলশানের অফিস ছেড়ে দিয়েছে। এছাড়া ৪০ জন কর্মচারীকে পূর্ব নোটিশ ছাড়াই ছাঁটাই করেছে, আরও ২০ জনকে সেপ্টেম্বরে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি তাদের ২১টি প্লাজমা সেন্টার বন্ধ করে দিয়েছে এবং প্ল্যান্ট স্থাপনের জন্য মেঘনা অর্থনৈতিক অঞ্চলের সঙ্গে তাদের জমি অধিগ্রহণ চুক্তি থেকেও সরে এসেছে।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) তথ্য অনুসারে, এক বছর আগে প্রাথমিক অনুমোদন পাওয়ার পর মেঘনা অর্থনৈতিক অঞ্চলে একটি বায়োটেক মেডিসিন প্ল্যান্ট স্থাপন এবং প্রায় আট ধরনের ওষুধ তৈরির জন্য বছরে প্রায় ১৫ হাজার টন প্লাজমা সংগ্রহ করার পরিকল্পনা করেছিল সিনোভ্যাক।
সিনোভ্যাক ইতিমধ্যে বাংলাদেশজুড়ে ২২টি প্লাজমা সংগ্রহ কেন্দ্র স্থাপন করেছিল। আরও বেশ কিছু কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনাও নিয়েছিল। কোম্পানিটি ৬০ জন কর্মী নিয়োগ করার পাশাপাশি আরও ১ হাজার জনকে নিয়োগ করার পরিকল্পনা করেছিল।
প্লাজমা-বেজড ওষুধ মানুষের রক্তরস থেকে তৈরি হয়। এ প্রক্রিয়ায় রক্তের প্লাজমাকে তার বিভিন্ন উপাদানে আলাদা করে তা থেকে ওষুধ তৈরি করা হয়। প্লাজমা হচ্ছে রক্তের তরল অংশ যাতে প্রোটিন, অ্যান্টিবডি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপাদান থাকে। করোনা, ইনফ্লুয়েঞ্জা, পা ও মুখের রোগ, এইচআইভি, ক্যান্সারের মতো বিভিন্ন মারাত্মক রোগের চিকিৎসার জন্য প্লাজমা থেকে তৈরি ওষুধ প্রয়োজন।
সিনোভ্যাকের বিনিয়োগ পরিকল্পনা বাতিলের সিদ্ধান্তে অবাক হয়েছে সরকারের বিদেশি বিনিয়োগ কর্তৃপক্ষ।
বিডার নির্বাহী সদস্য (ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন) মোহসিনা ইয়াসমিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'কর্মী ছাঁটাই বা সিনোভ্যাকের দেশে বিনিয়োগ বাতিল করার পরিকল্পনার কথা আমরা শুনিনি।'
তিনি জানান, দেশের বিদ্যমান আইনে কোম্পানিটির কাজ করার সুযোগ নেই—কিন্তু সরকার বাংলাদেশে প্লাজমা-বেজড ওষুধ উৎপাদনের অনুমতি দেওয়ার জন্য একটি নতুন নীতিমালা প্রণয়নের কাজ করছে।
মোহসিনা ইয়াসমিন আরও বলেন, 'এত সব উদ্যোগ নেওয়ার পরও যদি তারা [সিনোভ্যাক] স্থানীয় কর্মীদের ছাঁটাই করে, তাহলে তা আশ্চর্যজনক হবে।'
টিবিএসের সঙ্গে আলাপকালে সিনোভ্যাক বায়োটেক (বাংলাদেশ) লিমিটেডের প্রধান ব্যবসায়িক পরিচালক নিং (বেটি) লি বলেন, 'এক বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে, এখনও আমরা বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে প্রকল্প অনুমোদনের জন্য অপেক্ষা করছি। অনুমোদন ছাড়া তো আমরা কিছু করতে পারব না। এই প্রকল্প অব্যাহত রাখার অর্থ, আরও ব্যয় করতে হবে। তবে আমরা এখন পর্যন্ত যেসব পদক্ষেপ নিয়েছি, সে সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। তারা সব জানে।'
নিং লি এ বিষয়ে আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
বর্তমানে বাংলাদেশকে প্লাজমা-বেজড সব ওষুধই আমদানি করতে হয়, যা ব্যয়বহুল। এছাড়া আমদানিতে সময়ও লাগে।
স্বাস্থ্য খাতের সূত্র জানায়, বাংলাদেশে প্লাজমা-বেজড ওষুধ ও টিকা উৎপাদন করতে বায়োটেক প্ল্যান্ট স্থাপনের জন্য সরকার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডসহ আরও দুটি স্থানীয় কোম্পানিকে অনুমতি দিয়েছে।
এ দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সিনোভ্যাক প্রতিযোগিতায় যেতে চায় না বা প্রতিযোগিতায় গেলে তাদের বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে—এ আশঙ্কায় বাংলাদেশ থেকে বিনিয়োগ সরিয়ে নিচ্ছে বলে জানা গেছে।
বিডার মোহসিনা ইয়াসমিন জানান, 'সিনোভ্যাকের তিনজন শীর্ষ কর্মকর্তা ইতিমধ্যে সরকারের কাছ থেকে তিটি ওয়ার্ক পারমিট ভিসা পেয়েছেন। নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিটি ভিসার অধীনে ২০ জন করে জনবল কাজ করতে পারবে।
'সিনোভাক যদি তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করতে চায়, তাহলে তাদের দেওয়া ওয়ার্ক পারমিট ভিসা বাতিল করা হবে,' বলেন তিনি।
প্লাজমা-বেজড ওষুধ উৎপাদনের জন্য নীতি সহায়তা না থাকা সম্পর্কে জিজ্ঞেস হলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তরের একজন পরিচালক টিবিএসকে বলেন, সিনোভ্যাকসহ আরো তিনটি প্রতিষ্ঠানকে প্লজমা-বেজড ওষুধ উৎপাদনের অনুমতি দেওয়ার জন্য আইনি নীতিমালা তৈরি করতে কাজ করছে সরকার।
তিনি বলেন, 'শুনেছি চীনা কোম্পানিটি [সিনোভ্যাক] তাদের লোকবল ছাঁটাই, অফিস বন্ধ ও প্লাজমা কালেকশন সেন্টারগুলো বন্ধ করে দিয়েছে। তারা এ কাজ কেন করছে, আমি জানি না—বাংলাদেশ থেকে তাদের বিনিয়োগ সরিয়ে নেওয়ার অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে।'
২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে সিনোভ্যাক বাংলাদেশে এই বিনেয়োগের অনুমতি পায়। এরপরই রাজধানীর গুলশানে একটি স্থায়ী কার্যালয় চালু করে। সেখানে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দেয়। কোম্পানিটি প্লাজমা সংগ্রহ কেন্দ্র স্থাপনের প্রক্রিয়াও শুরু করে। এছাড়া উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণের জযন মেঘনা অর্থনৈতিক অঞ্চলের সঙ্গে ভূমি অধিগ্রহণ চুক্তিও করে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. আসাদুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, যেকোনো প্রতিষ্ঠানই বাণিজ্যিকভাবে প্লাজমা-বেজড ওষুধের উৎপাদন শুরু করতে পারে। তবে তার আগে এ বিষয়ে গবেষণা ও মূল্যায়ন থাকা দরকার। আর কোনো দেশি বা বিদেশি প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিকভাবে প্লাজমা সংগ্রহ, সরবরাহ বা আমদানি-রপ্তানি করতে চাইলে দেশের নির্ধারিত আইন মেনেই তা করতে হবে।
তিনি বলেন, 'স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে চীনা কোম্পানিটির কী আলোচনা হয়েছে, সেটি আমার জানা নেই। তবে আইন যদি না থাকে, তাহলে এরকম প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। সরকার চাইলে এই আইনি সমস্যার সমাধান করতে পারে। তবে এখন আইনগত বিষয়টি কী অবস্থায় আছে, আমার জানা নেই।'
এরকম প্লাজমা-বেজড ওষুধ উৎপাদন সম্ভব হলে বাংলাদেশের জন্য ভালো হতো বলেও মন্তব্য করেন ডা. আসাদুল।
ওষুধ আমদানিকারকদের তথ্যমতে, বাংলাদেশ প্রতি বছর আড়াই হাজার কোটি টাকার প্লাজমা-বেজড ওষুধ আমদানি করে।