সরকারি সংস্থার জমি হস্তান্তর জটিলতায় চ্যালেঞ্জের মুখে ঢাকা বাইপাস সড়ক প্রকল্প
সরকারের দুই সংস্থা– বাংলাদেশ রেলওয়ে এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরে (আরএইচডি) ভূমি হস্তান্তর জটিলতায় 'ঢাকা বাইপাস' নামে পরিচিত সরকারি-বেসরকারি অংশিদারিত্বে (পিপিপি) নেওয়া দেশের প্রথম সড়ক প্রকল্পটি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
গাজীপুরের ভোগড়া চৌরাস্তা থেকে পুর্বাচল এবং ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ভোলতা হয়ে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের মদনপুর পর্যন্ত ৪৮ কিলোমিটার সড়ক চার লেনে উন্নীত করতে ৩১২.৪৮ একর ভূমির মধ্যে সাত বছরে মাত্র ৯৫.১০ একর (৩০%) বিনিয়োগকারীদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ব্যক্তি খাতে ৩৭.৬ একর ভূমির মধ্যে অধিগ্রহণ করা হয়েছে ২০.২২ একর। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ৭৪.৮৮ একর জমি হস্তান্তর করলেও পানি উন্নয়ন বোর্ড ও রেলওয়ের ২০০ একর জমি হস্তান্তরে জটিলতা চলছে।
সূত্র জানায়, পিপিপি সড়কটি উন্নয়নে রেলওয়ের ১১৯.২৮ একর জমি হস্তান্তর নিয়ে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে ফাইল চালাচালি চলছে কয়েক বছর ধরে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে চলতি বছরের শুরুতে দুই সপ্তাহ সময় বেধে দেওয়া হলেও এ বিষয়ে সমঝোতা স্মারক সই হয়নি।
পিপিপি অফিস সূত্র জানায়, জমি হস্তান্তরে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে একটি খসড়া সমঝোতা স্মারক রেলপথ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলেও তা আমলে না নিয়ে পৃথক একটি খসড়া করেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়।
এই বছরের জুলাইয়ের শুরুতে প্রকল্পটির পরিচালক আরএইচডি'র অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, রেলওয়ে এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড জমি হস্তান্তর করতে নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে এবং চুক্তি প্রক্রিয়া শীঘ্রই সম্পন্ন হবে।
এর চার মাস পর, চুক্তি স্বাক্ষরে বিলম্বের বিষয়ে গতকাল তিনি টিবিএসকে বলেন, "প্রক্রিয়াগত কারণে চুক্তি স্বাক্ষরে কিছুটা বিলম্ব হলেও প্রকল্পটি এগিয়ে নিতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না।"
তিনি জানান, "আগস্ট মাস শেষে মূল প্রকল্পের কাজে ৪৫ শতাংশের বেশি অগ্রগতি হয়েছে। প্রকল্পের প্রথম অংশের কাজ আগামী জুনের মধ্যে শেষ হবে।"
জানতে চাইলে বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিচার্স ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. শামসুল হক বলেন, পিপিপি প্রকল্পে নিষ্কণ্ঠক ভূমি সরবরাহ করার দায়িত্ব সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।
"দ্রুত কাজ শেষ, লাভসহ মূলধন উঠিয়ে নিতে এ ধরনের প্রকল্পে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করে থাকে। জমির সরবরাহ নিশ্চিত না হলে কাজ আটকে থাকার কারণে বিনিয়োগের প্রফিটিবিলিটি কমে আসে," বলেন তিনি।
সরকারের এক সংস্থার সঙ্গে অন্য সংস্থার ভূমি হস্তান্তরে জটিলতার বিষয়টিকে অপ্রত্যাশিত আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, "বিদেশি প্রতিষ্ঠান এ ধরনের জটিলতা দেখলে দেশে আর বিনিয়োগ করতে চাইবে না।"
শুরু থেকেই বিলম্ব
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সমীক্ষা বলছে, দুই লেনের সড়কটিতে প্রতিদিন প্রায় ১৮,২১১ যানবাহন চলচল করে, যার প্রায় ৬০% ট্রাক ও ট্রেইলার। এই সংখ্যা ২০২৫ সালে ৩১,৭১১ ও ২০৪৪ সালে ৮৫,৯৬৯ এ উন্নীত হবে।
এতে আরও বলা হয়, ঢাকা বাইপাস সড়কটিতে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ও ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের সঙ্গে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশাপাশি পূর্বাচল এক্সপ্রেসওয়ের সংযোগ রয়েছে।
এই সড়কটি চার লেনে উন্নীত করলে ঢাকার উত্তর অংশের সাথে সিলেট ও চট্টগ্রামের পণ্য পরিবহন সুবিধা বৃদ্ধির মাধ্যমে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সহজ হবে বলেও জানিয়েছিল এডিবি।
প্রকল্পটি পিপিপি ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করতে ২০১২ সালে নীতিগত অনুমোদন দেয় অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি (সিসিইএ)।
এর ধারবাহিকতায় জমি অধিগ্রহণ ও ইউটিলিটি শিফটিংয়ের জন্য ২০১৬ সালে সরকারের তহবিল থেকে ২৩৬.৫০ কোটি টাকা ব্যয় ধরে পৃথক একটি প্রকল্প অনুমোদন করা হয়। তবে জমি অধিগ্রহণে জটিলতার কারণে সহায়ক প্রকল্পটির মেয়াদ চার বছর বাড়িয়ে ধরা হয় ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত।
পাশাপাশি ১৮৫% বাড়িয়ে প্রকল্পের ব্যয় উন্নীত করা হয় ৬৭৪.৭৪ কোটি টাকায়। এক বছরের কম মেয়াদ থাকা সাপোর্ট প্রকল্পের কাজ অর্ধেকের বেশি বাকি রয়েছে।
ভূমি সংক্রান্ত জটিলতায় সহায়ক প্রকল্প পিছিয়ে যাওয়ার সঙ্গে দফায় দফায় পিছিয়ে যাচ্ছে সড়ক সম্প্রসারণে নেওয়া পিপিপি খাতের মূল প্রকল্পটিও। সর্বশেষ হিসাবে গত আগস্ট পর্যন্ত মূল প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে ৪৫%।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে সই করা চুক্তির আওতায় ২০২২ সালে যানবাহন চলাচলের জন্য সড়কটি খুলে দেওয়ার কথা ছিল। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন।
পরবর্তীতে ২০২২ সালের মে মাসে চুক্তি হালনাগাদ করে ২০২৫ সালের জুলাইয়ের মধ্যে পুরো সড়কটি যানবাহনের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
জটিলতা সমাধানে বৈঠক
এদিকে, জমি হস্তান্তর চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে এ বছরের শুরুতে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল বলে টিবিএসকে নিশ্চিত করেন পিপিপি কর্তৃপক্ষের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
আবার জুন মাসের শুরুতেও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মূখ্য সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় হস্তান্তর প্রক্রিয়া শেষ করতে তিন সপ্তাহের সময় বেধে দেওয়া হয়েছে।
জমির হস্তান্তর ও বিদ্যুতের পোল স্থানান্তর ছাড়া এই প্রকল্পে আর কোনো জটিলতা নেই বলে তিনি জানান।
প্রকল্পটির সর্বশেষ অগ্রগতি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভূমি হস্তান্তরের অগ্রগতির ওপর কাঞ্চন সেতু থেকে মদনপুর পর্যন্ত অংশের কাজ নির্ভর করছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে এই প্রতিবেদনেও জমির সমস্যাটিকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
প্রকল্পের বিস্তারিত
সূত্র জানায়, সিচুয়ান রোড অ্যান্ড ব্রিজ (গ্রুপ) কর্পোরেশন লিমিটেড (এসআরবিজি), শামীম এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড (এসইএল) এবং ইউডিসি কনস্ট্রাকশন লিমিটেড (ইউডিসি) এর কনসোর্টিয়াম এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
চুক্তি স্বাক্ষরের সময় ভৌত প্রকল্পের আনুমানিক ব্যয় ছিল ৩ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। এরমধ্যে সরকারের ২২৪ কোটি টাকা ভায়াবিলিটি গ্যাপ ফাইন্যান্সিং হিসেবে দেওয়ার কথা ছিল।
গত বছরের এপ্রিলে ঢাকা বাইপাস এক্সপ্রেসওয়ে ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড চায়না ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (সিডিবি) এবং বাংলাদেশ ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফাইন্যান্স ফান্ড লিমিটেডের (বিআইএফএফএল) সঙ্গে একটি অর্থায়ন চুক্তি স্বাক্ষর করে।
চায়না ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (সিডিবি) এবং বাংলাদেশ ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফাইন্যান্স ফান্ড লিমিটেড (বিআইএফএফএল) এই প্রকল্পের বিনিয়োগকারীকে যথাক্রমে ১,৬১৪ কোটি টাকা ও ১,০৭৫ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে।
২৫ বছরের চুক্তির আওতায় ৩৮ মাসে সড়কটি উন্নয়ন করবে বেসরকারি অংশীদার। পরবর্তী প্রায় সাড়ে ২২ বছর সড়কটিতে টোল আদায় করবে প্রতিষ্ঠানটি।