চট্টগ্রামের হেভিওয়েট প্রার্থীদের আয়-সম্পদ বেড়েছে
চট্টগ্রামের ১৬টি সংসদীয় আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে কোটিপতি ও ব্যবসায়ীদের সংখ্যা বেশি। বর্তমান সংসদ সদস্যদের মধ্যে বেশিরভাগের সম্পত্তি ও আয় বেড়েছে। কারো কারোর ঋণের পরিমাণও বেড়েছে। স্ত্রীর সম্পত্তির পরিমাণও বেড়েছে কয়েকজনের। গত বৃহস্পতিবার ১৬টি আসনের বিপরীতে ১৪৮ প্রার্থী মোট ১৫১টি মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। তাদের হলফনামা বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
আইআইইউসি থেকে বছরে পৌনে দুই কোটি টাকা নেন নদভী:
চট্টগ্রাম–১৫ (সাতকানিয়া–লোহাগাড়া) আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভী। হলফনামায় তিনি পেশা উল্লেখ করেছেন অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান বোর্ড অব ট্রাস্টিজ আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম (আইআইইউসি)। বছরে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে তিনি ১ কোটি ৩৭ লাখ ৬১ হাজার ৪৪২ টাকা এবং তার ওপর নির্ভরশীল (পরিবারের সদস্য) ৪৪ লাখ ২২ হাজার ৪৪৬ টাকা সম্মানী ভাতা পান। এ ছাড়া, তার আয়ের উৎস হিসেবে– জাতীয় সংসদ থেকে প্রাপ্ত ভাতা ২৩ লাখ ১৫ হাজার ৭০৭ টাকা। আইআইইউসি থেকে তিনি ঋণ নিয়েছেন ৪৬ লাখ ২৯ হাজার ৫০০ টাকা।
কৃষিখাত থেকে নওফেলের আয় ৩৭ লাখ ৭৫ হাজার টাকা:
গত পাঁচ বছরের ব্যবধানে চট্টগ্রাম-৯ আসনের আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী– শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের বার্ষিক আয় বেড়েছে প্রায় ৩০ লাখ টাকা। আয়ে নতুন উৎস হিসেবে যুক্ত হওয়া কৃষিখাতে বার্ষিক ৩৭ লাখ ৭৫ হাজার ৪৫০ টাকা আয় দেখানো হয়েছে। বর্তমানে তার মোট ৭৯ লাখ ২৮ হাজার ৭২৮ টাকা আয়। একাদশ জাতীয় নির্বাচনের হলফনামায় তার বার্ষিক আয় ছিল ৫০ লাখ ৪৫ হাজার ৩০০ টাকা।
পাঁচ বছরে নওফেলের সম্পত্তি ও ঋণ উভয় বেড়েছে। বর্তমানে তার নিজ নামে ৬ কোটি ৯৫ লাখ ৯১ হাজার ৯৫৬ টাকা এবং স্ত্রীর নামে ৭৫ লাখ ৬৯ হাজার ৪১৯ টাকা (৮ হাজার ডলারসহ) মূল্যের অস্থাবর সম্পত্তি দেখানো হয়েছে হলফনামায়। পাঁচ বছর আগে তার নিজ নামে অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ১ কোটি ৬১ লাখ ৯৫ হাজার ৬৩১ টাকা। স্ত্রীর নামে ছিল ৫৯ লাখ টাকা মূল্যের অস্থাবর সম্পত্তি। পাঁচ বছরের ব্যবধানে তার অস্থাবর সম্পত্তি ৫ কোটি টাকারও বেশি এবং ১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা মূল্যের স্থাবর সম্পত্তিও বেড়েছে। একই সময়ে ঋণের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৩ কোটি ৩৩ লাখ টাকা।
১৫ বছরে লতিফের অস্থাবর সম্পত্তি বেড়েছে ১৮ গুণ, আয় ১২ গুণ:
২০০৮ সালে চট্টগ্রাম-১১ আসনের আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ও সংসদ সদস্য এমএ লতিফের অস্থাবর সম্পত্তি (নগদ টাকা, স্বর্ণ) ছিল ৩০ লাখ ২ হাজার ৬৯১ টাকা। বার্ষিক আয় ছিল ৬ লাখ ১৮ হাজার টাকার। এবারের হলফনামায় অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ ৫ কোটি ৫৭ লাখ ৪৭ হাজার ৭০৬ টাকা এবং বার্ষিক আয় ৭৪ লাখ ৮২ হাজার টাকা দেখানো হয়েছে। টানা তিনবার জয়লাভ করা এই সংসদ সদস্যের ১৫ বছরের ব্যবধানে অস্থাবর সম্পত্তি বেড়েছে ১৮ গুণের বেশি এবং বার্ষিক আয় ১২ গুণের বেশি বেড়েছে।
হুইপ সামশুলের আয় বেড়েছে ২১ গুণ:
গত ১৫ বছরে চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসনের সংসদ সদস্য সামশুল হক চৌধুরীর আয় বেড়েছে ২১ গুণ। একইসঙ্গে তার উপর নির্ভরশীলদের আয় বেড়েছে প্রায় ২৬ লাখ টাকা। বর্তমানে তার বার্ষিক আয় ৬২ লাখ ৮৮ হাজার ৮৮০ টাকা। ২০০৮ সালে তার বার্ষিক আয় ছিল ২ লাখ ৯৫ হাজার টাকা।
ভূমিমন্ত্রীর আয় দ্বিগুণ:
গত ১৫ বছরের ব্যবধানে চট্টগ্রাম-১৩ (আনোয়ারা- কর্ণফুলী) আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের বার্ষিক আয় বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। বর্তমানে বার্ষিক আয় ৭৪ লাখ ১২ হাজার ৯৭ টাকা। এরমধ্যে কৃষি খাত থেকে ৮৩ হাজার টাকা, বাড়ি-অ্যাপার্টমেন্ট-দোকান বা অন্য ভাড়া থেকে ৫৮ লাখ ৮৩ হাজার ৩৭৯ টাকা, ব্যবসা থেকে ১ লাখ ৩৫ হাজার ৩০০ টাকা, চাকরি থেকে ১২ লাখ ৬০ হাজার এবং অন্যান্য খাত থেকে ৫০ হাজার ৪১৮ টাকা। ২০০৮ সালে তার বার্ষিক আয় ছিল ৩৫ লাখ ৩২ হাজার ৩০৮ টাকা।
তথ্যমন্ত্রীর ঋণ সোয়া ২ কোটি টাকা:
চট্টগ্রাম-৭ (বাঙ্গুনিয়া) আসনের আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের ২ কোটি ২৮ লাখ টাকা ঋণ আছে। দুটি ব্যাংক থেকে পৃথক ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা ও জামানতবিহীন ৯১ লাখ ঋণ এবং ভাইদের কাছ থেকে ১২ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন তিনি।
হাছান মাহমুদের কাছে নগদ টাকা আছে ৫ লাখ ১০ হাজার, স্ত্রীর আছে ৪০ হাজার টাকা। তথ্যমন্ত্রীর নামে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা ৭ লাখ ২০ হাজার টাকা এবং স্ত্রীর নামে ৫ লাখ ১৫ হাজার। বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার আছে ৭ লাখ ১২ হাজার ২৫০ টাকার। নিজের ৫ ভরি এবং স্ত্রীর ৫০ ভরি স্বর্ণও রয়েছে। আর ৭০ হাজার টাকার ইলেকট্রনিক সামগ্রী ও ৪৫ হাজার টাকার আসবাবপত্র আছে।
চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানা এলাকায় ৬ কাঠা জমি আছে, রাজধানীর পূর্বাচলে ৭ দশমিক ৫ কাঠা জমি, বাকলিয়া মৌজায় ২ কাঠা জমির চারভাগের এক অংশ রয়েছে (যা দালান নির্মাণে হস্তান্তর করা হয়েছে), দানপত্র সূত্রে পাওয়া ৫ দশমিক ৬ কাঠা জমির ওপর একটি দালান ও একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি আছে।
মনজুরের আছে ২০ প্রতিষ্ঠান, ঋণ দুই হাজার কোটি টাকারও বেশি:
চট্টগ্রাম-১০ (ডবলমুরিং–পাহাড়তলী) আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক সিটি মেয়র মোহাম্মদ মনজুর আলম ২০টি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। একটি ব্যাংকে ৯ কোটি ১৬ লাখ টাকা এবং কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা ঋণ আছে মনজুর ও তার পরিবারের সদস্যদের।
মনজুরের বার্ষিক আয় কৃষিখাতে ৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা, বাড়ি, অ্যাপার্টমেন্টে ৭২ লাখ ২২ হাজার ১৫৬ টাকা, একই খাতে স্ত্রীর আয় ১৬ লাখ ৮২ হাজার ৪৭৬ টাকা। ব্যবসা থেকে আয় ২০ লাখ ৭৫ হাজার ৮৫০ টাকা, শেয়ার, সঞ্চয়পত্র, ব্যাংক আমানত থেকে ৭৫ লাখ ৯৩ হাজার ৫০২ টাকা, পেশা থেকে সম্মানী এক লাখ ৪৪ হাজার টাকা, খালি জমি ভাড়া বাবদ ১২ লাখ ৮৩ হাজার ৫৬৮ টাকা। নির্ভরশীলদের বার্ষিক আয় বাড়ি-অ্যাপার্টমেন্টে ১৬ লাখ ৮২ হাজার ৪৭৬ টাকা ও শেয়ার, সঞ্চয়পত্রে আমানত ৯ লাখ ২০ হাজার ৮২৭ টাকা।
দুই ব্যাংকে সোলায়মান শেঠের দায়দেনা ১০২ কোটি টাকার বেশি:
চট্টগ্রাম–৮ (চান্দগাঁও–বোয়ালখালী) আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী সোলায়ামান আলম শেঠ দুটি ব্যাংকে দায় আছে ১০২ কোটি ৮৯ লাখ ৪৯ হাজার ৬৬২ টাকা। পেশায় ব্যবসায়ী এই নেতার বার্ষিক আয় বাড়ি-অ্যাপার্টমেন্ট থেকে ১৫ লাখ ৬২ হাজার ২২৪ টাকা, শেঠ ট্রেডিং থেকে চার লাখ ৫৫ হাজার ২০০ টাকা, আইডিয়াল প্রিন্টিং হাউজ থেকে তিন লাখ ৯১ হাজার ৫০০ টাকা। চাকুরি থেকে আয় ১৮ লাখ ৩৬ হাজার টাকা।
অস্থাবর সম্পত্তির মধ্যে নিজ নামে নগদ টাকা এক কোটি ২৩ লাখ ৪৭ হাজার ৬৬৭ টাকা। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এক কোটি ৭৬ লাখ ৩৯ হাজার ৮৮৩ টাকা, বন্ড, ঋণপত্র স্টক একচেক্স শেয়ার ৬৬ লাখ টাকা, পাঁচটি গাড়ি, স্বর্ণ-অলঙ্কার ২৫ লাখ টাকার, ইলেকট্রিক সামগ্রী দুই লাখ ৫০ হাজার টাকার, আসবাবপত্রের বিবরণী চার লাখ টাকা। স্থাবর সম্পদ হিসেবে নিজ নামে পৈত্রিকভাবে প্রাপ্ত অকৃষি জমির মূল্য ১৪ কোটি ৫০ লাখ ১২ হাজার ৭৯৮ টাকা এবং খাগড়াছড়ির জমির দাম ৫৪ লাখ ৩৪ হাজার টাকা।
নজরুলের স্ত্রীর স্থাবর সম্পদ বেড়েছে ৩২ গুণ:
চট্টগ্রাম-১৪ (চন্দনাইশ, সাতকানিয়া আংশিক) আসনের প্রার্থী মো. নজরুল ইসলাম চৌধুরী স্ত্রীর নামে ২০১৮ সালে স্থাবর সম্পদের আর্থিক মূল্য ২ লাখ ৪ হাজার ৪৪৫ টাকা। এবারের হলফনামায় তা ৬৭ লাখ ৩৪ হাজার ৪৪৫ টাকা দেখানো হয়েছে। অর্থাৎ ৫ বছরের ব্যবধানে নজরুলের স্ত্রীর স্থাবর সম্পদের আর্থিক মূল্য বেড়েছে ৩২ গুণের বেশি। বর্তমানে নজরুলের বার্ষিক আয় প্রায় ৫২ লাখ ৮৬ হাজার ৫৮৭ টাকা।
মিতার চেয়ে স্ত্রীর সম্পদ ৯ গুণ বেশি:
চট্টগ্রাম-৩ (সন্দ্বীপ) আসনের সংসদ সদস্য মাহফুজুর রহমান মিতার চেয়ে তার স্ত্রীর সম্পদ ৯ গুণ বেশি। মিতার নামে স্থাবর সম্পদ রয়েছে তিন কোটি ৯১ লাখ ৪ হাজার টাকার। স্ত্রীর নামে আছে ৩৬ কোটি ৪১ লাখ ৫৭৮ টাকার। পৈতৃক কৃষিজমি ছাড়াও মিতার নামে ঢাকার পূর্বাঞ্চলে রয়েছে ৬ কাঠা ও ৩ কাঠার দুটি প্লট, ঢাকায় স্ত্রীর নামে দুটি ফ্ল্যাট, নিজের বাড়ি এবং স্ত্রীর নামে ঢাকার উত্তরায় প্লট।