সিরাজগঞ্জের তাঁতকলে মিনি ইটিপি: বর্জ্য পানি পরিশোধনে বড় অগ্রগতি
সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার চন্দনগাঁতী গ্রামের মেসার্স মা কালী ডায়িং-এর মালিক, উদ্যোক্তা আশিষ কুমার চক্রবর্তী আগে তার কারখানার বর্জ্য পানি খালে ফেলে দিতেন।
আশিষ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আগে ময়লা পানি খালে ফেলে দিতাম—এতে পরিবেশ দূষণ হতো। নিজের কাছেই খারাপ লাগত।
'কিন্তু এখন কারখানার ময়লা পানি এখন পরিশোধন করে আবার ব্যবহার করতে পারছি। আর অতিরিক্ত যে পানি ফেলে দিচ্ছি, সেটাও পরিশোধন করে ফেলছি।'
কারখানার বর্জ্য পানি এখন একটি মিনি ইটিপি বা বর্জ্য পরিশোধনাগারের মাধ্যমে মাল্টি-স্টেপ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পরিশোধন করে সেই পরিশোধিত পানি আবার সুতা রং করার জন্য ব্যবহৃত হয়।
ইটিপি বা বর্জ্য শোধনাগার স্থাপন করা ছিল সিরাজগঞ্জের তাঁত কারখানা মালিক আশিষের মতো উদ্যোক্তাদের জন্য অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তবে ২০২০ সালে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) তাদের জন্য নিয়ে আসে মিনি ইটিপির পরিকল্পনা।
ওই বছরই বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে 'সাসটেইনেবল এন্টারপ্রাইজ প্রজেক্ট' (এসিইপি) প্রকল্পের আওতায় সিরাজগঞ্জের ছোট কারখানাগুলোতে ছোট আকারের ইটিপি স্থাপন করা হয়, যাতে এই কারখানাগুলো থেকে উৎপন্ন বর্জ্য পানি পরিশোধন করা যায়।
সিরাজগঞ্জ জেলার তামাই ও বেলকুচিতে তাঁতসংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তাদের এবং নারায়ণগঞ্জের জামদানি সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তাদের পরিবেশ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে দুটি উপ-প্রকল্পের আওতায় চারটি কারখানায় মিনি ইটিপি তৈরি করা হয়েছে। ২০২০ সালের অক্টোবরে শুরু হওয়া এ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে চলতি মাসে।
ইটিপি বা পানি শোধনাগার স্থাপনা হচ্ছে এমন একটি প্ল্যান্ট যেখানে বর্জ্য পানি পরিশোধন করা হয় এবং পরিশোধিত পানির মানমাত্রা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিধিমালা অনুসারে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। টেক্সাইল, ডায়িং, প্রিন্টিং, ওয়াশিং, কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি ইত্যাদি শিল্পের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় বর্জ্য পানি নির্গত হয়।
সিরাজগঞ্জের তামাই ও বেলকুচিতে মোট দুটি মিনি ইটিপির মাধ্যমে ২০০ জন উদ্যোক্তা ডায়িং সুবিধা পাচ্ছেন। তাদের প্রায় ১০ হাজার লিটার তরল বর্জ্য দৈনিক পরিশোধিত হচ্ছে।
এটি এলাকার অন্যান্য উদ্যোক্তাদের নিজ কারখানায় এ ধরনের ইটিপি স্থাপন করতে অনুপ্রাণিত করেছে।
আশিষ জানান, এসইপি প্রকল্পের তাকে ৭ লাখ টাকা অনুদান দেওয়া হয়। আরও ১৯ লাখ টাকা একটি ব্যাংক থেকে ঋণ নেন তিনি। মোট ২৬ লাখ টাকা খরচ হয়েছে তার কারখানায় মিনি ইটিপি চালু করতে। চার মাস আগে তার মিনি ইটিপি চালু হয়েছে।
তিনি বলেন, 'এখন পরিবেশের কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকেও কোনো অভিযোগ পাচ্ছি না। আমি চাই না আমার ব্যবসার কারণে পরিবেশের ক্ষতি হোক।'
মা কালী ডায়িংয়ে বর্তমানে প্রতি সপ্তাহে গড়ে ৫ হাজার পাউন্ড সুতা রং করা হয়। তবে প্রতিষ্ঠানটির সপ্তাহে ৯ হাজার পাউন্ড সুতা রং করার সক্ষমতা রয়েছে।
এসইপির ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের (এনডিপি) তাঁত প্রকল্পের ব্যবস্থাপক মো. আশরাফুজ্জামান জানান, প্রকল্পের আওতায় দৈনিক ৩ হাজার, ৫ হাজার ও ১০ হাজার লিটার সক্ষমতার ইটিপির নকশা তৈরি করেছেন তারা। উদ্যোক্তাদের প্রয়োজন ও সক্ষমতা অনুসারে ইতিমধ্যে সিরাজগঞ্জে চারটি কারখানায় ছোট বা মিনি ইটিপি স্থাপনও করা হয়েছে।
তিনি বলেন, পণ্যের নিজস্ব ব্র্যান্ডিং এবং ব্যবসা ও পরিবেশ সনদ লাভ ইত্যাদি কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে।
পিকেএসএফের তথ্যমতে, সিরাজগঞ্জের তামাই ও বেলকুচি এলাকাতেই রয়েছে ছোট-বড় প্রায় ২৭৫টি ডায়িং ও প্রসেসিং মিল। প্রতিটি মিল থেকে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১ হাজার লিটার তরল বর্জ্য সৃষ্টি হচ্ছে, যা কোনো ধরনের পরিশোধন ছাড়াই চলে যাচ্ছে আশপাশের জলাশয়ে অথবা কারখানার পাশে কৃত্রিম জলাধারে। কখনও কখনও বোরিং করে এ দূষিত তরল পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরে। ফলে তাঁত অধ্যুষিত এলাকার ভূগর্ভস্থ পানিও হয়ে যাচ্ছে দূষিত ও পানের অযোগ্য। ফলে এ অঞ্চলের মানুষ বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
সিরাজগঞ্জ জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. আব্দুল গফুর টিবিএসকে বলেন, 'পুরো জেলায় ইটিপির ব্যবহার বাড়াতে কারখানা মালিকদের আমরা নিয়মিত কাউন্সেলিং করছি। আমরা প্রায় 40 জন উদ্যোক্তার সঙ্গে বৈঠক করেছি। পরিবেশ দূষণ করছে, এমন পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করছি।
'আমরা চাই সব প্রতিষ্ঠানে ইটিপি স্থাপন হোক। পরিবেশ দূষণ করে কোন প্রতিষ্ঠান করা যাবে না। এ ব্যপারে আমরা কঠোর আছি।'
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে এসইপি প্রকল্পের আওতায় নারায়ণগঞ্জ বিসিক শিল্পনগরীর জামদানি পল্লীতেও মিনি ইটিপি স্থাপন করা হচ্ছে। পিকেএসএফের সহযোগী সংগঠন সেবা নারী ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। ইতিমধ্যে একটি মিনি ইটিপি চালু হয়েছে। এর মাধ্যমে দৈনিক ৫ হাজার লিটার তরল বর্জ্য পরিশোধন করা হচ্ছে। প্রায় ৬০০ জন উদ্যোক্তা এই মিনি ইটিপির সুবিধা পাচ্ছেন।
মিনি ইটিপি তৈরি হওয়ায় তা শিল্প এলাকার পরিবেশ দূষণরোধে ভূমিরা রাখবে এবং উদ্যোক্তাদের স্বাস্থঝুঁকি কমবে বলে মনে করেন পিকেএসএফ কর্মকর্তারা।
পিকেএসএফের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফজলুল কবির টিবিএসকে বলেন, তারা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের নিয়ে কাজ করেন, সেই সঙ্গে ক্লাস্টার ডেভলপমেন্ট নিয়েও কাজ করেন।
'আমরা চাই এই উদ্যোক্তাদের পণ্য যেন মানসম্পন্ন হয়—এবং উন্নত পণ্য তৈরি করে যেন তারা লাভবান হন। আর যদি সাসটেইনেবিলিটি বজায় না রেখে পণ্য তৈরি হতে থাকে, তাহলে বাংলাদেশ একটা ভাগাড়ে পরিণত হবে। এজন্য আমরা সার্কুলার ইকোনোমিকে শক্তিশালী করতে কাজ করছি। আমরা বর্জ্যটাকে সম্পদে পরিণত করতে চাই।'
তিনি বলেন, 'আমরা একটি বিজনেস সলিউশন বের করেছি, যাতে মিনি ইটিপির বাণিজ্যিকীকরণ করতে পারি। সিরাজগঞ্জে আমরা প্রথমে উদ্যোক্তাদের কারিগরি সহায়তার আওতায় ঋণ দিয়েছি, প্রশিক্ষণ দিয়েছি। দেখা গেছে একজনের দেখাদেখি আরও তিনজন উদ্যোক্তা এটা তৈরি করছেন।
'আমরা আশা করছি যেখানে ক্লাস্টার আছে, সেখানে একটি মিনি ইটিপি চালু হবে। এটা একটা বিজনেস সলিউশন, প্রজেক্ট শেষ হলেও সারা দেশে এ কাজ চলবে।'
মিনি ইটিপি স্থাপন ও পরিচালন ব্যয়
উদ্যোক্তার প্রয়োজন ও সক্ষমতার ভিক্তিতে তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আলোকে প্রতিদিন ৩ হাজার লিটার, ৫ হাজার লিটার ১০ হাজার লিটার সক্ষমতার মিনি ইটিপি ডিজাইন করা হয়েছে। ব্যয় বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ৩ হাজার লিটার সক্ষমতার মিনি ইটিপি স্থাপনে ৭ লাখ টাকা, ৫ হাজার লিটার সক্ষমতার ইটিপি স্থাপনে ১২ লাখ টাকা এবং ১০ হাজার লিটার সক্ষমতার ইটিপি স্থাপনে ১৮ লাখ টাকা খরচ হয়।
৩ হাজার লিটার সক্ষমতার একটি মিনি ইটিপি পরিচালনায় মাসে প্রায় ৫ হাজার ৯০০ টাকা, ৫ হাজার লিটার সক্ষমতার ইটিপি পরিচালনায় ৯ হাজার ৪০০ টাকা এবং ১০ হাজার লিটার সক্ষমতাবিশিষ্ট ইটিপি পরিচালনায় প্রায় ১৫ হাজার ৮০০ টাকা খরচ হয়।