টেঁটাযুদ্ধ: যেভাবে একটি জনপদকে বদলে দিচ্ছে পুলিশ
তুচ্ছ সব ঘটনা নিয়ে দলবেঁধে দাঙ্গায় জড়ানো ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নতুন কিছু নয়। যুগ যুগ ধরে চলা এই দাঙ্গায় প্রতিপক্ষকে ঘায়েলে টেঁটার ব্যবহার বেশি দেখা যায়। তাই এটি টেঁটাযুদ্ধ নামে পরিচিত। তবে গত দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে পুলিশের নেওয়া কিছু পদক্ষেপে ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে দাঙ্গাপিড়ীত এই জনপদ। যার ফলে আগের চেয়ে প্রায় অর্ধেক কমেছে টেঁটাযুদ্ধ। সংঘাত থেকে শান্তির পথে ফিরছে টেঁটাযোদ্ধারা। এছাড়া দাঙ্গাপ্রবণ এলাকাগুলোতে ইতিবাচক কিছু পরিবর্তন এসেছে। এতে দাঙ্গা পুরোপুরি নির্মূলের তৈরি হয়েছে।
মূলত ২০২০ সালের শেষ দিকে প্রথমবারের মতো দাঙ্গা নির্মূলের উদ্যোগ ও বাস্তবায়নে কাজ শুরু করেন তৎকালীন পুলিশ সুপার মো. আনিসুর রহমান। বর্তমানে তিনি অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক পদে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে কর্মরত। বিট পুলিশিংয়ের মাধ্যমে টেঁটাযুদ্ধ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনেন আনিসুর রহমান।
মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে আনিসুর রহমান জানান, টেঁটাযুদ্ধকে তিনি মানুষের আর্থ-সামজিক উন্নয়নে বাধা মনে করেছিলেন। তাই এটি নির্মূলে বিট পুলিশিং কার্যক্রম জোরদার করার পরিকল্পনা করেন। দাঙ্গাপিড়ীত ইউনিয়নে একাধিক উপ-পরিদর্শক (এসআই) নিয়োগ করেন- যাদের কাজ ছিল ওই ইউনিয়নের গ্রামগুলোতে গিয়ে মানুষের সঙ্গে কথা বলা এবং অপরাধ বন্ধে মানুষকে সচেতন করা।
এছাড়া গ্রামগুলোতে কোনো ধরনের অপরাধ সংগঠিত হলে সংশ্লিষ্ট বিটের এসআইদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতেন আনিসুর রহমান।
পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, 'আমরা গ্রামগুলো বিভিন্ন বিটে ভাগ করেছিলাম। আর বিট পুলিশিং কার্যক্রমে মাঠে নামার আগে জেলা পুলিশ লাইনে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট বিটের কর্মকর্তাদের মৌলিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এরপর কর্মকর্তাদের মাঠে পাঠানো হয়। তাদের দায়িত্ব ছিল প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মানুষের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে তথ্য নেওয়া, কোনো মামলা থাকলে সেটির তদন্ত এবং গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকলে সেটি তামিল করা। এছাড়া একেকদিন একেকটি বাড়িতে বিট পুলিশিংয়ের সভা হতো। যেখানে জনপ্রতিনিধিসহ গ্রামের সাধারণ মানুষ অংশ নিতেন।'
তিনি বলেন, 'বিট কর্মকর্তারা প্রতিদিন ঠিকমতো গ্রামগুলোতে গিয়েছে কি না এবং সেখানে গিয়ে কী কী কাজ করেছে- সেগুলো আমরা তদারকি করেছি। গ্রামের লোকজনদের সঙ্গে বিট কর্মকর্তা যে সভা করতেন- সে সভাগুলোতে আমাদের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারাও থাকতেন, অনেক সময় আমিও যেতাম। আর না যেতে পারলে ভিডিও কনফারেন্সে কথা বলতাম। মানুষের যেসব সমস্যার কথা আমাদের জানানো হতো, আমরা সেগুলো সমাধান করতাম।'
তিনি আরও বলেন, 'টেঁটাযুদ্ধ বন্ধে বিট পুলিশিং কার্যক্রম পরিচালনায় কোনো ধরনের বাধা আসেনি। বরং স্থানীয় জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে সাধারণ নাগরিকদের সহযোগিতা পেয়েছি। বিট পুলিশিংয়ের মাধ্যমে আমরা মানুষকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলাম টেঁটাযুদ্ধের কারণে তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না। উল্টো তারা আইনি সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন এবং স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। এছাড়া মানুষকে সচেতন করার পাশাপাশি দাঙ্গা ব্যবহৃত দেশিয় অস্ত্র উদ্ধার অভিযানও চলমান ছিল। তবে কিছু কিছু দাঙ্গাপ্রবণ এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় পুলিশ ঘটনাস্থলে তাৎক্ষণিকভাবে যেতে পারে না। এতে অনেক সময় ছোট-খাটো ঝগড়া-বিবাদও বড় ধরনের দাঙ্গায় রূপ নিত।'
আনিসুর রহমান বলেন, 'বিট পুলিশিংয়ের কারণে দাঙ্গাপিড়ীত এলাকাগুলোতে ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ্য করেছিলাম। সাধারণ মানুষও বুঝতে পেরেছিলেন দাঙ্গায় তাদেরকে ব্যবহার করা হচ্ছে। দাঙ্গার পরিবেশ তৈরি হলে কিংবা কেউ দাঙ্গা সৃষ্টি করতে চাইলে সেই তথ্যগুলো আমরা স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে পেতাম। বিট পুলিশিং কার্যক্রম যদি আরও জোরদার করা যায়, তাহলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দাঙ্গা বা টেঁটাযুদ্ধ একটা সময় ইতিহাস হয়ে যাবে। কারণ, অপরাধ প্রতিরোধের জন্য বিট পুলিশিং খুবই কার্যকরী। কোনো পুলিশ কর্মকর্তা যখন একটি এলাকায় ঘুরবে, তখন তাকে দেখে কেউই অপরাধ করার সাহস দেখাবে না।'
আনিসুর রহমানের বদলি হওয়ার পর তার কাজের ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছেন বর্তমান পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শাখাওয়াত হোসেন। এর সাথে তিনিও দাঙ্গা নির্মূলে অভিনব কিছু ব্যবস্থা নিয়েছেন, যা দাঙ্গা প্রতিরোধে ভূমিকা রাখছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে গ্রামের হাট-বাজারের কামারদের পুলিশের অনুমতি ছাড়া কাউকে দেশিয় অস্ত্র তৈরি করে না দেওয়ার জন্য সতর্ক করা, কামারের কাছে কেউ টেঁটা বানাতে এলে তার নাম-ঠিকানা থানায় জমা দেওয়া ও টেঁটাযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের কোনো ধরনের আইনি সেবা না দেওয়া ইত্যাদি।
মূলত আধিপত্য বিস্তার ও জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ নিয়েই সবচেয়ে বেশি দাঙ্গা বাধে এ জেলায়। আর কোনো একটি ঘটনায় টেঁটাযুদ্ধে জড়িয়ে দুইপক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। টেঁটাযুদ্ধ চলাকালে এক পক্ষ আরেক পক্ষের লোকজনকে আঘাত করার পাশাপাশি ঘর-বাড়িতে ভাঙচুর, লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগও করে। আর যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ঘর-বাড়ি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হওয়া পরিবারগুলো পড়ে দুঃসহ যন্ত্রণায়। এছাড়াও মামলা সংক্রান্ত ভোগান্তি তো রয়েছেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যারা সরাসরি দাঙ্গায় অংশ নেন- তাদের অধিকাংশই স্বল্প শিক্ষিত। ফলে গোষ্ঠীর সর্দাররা তাদের সহজেই দাঙ্গায় ব্যবহার করতে পারেন। তবে পুলিশের সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডের ফলে দাঙ্গায় জড়ানো পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের পড়াশোনায় মনোযোগী করে তুলছেন। ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর হারও কমে আসছে। এছাড়া যারা দাঙ্গা সৃষ্টি করতে চায় বা দাঙ্গা বাধিয়ে আর্থিক সুবিধা নেয়- তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পুলিশকে তথ্য দিচ্ছেন স্থানীয়রা।
দাঙ্গাপ্রবণ এলাকাগুলোতে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে
নবীনগর উপজেলার দাঙ্গাপ্রবণ গ্রামগুলোর মধ্যে অন্যতম লক্ষ্মীপুর। এ গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়টিতে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর হার ধীরে ধীরে কমছে। লক্ষ্মীপুর (উত্তর) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২০২০ সাল পর্যন্ত ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর হার ছিল চার শতাংশ।
লক্ষ্মীপুর (উত্তর) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবু কাউসার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'কোনো দাঙ্গায় নিহতের ঘটনা ঘটলেই পুরো গ্রাম পুরুষশূন্য হয়ে পড়ত। ঘর-বাড়ি ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের কারণে শিশুদের আর পড়াশোনা করার মতো অবস্থা থাকত না। তবে এখন মানুষ উপলব্ধি করতে পারছে হানাহানিতে শুধু অশান্তি বাড়ে। তাই তারা শিক্ষায় মনোযোগী হচ্ছে। এতে আমাদের বিদ্যালয়ে ঝরে পড়া শিক্ষার হার আগের চেয়ে এক শতাংশ কমেছে। আগামী দুয়েক বছরের মধ্যে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর হার শূন্যে নেমে আসবে বলে আশা করছি।'
সরাইল উপজেলার অরুয়াইল ইউনিয়নের রাজাপুর গ্রামের বাসিন্দা শাহ আলম জানান, ২০২০ সালে তাদের গ্রামের দুই গোষ্ঠীর মধ্যে রাস্তা নিয়ে মারামারি হয়। ওই ঘটনায় মামলার আসামি হন তিনি। মামলার খরচ চালাতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছেন। এখন এলাকা ছেড়ে কক্সবাজারে থাকেন। সেখানে বাদাম বিক্রি করেই জীবিকা নির্বাহ করেন।
শাহ আলম বলেন, 'দাঙ্গায় যে আমাদের ব্যবহার করা হয়- সেটি আমরা এখন উপলব্ধি করতে পারছি। তাই এখন এসব থেকে সরে এসেছি। আমরা একমাত্র ছোট ভাই ফারহান লাবিবকেও পড়াশোনার জন্য নরসিংদী পাঠিয়ে দিয়েছি।
যেসব জায়গায় টেঁটাযুদ্ধ বেশি
জেলার নবীনগর উপজেলার লক্ষ্মীপুর, নূরজাহানপুর, বীরগাঁও, থানাকান্দি, গৌরনগর, সাহেবনগর এবং যশাতুয়া গ্রামে প্রতিবছর গড়ে দুই থেকে তিনটি করে বড় ধরনের দাঙ্গা বা টেঁটাযুদ্ধের ঘটনা ঘটে। অনেক সময় থেমে থেমে দুই থেকে তিনদিন পর্যন্ত চলে এসব এলাকার দাঙ্গা। ২০২৩ সালের বছরের গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সাহেবনগর এবং যশাতুয়া গ্রামে অন্তত তিনটি দাঙ্গার ঘটনা ঘটে।
এর মধ্যে সাহেবনগরের দাঙ্গায় একজন নিহত হন। এছাড়া দুই গ্রামের হওয়া দাঙ্গায় উভয় পক্ষের শতাধিক ঘর-বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর এবং লুটপাট চালানো হয়। তবে বছর তিনেক ধরে থানাকান্দি ও গৌরনগর গ্রামের বড় ধরনের কোনো দাঙ্গা বাধেনি।
এছাড়া সরাইল উপজেলার অরুয়াইল, রাজাপুর, পরমানন্দপুর এবং সরাইল সদরের কিছু এলাকায় ছোট-খাটো বিষয় নিয়ে দাঙ্গায় জড়ান বিভিন্ন গোষ্ঠীর লোকেরা। তবে এসব এলাকায় দাঙ্গা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও অভিযোগ রয়েছে- গ্রাম্য সর্দারদের অর্থের লোভের কারণে পুরোপুরি নির্মূল করা যাচ্ছে না।
পুলিশ বলছে, টেঁটাযুদ্ধ আগের চেয়ে অনেকাংশে কমে গেছে। তবে পুরোপুরি নির্মূল করা যাচ্ছে না গ্রাম্য সর্দারদের আধিপত্য ও অর্থলোভের কারণে। এছাড়া বর্তমানে টেঁটাযুদ্ধে তরুণদের অংশগ্রহণও কিছুটা উদ্বেগ তৈরি করছে।
যেভাবে টেঁটাযুদ্ধে জড়াচ্ছে তরুণরা
সরাইল উপজেলার অরুয়াইল ইউনিয়নের পরমানন্দপুর গ্রামের জিয়াউল আমিনের ছেলে নুহাশ বিন জিয়া। মাত্র ১৮ বছর বয়সেই তিনটি মামলার আসামি হয়েছেন এই তরুণ।
নুহাশ বিন জিয়া জানান, বছর দুয়েক আগে তার বাবার দুই চাচাত ভাই আক্তার এবং ফরিদের মধ্যে বাড়ির জায়গা নিয়ে বিরোধ তৈরি হয়। আক্তার ও ফরিদ আপন দুই ভাই। তাদের বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য সালিশ হয়। পরে আগের সেই বিরোধ চরম আকার ধারণ করে। এর মধ্যে ন্যায়সঙ্গত হওয়ায় ফরিদের পক্ষ নেন নুহাশের বাবা জিয়াউল আমিন। একপর্যায়ে উভয়পক্ষ সংঘর্ষে জড়ায়। গোষ্ঠীগত হওয়ায় বাবা-ভাইয়ের সঙ্গে নুহাশও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। এতে আক্তারের করা মামলায় বাবা জিয়াউল আমিন ও বড়ভাই রিফাত বিন জিয়ার সঙ্গে আসামি হন নুহাশ।
নুহাশ বলেন, 'গোষ্ঠীগত কারণে দাঙ্গায় জড়িয়েছিলাম। পরে আইয়ূব খান নামে গ্রামের এক সর্দারের ইন্ধনে আরও দুইটি মামলায় আমি ও আমার পরিবারের সদস্যদের জড়ানো হয়। এর মধ্যে আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরের বাসিন্দা মতি মিয়ার গোষ্ঠী এবং কাঞ্চন মিয়ার গোষ্ঠীর মধ্যে হওয়া মারামারির মামলাতেও আমাদের পরিবারের সদস্যদের আসামি করা হয়। যদিও আমরা ঘটনার সময় এলাকাতেই ছিলাম না। কিন্তু গ্রামের সর্দার আইয়ূব খানের ইন্ধনে আমাদের আসামি করা হয়। আক্তারের পক্ষ নিয়ে আইয়ূব খান ইন্ধন দিয়ে আমাদের আসামি করেছে।'
নুহাশ আরও বলেন, 'আক্তার মামলা করার পর ফরিদও পাল্টা মামলা করেন। এসব মামলা চালাতে আক্তার এবং ফরিদের প্রবাসে থাকা চার ছেলে টাকা পাঠাতেন। সেই টাকা দিয়েই মামলা চালানো হয়েছে। মামলায় জাড়ানোর পর থেকে আমি স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারছি না।
যে কারণে নির্মূল করা যাচ্ছে না টেঁটাযুদ্ধ
পুলিশ এবং ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মারামারি করা দুইপক্ষকেই প্রশ্রয় দেন গ্রামের সর্দাররা। এক্ষেত্রে মামলার খরচ বাবদ গোষ্ঠীর লোকজনের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা চাঁদা তোলা হয়। এছাড়া মামলা পরিচালনার অর্থের জোগান দিয়ে থাকে আসামিদের পরিবারের প্রবাসী স্বজনরা।
প্রবাসের স্বজনরা যে টাকার জোগান দেন, সেটির একটি প্রমাণও মিলেছে। নুহাশ প্রথমবার যে মামলায় আসামি হয়েছিলেন, সেই মামলা পরিচালনার জন্য উভয় মামলার বাদীদের ছেলেরা সৌদি আরব থেকে টাকা পাঠিয়েছিলেন বলে নিশ্চিত করেন নুহাশ।
যেভাবে সর্দার নির্ধারিত হয়
গ্রামের প্রত্যেক গোষ্ঠীতেই এক বা একাধিক সর্দার থাকেন। যিনি পুরো গোষ্ঠীর লোকজনকে নিয়ন্ত্রণ করেন তিনিই সর্দার। মূলত গোষ্ঠীর মধ্যে প্রভাবশালী এবং বয়োজ্যেষ্ঠকেই সর্দার মানা হয়। এছাড়া গোষ্ঠীর মধ্যে তুলনামূলক শিক্ষিত কেউ এবং গ্রামের স্কুল শিক্ষক ও রাজনৈতিক দলের নেতাও আছেন এই সর্দারদের তালিকায়। এলাকায় নিজের আধিপত্য বজায় রাখা এবং আর্থিক সুবিধা গ্রহণই সর্দারদের মূল লক্ষ্য।
সরাইল উপজেলার সমাজকর্মী মোহাম্মদ মনসুর আলী বলেন, 'ধীরে ধীরে দাঙ্গা কমছে। মানুষ তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য দাঙ্গার পথ থেকে সরে আসছেন। তবে এটি পুরোপুরি নির্মূল না হওয়ার নেপথ্যে আছেন গ্রাম্য সর্দাররা। তারা প্রতিটি দাঙ্গার ঘটনায় পুলিশ ও আইনজীবীর কথা বলে দুই পক্ষের কাছ থেকেই টাকা নেন। দাঙ্গা নির্মূলে সর্দারদের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন প্রয়োজন।'
আশানুরূপ হারে কমছে টেঁটাযুদ্ধ
পুলিশের সচেতনতামূলক পদক্ষেপে টেঁটাযুদ্ধ আগের চেয়ে প্রায় অর্ধেক কমেছে। ২০১৯ সালে ছোট-বড় মিলিয়ে জেলায় ২০টিরও বেশি টেঁটাযুদ্ধ হয়েছে। পরের বছর ১৬টি এবং ২০২১ সালে মাত্র চারটি বড় টেঁটাযুদ্ধের ঘটনায় মামলা হয়। এছাড়া ২০২২ সালে ১২টি এবং গত বছরের অক্টোবর পর্যন্ত পাঁচটি দাঙ্গা বা টেঁটাযুদ্ধের মামলা হয়েছে থানায়। মূলত সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডে মানুষের সাড়া দেয়ার কারণেই টেঁটাযুদ্ধ কমে আসছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
এছাড়া গত বছরের মাঝামাঝিতে টেঁটাযুদ্ধ বন্ধে পুলিশের টানা বিশেষ অভিযানে দাঙ্গাপ্রবণ এলাকাগুলো থেকে পাঁচ হাজারেরও বেশি দেশিয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়।
পুলিশের কার্যক্রমে দাঙ্গাপিড়ীত এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে যে পরিবর্তন এসেছে, সেটিকে ধরে রাখতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরও সহযোগিতা চাইছে জেলা পুলিশ।
সরাইলের পাকশিমুল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কাউসার হোসেন বলেন, 'আমরা যখন কোনো গ্রামে যাই কিংবা সালিশ বৈঠক করি, তখন এই দাঙ্গার কুফল সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করি। এটি যে মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার অবনতি ঘটায়- মানুষ ধীরে ধীরে সেটি বুঝতে পারছে। যখনই কোনো ধরনের দাঙ্গা বা অপরাধের খবর পাই সেটি থানায় জানিয়ে দেই।'
জেলা পুলিশের দেওয়া তথ্যমতে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ৯টি থানায় ২০১৯ সাল থেকে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫২টি দাঙ্গা বা টেঁটাযুদ্ধের মামলা হয়েছে। এসব মামলার আসামি সংখ্যা প্রায় চার হাজার।
নাসিরনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সোহাগ রানা বলেন, 'পুলিশ অনেক আগে থেকেই দাঙ্গা বন্ধে কাজ করছিল। সময়ের সাথে সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড আরও বেগবান হয়েছে। ফলে দাঙ্গায় জড়ালে আর্থিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি মামলার আসামি হয়ে দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়, এটি মানুষ এখন বুঝতে পারছে। পরিবারে যারা পড়াশোনা করছে তারা দাঙ্গার কুফল সম্পর্কে পরিবারের অন্যদের অবগত করছে'।
তবে টেঁটাযোদ্ধাদের জন্য যারা টেঁটা বানাতেন, সেইসব কামারদের আয়ে কিছুটা ভাটা পড়েছে। পুলিশের নির্দেশনায় টেঁটা বানানো বন্ধ রেখেছেন তারা। এতে আয় কমলেও পুলিশ তাদের কোনো ধরনের সহযোগিতা ব্যবস্থা করেনি বলে জানান কয়েকজন কামার। তবে আয় কমলেও টেঁটাযুদ্ধ কমায় তারা খুশি।
সরাইলের অরুয়াইল বাজারের সঞ্জীব কর্মকার জানান, আগে প্রতিদিন অন্তত ৮-১০টি করে টেঁটা বানাতেন। এতে দিনে এক থেকে দেড় হাজার টাকা আয় হতো। কিন্তু পুলিশের নিষেধাজ্ঞার কারণে গত এক বছর ধরে তার দোকানে টেঁটা বা কোনো ধরনের দেশিয় অস্ত্র বানানো হয় না। এতে তার আয় কমেছে।
এদিকে সম্প্রতি টেঁটাযুদ্ধ বন্ধে মসজিদভিত্তিক প্রচারণা শুরু করেছে জেলা পুলিশ। স্ব স্ব থানা পুলিশ মসজিদে গিয়ে জুমার নামাজের খুতবায় টেঁটাযুদ্ধ এবং মাদকের কুফল সম্পর্কে মসজিদের ইমামদের দিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন।
সরাইলের আরিফাইল শাহী জামে মসজিদের ইমাম আব্দুল মজিদ বলেন, 'পুলিশ জুমার নামাজে এসে মুসল্লিদের সচেতন করছে। আমরাও তরুণদের সচেতন করছি।'
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শাখাওয়াত হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'কোনো একটি জনপদে দাঙ্গা চলতে থাকলে কোনোভাবেই সেখানকার মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। এজন্য সচেতনতা জরুরি। আমরা পুলিশের তরফ থেকে সে কাজটিই করে যাচ্ছি।'
তিনি আরও বলেন, 'অপরাধ দমনে বিট পুলিশিংয়ের কার্যক্রমও জোরালোভাবে চলছে। এছাড়া মসজিদ ভিত্তিক প্রচারণায় মুসল্লি এবং তরুণদের কাছ থেকে ভালো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। আমরা দাঙ্গায় সহায়তাকারী সর্দারদের তালিকা তৈরি করছি। তাদের বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। অনকে সর্দারদের লোভের বিষয়টি বুঝতে পারছে। ফলে নিজে থেকেই তারা দাঙ্গা থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরছে।'