তীব্র শীতে আলু ও বোরোর বীজতলায় পচন ধরছে, ক্ষতির আশঙ্কায় কৃষকেরা
টানা কয়েকদিনের তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশার কারণে সারাদেশেই আলু ও বোরো ধানের বীজতলা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। এতে করে আলুতে কৃষকদের লেট ব্লাইট বা নাবী ধ্বসা রোগ ও বোরোর বীজতলায় চারা পচে যাচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষক ও কৃষি গবেষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশের উত্তরাঞ্চলের কোথাও কোথাও তাপমাত্রা ব্যপক কমে যাওয়া এবং রোদ না থাকাটা ফসলের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর একটি বড় কারণ হলো শীত সহিষ্ণু ভ্যারাইটি না থাকা।
কৃষি বিভাগ বলছে, জানুয়ারীর প্রথম থেকেই তীব্র শীত অনুভুত হলেও সপ্তাহখানেকের বেশি সময় শৈত্যপ্রবাহ ও প্রচন্ড ঠান্ডার কারণে দেশের উত্তরাঞ্চলে তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রী বা তারও নিচে নেমে যায়। এমনকি গত বৃহষ্পতিবার দিনাজপুরের তাপমাত্রা ৮ ডিগ্রিতে নেমে আসে। এর প্রভাবে সারাদেশেই কৃষি জমিতে রোগবালাইয়ের আক্রমণের প্রকোপ বাড়ছে।
জয়পুরহাট জেলা আলু উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। এই জেলায় চলতি বছর ৩৮ হাজার ৯৫০ হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ করেছেন কৃষকেরা। কিন্তু গত কয়েকদিনের শীতের তীব্রতায় আলু থেকে লাভ নিয়ে তারা শঙ্কায় পড়েছেন। কারণ অনেক কৃষকের জমিতেই আলুর গাছে লেট ব্লাইট রোগের কারণে পঁচন ধরেছে। কৃষকরা নিয়মিত ওষুধ দিয়েও আক্রান্ত গাছগুলো টিকিয়ে রাখতে পারছেন না।
জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার তেলিহারা গ্রামের কৃষক মমতাজ উদ্দিন বলেন, "দেড় একর জমিতে আলু লাগিয়েছি। ঠান্ডার কারণে সপ্তাহে তিন বার করে ওষুধ ছিটাতে হচ্ছে। কিন্তু কাজ হচ্ছে না। গাছ পচে যাচ্ছে।"
জয়পুরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক রাহেলা পারভীন বলেন, "হঠাৎ করেই শীতের প্রকোপ বেড়ে গেছে। তাপমাত্রাও অনেক কমে গেছে। এতে করে আমাদের জেলার ফসল বিশেষ করে আলুতে একটু সমস্যা হয়েছে। আমরা এজন্য আলুর জমিতে ওষুধ প্রয়োগসহ নানা রকম পরামর্শ দিচ্ছি চাষীদের। আশা করছি বড় কোনো সংকট দেখা দিবে না।"
একই চিত্র দেখা গেছে বগুড়া, রংপুর, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ ও নওগাঁতেও। বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আব্দুস সোবহান বলেন, "এবার জেলায় ৫৫ হাজার ২৬০ হেক্টর জমিতে আলুর চাষ হয়েছে। শীতের কারণে এখন পর্যন্ত ১৬৬ হেক্টর জমির আলু আক্রান্ত হয়েছে। এছাড়া শীতে বোরো বীজতলার সাড়ে ১৩ হেক্টর, শাকসবজি ২১ হেক্টর ও ৬ হেক্টর জমির মরিচ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাপমাত্রার কমবেশিতে লেট ব্লাইট এবং অল্টারনেরিয়া ব্লাইট নামে বিভিন্ন ফসলেও রোগ দেখা দিচ্ছে।"
বীজতলার চারাও মরে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে বগুড়ায়। কাহালু উপজেলার এরুল গ্রামের আলু চাষী জাহিদুল ইসলাম বলেন, "আলুর খেতে ছত্রাকনাশক ওষুধের পেছনে বেশি খরচ করতে হয়। জমি ভেদে তিন থেকে পাঁচ বার এই ওষুধ দিয়ে থাকে কৃষকরা। আমার জমিতে আলু তোলার আগ পর্যন্ত তিন হাজার টাকার মতো খরচ হয়। এবার এটি ৯-১০ হাজার টাকাও হতে পারে।"
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রেও বোরোর বীজতলায় চারা মরে যাবার খবর পাওয়া গেছে। পবা উপজেলার হরিয়ান ইউনিয়ন এলাকার কৃষক মাসুদ জানান, কয়েকদিনের তীব্র শীত আর ঘন কুয়াশার কারণে ধানের চারার পাতা মরে যাচ্ছে। পুরো বীজতলায় এমন হচ্ছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে বীজতলা পুরো নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
এই পরিস্থিতিতে কৃষি মন্ত্রণালয় বোরো ধানের বীজতলায় ৩ থেকে ৫ সেন্টিমিটার পানি ধরে রাখা, বীজতলা রাতে স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখার পরামর্শ দিচ্ছে। এ সময় আলুতে লেট ব্লাইট রোগ এবং সরিষায় অলটারনারিয়া ব্লাইট রোগ দেখা দিতে পারে বলে সতর্ক করা হয়েছে। আলুতে ৭ থেকে ১০ দিন পর পর অনুমোদিত মাত্রায় ম্যানকোজেব গোত্রের ছত্রাকনাশক স্প্রে করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
গবেষণার ঘাটতি; নেই শীত সহিষ্ণু ভ্যারাইটি
ধানের ভ্যারাইটি উদ্ভাবনে নিয়মিত গবেষণা করে জাত উদ্ভাবন করছে বাংলাদেশ রাইস রিসার্স ইনস্টিটিউট (ব্রি) ও বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট (বিনা)। দুটি প্রতিষ্ঠানই গবেষণা করে লবণাক্ততা সহিঞ্চু, খরা সহিঞ্চু, জলমগ্নতা সহিঞ্চু ভ্যারাইটি উদ্ভাবন করলেও এখনও পর্যন্ত কার্যকরী শীত সহিঞ্চু ও উচ্চ তাপ সহনশীল কোন জাত আমাদের নেই। তবে এই ধরনের ভ্যারাইটি উদ্ভাবনে দুটি প্রতিষ্ঠানই কাজ করছে।
গবেষকরা জানান, বাংলাদেশে বর্তমানে ধানের যে জাতগুলো রয়েছে সেগুলো ৩০ ডিগ্রীর বেশি তাপমাত্রায় উপযোগী নয়। একইভাবে তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রী বা তার নিচে নেমে গেলে তার উপযোগী ভ্যারাইটিও আমাদের নেই।
তবে ব্রি দাবি করছে, ব্রি-ধান ৩৬ ও ব্রি-ধান ৪৫ জাত দুটি শীত সহিঞ্চু। কিন্তু এগুলো কার্যকরীভাবে মাঠ পর্যায়ে বাজারজাত কোন উদ্যোগ নেই। তবে প্রতিষ্ঠানটি হাওড়ের জন্য বিশেষ একটি কোল্ড টলারেন্ট জাত উদ্ভাবনের জন্য কাজ করছে।
গবেষকরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এখন হঠাৎ করেই শীতের তীব্রতা বাড়ছে। আবার গরমকালে তাপমাত্রা অতিরিক্ত বেড়ে যাচ্ছে। জনজীবনের পাশাপাশি এখন কৃষিতেও এ প্রভাব স্পষ্টতই তীব্র হয়ে উঠেছে। এই অবস্থা থেকে বের হতে হলে অবশ্যই দরকার শীত সহিষ্ণু এবং উচ্চ তাপ সহনশীল ভ্যারাইটি। এটা শুধু ধানের ক্ষেত্রেই নয়, অন্যান্য ফসলের জন্যও দরকার।
এ বিষয়ে বিনার ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "রাইসের জিনোম সিকোয়েন্স করা হয়েছে। এখন আমরা দ্রুত শীত সহিঞ্চু এবং উচ্চতাপ সহনশীল জাতের ধান উদ্ভাবন করতে পারবো। ইতোমধ্যেই আমাদের গবেষকরা এটা নিয়ে কাজ করছেন।"
তিনি জানান, তীব্র ঠান্ডার এই পরিস্থিতিতে যদি কোন ধানের চারা দুর্বল হয় তাহলে সেটা টিকবে না। এর জন্য ভালো চারা লাগবে। আবার চারা লাগানোর পর যদি সেটা তিন-চারদিনের মধ্যে টিকে থাকতে না পারে তাহলে ধানের উৎপাদন ক্ষতির মুখে পড়বে। তবে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য কোল্ড টলারেন্ট ভ্যারাইটি খুবই প্রয়োজন, যেটা এখনো আমাদের নেই।