বগুড়ার সরকারি হাসপাতালগুলোতে চাহিদামতো ওষুধ পাচ্ছেন না রোগীরা
সার্ভিক্যাল স্পন্ডিলাইটিস (ঘাড় ও স্নায়ুর সমস্যা) সমস্যা নিয়ে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে (শজিমেক) গত বছরে চিকিৎসা নিতে যান বেসরকারি চাকরিজীবী আসাফ-উদ-দৌলা নিওন। চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্রে কয়েকটি ওষুধের নাম লিখে দেন। হাসপাতালে থেকে এসব ওষুধ পাওয়ার কথা বলেন চিকিৎসক নিজেই। কিন্তু হাসপাতালের ওষুধ নিতে গেলে তারা জানায় ব্যবস্থাপত্রে লেখা সব ওষুধ গত দুই মাস ধরে নেই।
পরে বাধ্য হয়ে নিওন হাসপাতালের বাইরে ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনেন। নিওন বলেন "এই ঘটনা এক দিনের কিংবা আমার ক্ষেত্রেই শুধু নয়। এখানে চিকিৎসা নিতে আসা ৯৫ ভাগ রোগীরা ওষুধ পান না।"
তবে হাসপাতালে ওষুধ সরবরাহে তেমন কোনো ঘাটতি থাকে না বলে দাবি করেন বগুড়ার শজিমেকের উপপরিচালক আব্দুল ওয়াদুদ। এই চিকিৎসকের দাবি, অনেক সময় সরকারি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এসেনশিয়াল ড্রাগ কোম্পানি লিমিটেড (ইউসিএল) ওষুধ সরবরাহে বিলম্ব করে। অর্থাৎ এক মাসের চাহিদাপত্রে চাওয়া ওষুধ অন্য কোনো এক মাসে দিয়ে পূরণ করে। এ কারণে কিছু ক্ষেত্রে রোগীরা হাসপাতাল থেকে চাহিদামতো ওষুধ পান না।
দেশের একমাত্র সরকারি ওষুধ তৈরির প্রতিষ্ঠান ইডিসিএল ১৩৭ রকমের ওষুধ তৈরি করে। যা প্রতিবছর দেশের সরকারি হাসপাতালসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে চাহিদার প্রায় ৭২ শতাংশ।
সরকারি হাসপাতালে ও কমিউনিটি ক্লিনিকে মানুষ বিনামূল্যে যে ওষুধ পায়, তা মূলত ইডিসিএল উৎপাদিত। বগুড়ায় প্রতিষ্ঠিত ইডিসিএল বছরে প্রায় ৭০০ কোটি টাকার ওষুধ সরবরাহ করে। এরমধ্যে ইডিসিএলের নিজস্ব কারখানায় বছরে ৫০০ কোটি টাকার ওষুধ তৈরি হয়। আর প্রায় ৩০ শতাংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে তৈরি করানো হয়।
রাজশাহী, রংপুর ও খুলনা বিভাগের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় সরকারি সব হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে ওষুধ সরবরাহ করা হয় বগুড়ার ইডিসিএল থেকে। সরকারি হাসপাতালের বরাদ্দের ৭৫ শতাংশ ওষুধ ইডিসিএল থেকে কেনার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সেই অনুযায়ী সরকারি হাসপাতালগুলো ইডিসিএলের সাথে চুক্তিও করে।
সম্প্রতি পেট খারাপ ও বমি নিয়ে নওগাঁ সদর হাসপাতালে শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি করানো হয় ভীমপুর গ্রামের রাফসান মাহবুবকে (৪)। তার মা রিপা সুলতানা বলেন, "আমার ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে ৫ দিন ভর্তি ছিলাম। চিকিৎসকেরা ঠিকমতো দেখাশোনা করেছেন। তারা প্রয়োজনীয় ওষুধ লিখে দেন। হাসপাতাল থেকে পাওয়ার কথাও বলেন। কিন্তু হাসপাতাল ওষুধ নিতে গেলেই কর্তৃপক্ষ বলে ওষুধ নেই। আর স্যালাইন ও গ্যাসেট ট্যাবলেট সরকারিভাবে সাপ্লাই নেই। পরে বাধ্য হয়ে বাহিরে থেকে কিনতে হয়।"
২৫০ শয্যা নওগাঁ জেনারেল হাসপাতালটির তত্ত্বাবধায়ক ডা. জাহিদ নজরুল চৌধুরী বলেন, "২০২২-২৩ অর্থ বছরে ইডিসিএলের কাছে ৫ কোটি ১৭ লাখ ৬৩ হাজার টাকার ওষুধ চাওয়া হয়। কিন্তু তারা আমাদের ৫ কোটি ৬২ হাজার টাকার ওষুধ দেয়। আগের বছরগুলোতেও শতভাগ ওষুধ ইডিসিএল সরবরাহ করতে পারেনি। সে ক্ষেত্রে আমাদের হিসাব করে ওষুধ রোগীদের মাঝে বিতরণ করতে হয়।"
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইডিসিএলের একটি সূত্র জানায়, জেলা সদরের চেয়ে উপজেলার হাসপাতালগুলো কম ওষুধ পায়। সে কারণে এই অঞ্চলের রোগীরাও কম ওষুধ পান। বেশি শীত ও বেশি গরমে রোগীর চাপ বাড়ে। তখন হাসপাতালের চাহিদামতো খাবার স্যালাইন, আইভি স্যালাইন, ওমিপ্রাজল ক্যাপসুল, বিভিন্ন গ্রুপের ইনজেকশন সরবরাহ করা সম্ভব হয় না।
বগুড়ার গাবতলী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গত তিন বছর ধরে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার দায়িত্বে রয়েছেন ডা. শাহরিমা পারভীন। তিনি বলেন, আমরা প্রতি বছর ইডিসিএলকে ওষুধের যে চাহিদা দিই, তার শতভাগ কখনই তারা পূরণ করতে পারে না।
বগুড়ার যমুনা নদীর কোল ঘেঁষে সারিয়াকান্দি উপজেলা। চরাঞ্চল বেষ্টিত উপজেলা হওয়ার কারণে সারিয়াকান্দির মানুষ একমাত্র সরকারি হাসপাতালের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু সেখানকার রোগীদের অভিযোগ, হাসপাতালে গেলে তারা বিনামূল্যের ওষুধ ঠিক মতো পান না।
উপজেলার চালুয়াবাড়ি ইউনিয়নের সুজালের চরের বাসিন্দা আতিয়ার রহমান বলেন, 'আমরা চরের মানুষ। বিপদের একমাত্র ভরসা উপজেলা হাসপাতাল। এখানে আমরা এখন যাই শুধু ডাক্তারকে দেখিয়ে প্রেসক্রিপশন করে নেওয়ার জন্য। ওষুধ পাই না বলে হাসপাতালে আর খুঁজিও না। বাহিরের দোকান থেকেই কিনে খাই।'
ধুনট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা দিবাকর বসাক বলেন, "তারা স্যালাইন ঠিক মতো তারা সরবরাহ করতে পারেনি। প্রয়োজনের খাতিরে আমরা চাইলেও তা বাহিরে থেকে কিনতে পারি না।"
বগুড়ার শিবগঞ্চ পৌরসভার বাসিন্দা রবিউল ইসলাম বলেন, "ওষুধ সরবরাহ আগের চেয়ে বেড়েছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদ পাওয়া যায়। কিন্তু হাসপাতালে গেলে এর প্রয়োজনীয় ওষুধ পাওয়া যায় না।
বগুড়ার শিবগঞ্চ উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দায়িত্বশীল এক কর্মকতা নাম প্রকাশ না করার জানান, "ইডিসিএল ভেঙে ভেঙে ওষুধ দেয়। তাই চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে সব ওষুধ সরবরাহ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না।"
বগুড়ায় ইডিসিএলের সরবরাহে কী পরিমাণ ওষুধের ঘাটতি আছে সেই তথ্য সামগ্রিকভাবে কারও কাছে নেই বলে দাবি করেন জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ শফিউল আজম। এই কর্মকর্তার দাবি, ওষুধ ক্রয়ের বিষয়টি উপজেলা হাসপাতালগুলোর একক ক্ষমতা। এখানে আমাদের কাছে কোনো তথ্য থাকে না।
তবে খাবার স্যালাইন বাদে অন্য সব ওষুধ শতভাগ সরবারের দাবি করেছেন বগুড়া এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডডের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার ও প্লান্ট প্রধান মো. মনিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, "অন্যান্য ওষুধের ক্ষেত্রে সরবরাহে তেমন সমস্যা হয় না। তবে স্যালাইনের সংকট রয়েছে। স্যালাইন ঢাকা থেকে এনে আমরা সাপ্লাই দিই। স্যালাইন বাদ দিয়ে অন্যান্য ওষুধ আমরা শতভাগ সাপ্লাই দিতে পারি। তবে সম্প্রতি ডলার সংকট হওয়ার কারণে কাঁচামাল আমদানি করা সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে কিছুটা সমস্যা হয়েছে।"
তিনি আরও বলেন, "সরকারি হাসপাতালে যে পরিমাণ ওষুধ আমরা সাপ্লাই দিই ঠিক তার বিপরীতে বিল করি। ওষুধ সরবরাহে ঘাটতি হলে কোনো হাসপাতাল আবেদন করলে অনেক সময় আমরা তাদের অনাপত্তি দিয়ে থাকি। আমাদের অনাপত্তি না নিয়ে কোনো হাসপাতাল বাহিরে থেকে ওষুধ কিনতে পারবে না।"