২০২৩ সালের প্রথম নয়মাসে ব্যাংকগুলোর ঋণ পুনঃতফসিল বেড়েছে ৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা
গত বছরের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ব্যাংকগুলো তাদের খেলাপি ঋণের ১৮ হাজার ৮১১ কোটি টাকা পুনঃতফসিলে করেছে যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৬৩ শতাংশ বা ৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা বেশি৷ বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ৫১১ কোটি টাকা।
যদিও ব্যাংকগুলো ২০২২ সালের (অক্টোবর-ডিসেম্বর) শেষে প্রান্তিক ঋণ পুনঃতফসিল করেছিল ১৭ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা। একই প্রান্তিকে সেই সময়ে অধিক পরিমাণে ঋণ পুনঃতফসিলের কারণে খেলাপি ঋণ কমেছিল প্রায় ১৩ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা।
ব্যাংকাররা বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ব্যাংকগুলোর ঋণ পুনঃতফসিলের ক্ষমতা ব্যাংকগুলোকে দিয়েছে। এরপর থেকে প্রতি প্রান্তিকে গড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি পুনঃতফসিল বেড়েছে। যদিও আগে গড়ে ২-৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল হতো।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, এখন ঋণ পুনঃতফসিলে অনেক সুবিধা রয়েছে। মাত্র ২-৪ শতাংশ ডাউন পেমেন্টের মাধ্যমে ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরের পর থেকে। আগে কোন কোন গ্রাহক থেকে ৮-১০ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট নেয়া হতো।
তিনি আরও বলেন, "এখন গ্রাহক ব্যাংকের সঙ্গে সমন্বয় করেই ঋণ পুনঃতফসিল করে নিচ্ছে। একসময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে গিয়ে অনুমতির জন্য অপেক্ষা করতে হতো।"
কমেছে সুদ মওকুফের হার
২০২৩ সালে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) ব্যাংকগুলো গ্রাহকের ঋণ পুনঃতফসিল করতে গিয়ে সুদ মওকুফ করেছে ৭৪৪ কোটি টাকা। যদিও ২০২২ সালের একই সময়ের তুলনায় ব্যাংকগুলোর ঋণের সুদ মওকুফ কমেছে ২ হাজার ৪২১ কোটি টাকা। সেই সময়ে ব্যাংকগুলো ঋণের সুদ মওকুফ করেছে ৩ হাজার ১৬৫ কোটি টাকা।
রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক টিবিএসকে বলেন, বর্তমানে ব্যাংকের কাছে ক্ষমতা থাকায় পুনঃতফসিল বাড়ছে। যদিও ২০২২ সালের ডিসেম্বরে সুদ মওকুফের হার অস্বাভাবিকভাবে বাড়ার কারণ সেই প্রান্তিকেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ক্ষমতা ব্যাংকের হাতে দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, "ঋণের কি পরিমাণ সুদ মওকুফ করা যাবে তা স্পষ্ট করে দেওয়ায় ঋণের সুদ মওকুফ কমে এসেছে।"
পলিসি রিসার্চ ইনিস্টিটিউটের (পিআরই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর টিবিএসকে বলেন, "পুনঃতফসিল ও সুদ মওকুফ আমাদের একটা কালচারে পরিণত হয়েছে। কোভিডের সময়ে বহু ঋণ বিতরণ হয়েছে। এগুলো ফেরত আসছে কিনা তা খতিয়ে দেখা দরকার।"
তিনি বলেন, "কেউ দুর্নীতির আশ্রয় নিলে তার প্রভাব অন্য ভালো গ্রাহকের উপরেও পরে। একজনের দুর্নীতির বোঝা অন্যজনকে বহন করতে হয়। দুর্নীতির লোকসান পূরণ করতে আমানতকারীদের মুনাফায় প্রভাব পড়ে। এভাবে চলতে থাকলে ব্যাংকের আর্থিক সক্ষমতা কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।"
তিনি আরো বলেন, অনেকসময় গ্রাহক বিবেচনা করে ছোট ও মাঝারি গ্রাহকদের সুদ মওকুফ করা হয়। এটা যুক্তিযুক্ত। কিন্তু সুদ মওকুফের নামে কেউ অবৈধ সুবিধা নিচ্ছে কিনা সেটা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে যাচাই করে দেখতে হবে। তা না হলে নীতি নির্ধারণ করতে সমস্যা হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ করা রিপোর্টে দেখা যায়, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষে দেশের ব্যাংকখাতের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লক্ষ ৫৫ হাজার কোটি টাকা যা মোট ঋণের ৯.৯৩ শতাংশ। এছাড়া ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষে ব্যাংকগুলোর ঋণ পুনঃতফসিলের পরিমাণ দাড়িয়েছে ২.১৭ লক্ষ কোটি টাকা।
একই সময়ে ব্যাংকগুলোর অর্থঋণ আদালতে আটকে থাকা ঋণের পরিমাণ হলো ২.১২ লক্ষ কোটি টাকা। এছাড়া ব্যাংকগুলোর রাইট-অব করা ঋণের পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক আইএমএফের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, ২০২৬ সালের মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য গড় এনপিএল ১০ শতাংশ এবং বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলির জন্য ৫ শতাংশের নিচে কমিয়ে দেওয়া হবে।
যদিও বর্তমানে ব্যাংকখাতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২১ শতাংশ এবং বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ টিবিএসকে বলেছেন, "ব্যাংকগুলোর এক প্রান্তিকে পুনঃতফসিল বাড়ছে-কমছে এটা বড় বিষয় নয়। কথা হচ্ছে, একজন গ্রাহককে যে পরিমাণ ছাড় দেয়া যায় তার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি সুবিধা দেওয়া হয়। যার কারণে ব্যাংকগুলোর আর্থিক সুচকগুলো দিনদিন খারাপ অবস্থানে যাচ্ছে।"
তিনি আরো বলেন, "একজন গ্রাহককে ঋণ দেওয়ার আগে তার রিপেমেন্ট যোগ্যতা, কমপিটিটেন্সসহ নানা দিক দেখতে হয়। ব্যাংকগুলো এগুলো না দেখে যাকে ইচ্ছা ঋণ দিচ্ছে। আর্থিক শৃঙ্খলা আনতে নীতি নির্ধারক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আগ্রহ দেখছি না।"