সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কাজ পেতে এক্সনমবিলকে দরপত্রে অংশ নিতে হবে: জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী
গভীর ও অগভীর সমুদ্রে তেল, গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য আগামী মার্চ মাসের প্রথমভাগে দরপত্র আহ্বান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। এই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে তেল গ্যাস অনুসন্ধানকারী আন্তর্জাতিক একাধিক সংস্থা সরকারের প্রতিনিধিদের সাথে যোগাযোগও শুরু করেছে।
তারই ধারাবাহিকতায় গতকাল (মঙ্গলবার) বিকালে গভীর সমুদ্রে তেল গ্যাস অনুসন্ধানকারী যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এক্সনমবিল-এর দুজন প্রতিনিধি জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের সাথে বৈঠক করেছেন।
এক্সনমবিলের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। মার্কিন কোম্পানিটির দেয়া আগের প্রস্তাবের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, "আগের প্রস্তাবের দিকে তো আমরা যাচ্ছিই না। যেহেতু আমরা বিডিং করতে যাচ্ছি। মার্চের প্রথম সপ্তাহে বিডিং শুরু হবে। এক্সন মবিলকে দরপত্রে অংশ নিতে আহ্বান জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে তারা আগ্রহী কি-না সেটি আমাদের জানাবে বলেছে। তবে বর্তমানে তারা বাংলাদেশে বিনিয়োগে ব্যাপকভাবে আগ্রহী।"
এ বিষয়ে জ্বালানি সচিব নূরুল আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে (টিবিএস) বলেন, "প্রথম কোম্পানি হিসেবে এক্সনমবিল আনুষ্ঠানিকভাবে বিডিং এ অংশ নেওয়ার জন্য আগ্রহ দেখালো। আগামী মাসের শুরুতেই গভীর সমুদ্রে তেল গ্যাস অনুসন্ধানে দরপত্র আহ্বান করা হবে।"
জ্বালানি সচিব জানান, এর বাইরে অনানুষ্ঠানিকভাবে মার্কিন কোম্পানি শেভরন দরপত্রে অংশ নেওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছে। দরপত্র আহ্বানের পর ৬ মাস সময় নেওয়া হবে দরপত্র মূল্যায়নের জন্য।
বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ কর্পোরেশনের (পেট্রোবাংলা) চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার টিবিএসকে বলেন, "মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে বিড ওপেন করা হচ্ছে। যোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে বিডে অংশ নেয় সেজন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে প্রচারণা চালানো হবে। এমনকি রোড শোও করা হবে।"
পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান বলেন, "ইতিমধ্যে তেল গ্যাস অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক বড় বড় কোম্পানি আগ্রহ দেখিয়েছে। দরপত্রের পর কতগুলো কোম্পানি অংশ নিলো তা জানানো হবে।" তবে কতগুলো ব্লকের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হবে সে বিষয়ে কিছু বলতে চাননি তিনি।
সমুদ্রে তেল গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য সরকার ইতিমধ্যে 'বাংলাদেশ অফসোর মডেল প্রোডাকশন শেয়ারিং কনট্রাক্ট (পিএসসি)-২০২৩' অনুমোদন করেছে। গত বছরের ২৬ জুলাই অনুষ্ঠিত অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি তেল, গ্যাস অনুসন্ধান বিষয়ক চুক্তির এই নীতিমালা অনুমোদন করে।
ওই নীতিমালায় বলা হয়েছে, সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানকারী কোম্পানির কাছ থেকে সরকার গ্যাস কিনবে। প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের দাম হবে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত জ্বালানির তেলের প্রতি ব্যারেলের বাজারমূল্যের ১০ ভাগ। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বাজারে এক ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেল ১০০ ডলারে বিক্রি হলে সরকার গ্যাস উত্তোলনকারী কোম্পানিকে প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের দাম দেবে ১০ ডলার।
পলিসিতে আরও বলা হয়, বাজারে দাম বাড়লে সরকারের ব্যয় বাড়বে। আর কমলে ব্যয় কমবে। তবে এখানে মোট উত্তোলিত গ্যাসের একটি অংশ সরকার বিনামূল্যে পাবে। কত অংশ বিনামূল্যে পাবে সেটা নির্ভর করবে উত্তোলনকারী বা অনুসন্ধানকারী কোম্পানি ও সরকারের মধ্যে দরকষাকষির মাধ্যমে।
অগভীর ও গভীর সমুদ্র উভয় ক্ষেত্রেই গ্যাসের দাম সমান হবে। একইসাথে গতবছর সমুদ্র সীমায় কী পরিমাণ সম্পদ রয়েছে তা জানার জন্য মাল্টি ক্লায়েন্ট সার্ভে করা হয়েছে।
কমে গেছে গ্যাস সরবরাহ
এদিকে দেশের ভেতরে অবস্থিত গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে গ্যাসের সরবরাহ কমছে। পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের কূপগুলো থেকে দৈনিক গড়ে ২০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে। আর আমদানি করা এলএনজি থেকে দৈনিক ৬০ কোটি ঘনফুট থেকে ৬৫ কোটি ঘনফুট পর্যন্ত সরবরাহ করা হচ্ছে।
দেশে গ্যাসের চাহিদা দিনদিন বাড়ছে। শিল্প খাতের পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিপুল গ্যাসের প্রয়োজন হচ্ছে। দেশে বর্তমানে যতগুলো গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে, সেগুলো সব একসাথে চালাতে হলে দৈনিক ২৩০ কোটি ঘনফুট গ্যাস দরকার। এর বাইরে শিল্প ও আবাসিক খাতের চাহিদা রয়েছে।
পেট্রোবাংলার হিসাব মতে, দেশে গ্যাসের চাহিদা প্রতিদিন প্রায় ৪,০০০ মিলিয়ন ঘনফুট। কিন্তু গড় সরবরাহ মাত্রা ২৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট। যার মধ্যে আবার আমদানিকৃত এলএনজি থেকে আসে ৬৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট। যার ফলে প্রায় ১৩০০ মিলিয়ন ঘনফুটের ঘাটতি রয়ে গিয়েছে।
চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন না হওয়ায় আমদানি নির্ভরতা বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অভ্যন্তরীণ তেল, গ্যাস উত্তোলনে মনোযোগী না হয়ে আমদানির্ভরতা বাড়ানো দেশের জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। এক্ষেত্রে সরকারও উন্নয়ন পরিকল্পনায় অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে জ্বালানি সরবরাহ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তারই ধারাবাহিকতায় ২০২৮ সালের মধ্যে ১০০ টি অনশোর কূপ খনন করার পরিকল্পনা নিয়েছে পেট্রোবাংলা। এরমধ্যে বর্তমানে ৪৮ টি কূপ খননের প্রকল্প চলমান, যা ২০২৫ সালের মধ্যে শেষ করার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। নতুন কূপ খননের মাধ্যমে ৬২ কোটি ঘনফুট গ্যাস উত্তোলনের আশা করা হচ্ছে।