আন্তর্জাতিক যাত্রী বাড়ছে, স্থানীয় এয়ারলাইনগুলোর কী পরিকল্পনা?
আন্তর্জাতিক যাত্রী বাড়ার ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ বিমান-সহ স্থানীয় চারটি এয়ারলাইন নিজেদের সক্ষমতা বাড়ানোর একটি বড় পদক্ষেপ নিচ্ছে। চলতি বছরেই যার আওতায় অন্তত ১১টি নতুন উড়োজাহাজ নিজস্ব বহরে যুক্ত করার পরিকল্পনা করছে তারা।
বর্তমানে এই খাতে বিদেশি এয়ারলাইনগুলো ভালো ব্যবসা করছে, বাজারের ৭৫ শতাংশই তাঁদের দখলে। এতে তারা ইচ্ছেমতো ভাড়া নির্ধারণের সুযোগ পাচ্ছে বলেও জানান এভিয়েশন শিল্প-সংশ্লিষ্টরা।
এরমধ্যেই নতুন পরিকল্পনার আওতায় এয়ারবাস এ৩৩০-৩০০, এয়ারবাস এ৩২১, বোয়িং ৭৩৭-৮০০, এটিআর ৭২-৬০০ উড়োজাহাজগুলো যুক্ত হওয়ার ফলে বাংলাদেশ বিমান, ইউএস-বাংলা, নভোএয়ার, এয়ার অ্যাস্ট্রা'র সক্ষমতা যথেষ্ট বাড়বে। এতে তাঁদের যাত্রী বহনের সক্ষমতা বাড়বে ৩০ শতাংশ, অর্থাৎ দৈনিক ২১ হাজার ১০০ যাত্রী পরিবহন করতে পারবে।
এসব এয়ারলাইনের কর্মকর্তাদের মতে, সক্ষমতা সম্প্রসারণের ফলে দেশের এভিয়েশন বাজারে যুক্ত হবে ৪ হাজার ৮৪০টি নতুন আসন।
বোয়িং ও এয়ারবাসের সাথে আলোচনা করছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটি তাদের বহরে থাকা ২১টি উড়োজাহাজের সংখ্যা বাড়াতে এক বছরের মধ্যেই অন্তত দুটি থেকে সর্বোচ্চ চারটি নতুন এয়ারক্রাফট কিনতে চায় বলে টিবিএস'কে জানান বিমানের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা।
তবে উভয় প্রস্তুতকারক সংস্থার থেকে উড়োজাহাজ কিনে বিমান মিশ্র বহর পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কিনা– সেবিষয়ে স্পষ্ট কিছু জানাননি তিনি।
বিমানের এখনকার বহরে সবগুলোই যুক্তরাষ্ট্রের এভিয়েশন জায়ান্ট বোয়িংয়ের।
বর্তমানে স্থানীয় এয়ারলাইনগুলো ৩২ আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করছে, চলতি বছরের শেষ নাগাদ ৪৮টি রুটে সেবাদানের পরিকল্পনা করছে তারা। এছাড়া, তাদের মোট উড়োজাহাজের সংখ্যাও বর্তমানের ৫২টি থেকে বেড়ে ৬৩টিতে পৌঁছাবে।
বেসরকারি এয়ারলাইনগুলোর যাত্রীবহন সক্ষমতা বেড়েছে, সিংহভাগ অবদানই ইউএস-বাংলার
২০২২ সালের শেষদিকে, বেসরকারি এয়ারলাইনগুলোর ২২টি উড়োজাহাজে দৈনিক পাঁচ হাজার যাত্রীবহন সক্ষমতা ছিল। গত এক বছরে তাদের উড়োজাহাজের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩১টিতে। আরও দৈনিক যাত্রীবহনের সক্ষমতা ১১ হাজার ছাড়িয়েছে।
তবে সার্বিক এই সক্ষমতা বৃদ্ধির মধ্যে বেশিরভাগটাই হয়েছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের। কারণ এই সময়ে তাদের বহরে যুক্ত হয়েছে ৮টি উড়োজাহাজ।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিউল আজিম টিবিএস'কে বলেন, "চলতি বছর আমরা ওয়াইড-বডি এবং ন্যারো-বডি উভয় ধরনের এয়ারক্রাফট কেনার প্রক্রিয়া শুরু করেছি।"
"যাত্রী সংখ্যায় প্রবৃদ্ধি হওয়ায় আমাদের বড় বিনিয়োগ করতে হবে। এশিয়ার মধ্যে ভারত, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামের মতো দেশগুলো শতাধিক করে বিমান ক্রয়ের যে পরিকল্পনা করছে, সেখানে তারা আমাদের প্যাসেঞ্জারদেরও ধরতে চায়। এখন আমরা যদি চুপচাপ বসে থাকি তাহলে মার্কেট হারাব" - যোগ করেন তিনি।
শফিউল আজিম বলেন, ঢাকা-রোম, ঢাকা-কুনমিং ও চট্টগ্রাম-ব্যাংককসহ চলতি বছরে নতুন কিছু রুটে ফ্লাইট চালু করতে চায় বিমান। একইসঙ্গে বর্তমান রুটগুলোয় ফ্লাইট সংখ্যা বাড়ানোর পরিকল্পনাও আছে। সেখানে নতুন এয়ারক্রাফট যুক্ত করার কোনো বিকল্প নেই।
গত বছরে বাংলাদেশের বিমানবন্দরগুলো ১ কোটি ৭৪ লাখ যাত্রী হ্যান্ডেল করেছে
গত বছর দেশের বিমানবন্দরগুলো দিয়ে রেকর্ড এক কোটি ৭৪ লাখ (১৭.৪ মিলিয়ন) যাত্রী যাতায়াত করেছে। যাদের বেশিরভাগই আন্তর্জাতিক যাত্রী। আগের বছরের তুলনায় যা ২৩.৪ বেড়েছে বলে জানায় বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)।
গত এক বছরে বাংলাদেশি ও বিদেশিসহ আন্তর্জাতিক যাত্রীসংখ্যা বেড়েছে ২৬ লাখ ৭০ হাজার, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ এবং কোভিড-পূর্ব সময়ের তুলনায় প্রায় ৩৭ শতাংশ বেশি।
এভিয়েশন শিল্পের অভ্যন্তরীণ ব্যক্তিরা বলছেন, এই তথ্য বাংলাদেশে আসা-যাওয়ায় আকাশপথে ভ্রমণ বাড়ার ঘটনা তুলে ধরছে। এর পেছনে রেকর্ড সংখ্যক কর্মীর বিদেশ গমন, শিক্ষার কাজে বিদেশ যাত্রা, চিকিৎসা সেবা, পর্যটন ও ব্যবসার কাজে যাতায়াতের মতো নানান বিষয়ই এর পেছনে অবদান রেখেছে।
দেশে বিমানযাত্রী বাড়ার ঘটনা আন্তর্জাতিক প্রবণতারই অংশ। ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে বৈশ্বিক যাত্রী সংখ্যা বেড়েছে ৩৬ দশমিক ৯০ শতাংশ। ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, ২০২৩ সালের পুরো সময়ে বৈশ্বিক যাতায়াত মহামারি-পূর্ব (২০১৯ সাল) সময়ের ৯৪ দশমিক ১০ শতাংশে পৌঁছেছে।
বিমানবন্দর উন্নয়নে ব্যয় ৩২ হাজার কোটি টাকা
ঢাকা বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণসহ প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে দেশব্যাপী বিমানবন্দরগুলোর ব্যাপক উন্নয়ন কাজও এয়ারলাইনগুলোকে দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণপূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের গন্তব্যগুলোয় যাত্রীসেবা সম্প্রসারণে উৎসাহিত করছে।
বর্তমানে ৩৫টি বিদেশি এয়ারলাইন ৭৫ শতাংশ যাত্রী ও মালামাল বহন করছে, সক্ষমতা বাড়িয়ে এই বাজারের হিস্যা নিতে পারলে বাংলাদেশের আকাশপথে পরিবহন শিল্পের আরো প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে।
স্থানীয় এয়ারলাইনগুলোও তাদের বহর সম্প্রসারণ করে ও ফ্লাইটের সংখ্যা বাড়িয়ে বিদেশি সংস্থাগুলোর সাথে প্রতিযোগিতা করতে চায় এবং বাজার হিস্যা বাড়াতে চায়।
এভিয়েশন বিশ্লেষক কাজি ওয়াহিদুল ইসলাম মনে করেন, স্থানীয় এয়ারলাইনগুলোর কার্যক্রম সম্প্রসারণ এবং বিদেশি সংস্থাগুলোর সাথে প্রতিযোগিতা করার সম্ভাবনা রয়েছে।
টিবিএস'কে তিনি বলেন, "স্থানীয় এয়ারলাইনকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, যেমনটা অন্যান্য অনেক দেশেই দেখা যায়। এসব দেশে অন্তত ৫০ শতাংশ যাত্রীবহন করে স্থানীয় এয়ারলাইন। তবে বাংলাদেশে এই সংখ্যাটা ২৫ শতাংশের মধ্যে।"
তাঁর মতে, এই ভারসাম্যহীনতার ফলে নিজেদের ইচ্ছেমতো ভাড়া নির্ধারণ করতে পারছে বিদেশি এয়ারলাইনগুলো, যার ফলে চড়া দামে টিকেট বিক্রির ঘটনা দেখা যাচ্ছে।
ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা স্কোয়াড্রন লিডার লুৎফর রহমান বলেন, "আন্তর্জাতিক যাত্রী সংখ্যা বাড়ার সাথে সামঞ্জস্য রেখেই আমরা ফ্লাইটের সংখ্যা বাড়িয়েছি। এখন আমাদের বহরে আরও এয়ারক্রাফট আনতে চাই। চলতি বছরে এরমধ্যেই নতুন তিনটি উড়োজাহাজ যুক্ত হয়েছে। আগামী মাসগুলোয় আরও যুক্ত হবে।"
ইউএস-বাংলার বহরে এখন ২৩টি উড়োজাহাজ
ফেব্রুয়ারি মাসেও দুটি উড়োজাহাজ যুক্ত করে বহর সম্প্রসারণ করেছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স। এরমধ্যে একটি হলো এয়ারবাস এ৩৩০-৩০০ এবং অন্যটি হলো- বোয়িং ৭৩৭-৮০০। এরমধ্যে দিয়ে বহরে থাকা উড়োজাহাজের সংখ্যার বিচারে দেশের বৃহত্তম এয়ারলাইন হয়েছে ইউএস-বাংলা।
খুব শিগগিরই ৪৩৬ আসনের আরেকটি এয়ারবাস এ৩৩০-৩০০ ওয়াইড-বডি এয়ারক্রাফট বহরে যুক্ত করার পরিকল্পনা করছে তারা।
এয়ারলাইনটির সুত্রগুলো জানায়, চলতি বছরের শেষ নাগাদ ন্যারো-বডির আরও অন্তত তিনটি উড়োজাহাজ তাদের বহরে যুক্ত হবে। তবে বোয়িং ও এয়ারবাসের সাথে চুক্তি প্রক্রিয়াধীন থাকায় বিষয়টি এখনও চূড়ান্ত হয়নি।
নতুন উড়োজাহাজটি দুবাই, শারজাহ, মাস্কট, দোহা ও কুয়ালালামপুর এর রুটগুলোয় যাত্রীসেবা দেবে।
এছাড়া, লন্ডন ও রোমের রুটে এয়ারবাসের উড়োজাহাজ যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে ইউএস-বাংলার। ভবিষ্যতে সৌদি আরবের জেদ্দা, রিয়াদ ও দাম্মামের মতো গন্তব্যেও তা করা হবে।
এয়ারবাসের দিকে ঝুঁকছে নভোএয়ার
বর্তমানে নভোএয়ারের রয়েছে পাঁচটি এটিআর ৭২-৫০০ উড়োজাহাজ। এয়ারবাস এ৩২১নিও মডেলের আরও অন্তত তিনটি প্লেন যুক্ত করে যাত্রীবহন সক্ষমতা বাড়াতে চায় তারা।
সিঙ্গেল আইলের এ৩২০ শ্রেণির মধ্যে এয়ারবাসের বেস্ট সেলিং মডেল হচ্ছে এ৩২১নিও। প্রচলিত দুই মানের যাত্রী আসন বিন্যাসে এটি ১৮০ থেকে ২২০ জন যাত্রী বহন করতে পারে। তবে উচ্চ সংখ্যার আসন বিন্যাসে এটি ২৪৪ জন যাত্রীধারণ করতে পারে।
নভোএয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মফিজুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "আপাতত আমরা এশিয়ার বিভিন্ন গন্তব্যগুলোর দিকে মনোযোগ দিচ্ছি। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার মধ্যে আমাদের টার্গেট হলো– থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর। ২০২৪ সালের মধ্যে আমরা এসব দেশে ফ্লাইট চলাচল শুরু করতে চাই।"
"এজন্যই আমাদের বহরে আরও বড় বিমান যুক্ত করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। আমাদের ফ্লিট স্ট্র্যাটেজি সবসময়েই ছিল এয়ারবাস কেন্দ্রিক। এই বছরের মাঝামাঝি আরও তিনটি এয়ারক্রাফট যুক্ত করার লক্ষ্য রয়েছে আমাদের"- বলছিলেন মফিজুর, যিনি এভিয়েশন অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এরও মহাসচিব।
নভোএয়ারের সূত্রগুলো জানায়, উড়োজাহাজ বিক্রির জন্য বোয়িং-ও নভোএয়ারকে প্রস্তাব দিচ্ছে।
বহর সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে এয়ার অ্যাস্ট্রার-ও
২০২২ সালের নভেম্বরে দেশের এভিয়েশন বাজারে প্রবেশ করে এয়ার অ্যাস্ট্রা। বর্তমানে সংস্থাটি অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করছে। তবে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনার জন্যও বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছে এয়ারলাইনটি।
এয়ারলাইনটির সূত্রগুলো জানায়, এই বছরের মধ্যেই এয়ার অ্যাস্ট্রার বহরে আরও অন্তত দুটি উড়োজাহাজ যুক্ত হবে।
এয়ার অ্যাস্ট্রার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ইমরান আসিফ টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের আন্তর্জাতিক অপারেশনের বিষয়ে নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেবে বলে আশা করছি। সবকিছু ঠিক থাকলে– আমরা নেপাল ও ভারতে ফ্লাইট পরিচালনার ব্যাপারে আশাবাদী।"
তিনি বলেন, "আগামী মার্চে আমাদের বহরে আরও একটি এটিআর বিমান যুক্ত হবে। তখন আমাদের দৈনিক যাত্রীবহন সক্ষমতা হবে আড়াই হাজার। আমাদের বর্তমান সক্ষমতা ১ হাজার ৯৬০।"
"এটিআর দিয়ে আমরা নেপাল এবং কলকাতা ছাড়া অন্য কোনো রুটে যেতে পারব না। এজন্য আমরা ফ্লিটে চলতি বছরের মধ্যেই বড় এয়ারক্রাফট যোগ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বোয়িং এবং এয়ারবাস কোনোটা থেকেই চলতি বছরের মধ্যে পাওয়া সম্ভব নয়"- জানান ইমরান আসিফ।