চাইনিজ সবজি যেভাবে বদলে দিলো এক পদার্থবিজ্ঞান-শিক্ষার্থীর জীবনের গতিপথ
শুরুর গল্পটা আজ থেকে দুই দশক আগের। সময় ২০০৩ সাল। ঢাকার পার্শ্ববর্তী উপজেলা সাভারের দক্ষিণ মেইটকা গ্রামের কোব্বাদ হোসাইন তখন সবেমাত্র বিজ্ঞান বিভাগ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে মিরপুর সরকারি বাংলা কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছেন। বাবা আব্দুল কাদের ছিলেন সদ্য অবসরপ্রাপ্ত একজন ভেটেরিনারি চিকিৎসক। পশুপাখির চিকিৎসা পেশার পাশাপাশি বাড়িতে ডেইরি ফার্ম করে গাভী লালন-পালন করতেন তিনি। সেই সুবাদে পারিবারিক সামান্য কিছু কৃষি জমিতে ফার্মের গরুর জন্য ভুট্টার চাষ করা হতো। জমিতে চাষকৃত সেই ভুট্টা ঘাস হিসাবে গরুকে খাওয়ানো হলেও সেই ঘাস থেকে কিছু পরিমাণে পাওয়া যেতো বেবি কর্ণ বা কচি ভুট্টা। এক কথায় সেদিনের সেই অপরিপক্ক কিছু ভুট্টাই পদার্থবিজ্ঞানের এই শিক্ষার্থীকে প্রতিষ্ঠিত চাইনিজ সবজি চাষীতে রূপান্তর করেছে, যা থেকে তার বর্তমান বার্ষিক আয় ৭০ থেকে ৮০ লাখ টাকা।
বলছিলাম সাভারের দক্ষিণ মেইটকা এলাকার সফল চাইনিজ সবজি চাষী মো. কোব্বাদ হোসাইনের কথা। চাইনিজ সবজি চাষ কীভাবে একজন পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীকে পুরোদস্তর চাষীতে পরিণত করলো তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সাথে একান্ত এক সাক্ষাৎকারে তুলে ধরেন তিনি।
কোব্বাদ হোসাইন বর্তমানে প্রতি বছর ২০০ বিঘা জমিতে ৩০ ধরনেরও বেশি বিভিন্ন চাইনিজ সবজি চাষ করছেন। তার সফলতায় অনুপ্রাণিত হয়ে ওই এলাকার আরও অন্তত ১০ থেকে ১৫ জন কৃষক তার মতোই চাইনিজ সবজি চাষের দিকে ঝুঁকেছেন।
বর্তমানে সাভার ছাড়াও কেরানীগঞ্জ ও মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর এলাকার কৃষিজমি লিজ নিয়ে এসব সবজি চাষ করছেন কোব্বাদ হোসাইন। প্রতিষ্ঠা করেছেন 'কৃষক বাংলা অ্যাগ্রো প্রোডাক্ট' নামে একটি চাইনিজ সবজি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে রেডিসন, ওয়েস্টিনের মতো রাজধানীর বিভিন্ন নামীদামী ফাইভ স্টার হোটেল ও চেইন শপে চাইনিজ সবজি সরবরাহ করছে তার এই প্রতিষ্ঠান। সোনারগাঁও, শেরাটনেও অন্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের হাত ধরে সরবরাহ হচ্ছে তার সবজি। এছাড়া, বিভিন্ন সুপার শপে সরাসরি চাইনিজ সবজি সরবরাহ করছেন তিনি।
সম্প্রতি কোব্বাদস হোসাইনের চাষকৃত ২৩ টন পরিমাণ চাইনিজ ক্যাবেজ (চাইনিজ বাঁধাকপি) রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান বরুণ ক্রপ কেয়ারের হাত ধরে তাইওয়ানে রপ্তানি করা হয়েছে, যে কৃষিপণ্যটি দেশের রপ্তানির ঝুড়িতে উঠলো প্রথমবারের মত।
কোব্বাদ হোসাইন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, চাইনিজ ক্যাবেজ ছাড়াও প্রতিবছর অন্তত ৩০ প্রকারের বিভিন্ন সবজি চাষ করছেন তিনি। তবে দেশের বাইরে এসব সবজির ব্যাপক চাহিদা থাকলেও শুধুমাত্র যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকায় সবজি রপ্তানি করতে পারছেন তারা।
তাছাড়া, দেশীয় ভোক্তাদের কাছে তুলনামূলক কম পরিচিত এবং খাদ্যাভাস না থাকায় দেশের বাজারে এগুলো তুলনামূলক কম চাহিদাসম্পন্ন; পাশাপাশি এই সবজি সংরক্ষণের জন্য উপযুক্ত কোল্ড স্টোরেজ সুবিধা না থাকায় প্রতিবছর তার উৎপাদিত মোট সবজির ২৫ শতাংশই নষ্ট হচ্ছে বলে জানান তিনি।
যেভাবে চাইনিজ সবজি চাষ শুরু করেন কোব্বাদ হোসাইন
কোব্বাদ হোসাইন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, ঢাকা সিটি কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর মিরপুর সরকারি বাংলা কলেজে বিজ্ঞান অনুষদের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে অনার্সে ভর্তি হন তিনি। সেসময় পারিবারিক ডেইরি ফার্মের ১০/১২টি গরুর জন্য ৩ বিঘার মত পারিবারিক কৃষিজমিতে তিনি ভুট্টা চাষ করতেন। মূলত গরুর ঘাস হিসেবেই সেই ভুট্টার চাষ করা হতো। চাষকৃত সেই ভুট্টা গাছ থেকে পাওয়া অতিরিক্ত বেবি কর্ন বা অপরিপক্ক ভুট্টা গুলো ৩০/৪০ টাকা কেজি দরে নিয়ে যেত পাইকারি একজন সবজী ব্যবসায়ী। সেই থেকে কোব্বাদ হোসাইনের ধারণা তৈরি হয় রাজধানীর গুলশানের কাঁচা বাজারে বেবি কর্নের চাহিদা রয়েছে।
এরপর ২০০৩ সালে বাবা মারা যাওয়ার পর লেখাপড়ায় অনেকটা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন কোব্বাদ। পরবর্তীতে ২০০৪ সালে বন্যা হওয়ার পর সেই পাইকারি সবজি ব্যবসায়ী– যিনি কোব্বাদ হোসাইনদের চাষকৃত বেবি কর্ন কিনতেন– তিনি সে বছর আর বেবি কর্ণ সংগ্রহ করেননি। ফলে নিজ উদ্যোগেই সেইবার বেবি কর্ণগুলো গুলশানের কাঁচা বাজারে নিয়ে যান কোব্বাদ। সেখানে যাওয়ার পর দেখেন অনেক প্রকারের চাইনিজ সবজি যেমন– লেটুস পাতা, পেয়াজ পাতা, চাইনিজ পাতা বিক্রি হচ্ছে বাজারে।
ওই বাজারে প্রতিপিস বেবি কর্ণ তিনি বিক্রি করলেন ১.৭০ টাকা দরে, যা আগে পাইকারের কাছে বিক্রি করতেন ০.৫০ টাকা দরে। প্রথম দিনেই ৩ হাজার টাকার মত আয় হয় তার। এ থেকেই মূলত তিনি চাইনিজ সবজি চাষে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
আগ্রহ থেকে পারিবারিক ৩ বিঘা কৃষিজমি ও নতুন করে ২ বিঘা কৃষি জমি লিজ নিয়ে চাইনিজ সবজি চাষ শুরু করেন কোব্বাদ। সে বছর প্রথমদিকে ৫ বিঘা জমির ৪ ভাগের ৩ ভাগ জমিতে দেশীয় সবজি ও ১ ভাগ জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে চাইনিজ বাঁধাকপি চাষ করেন তিনি। গুলশান মার্কেটের এক বীজের দোকান থেকে এসব চাইনিজ সবজির বীজ সংগ্রহ করতেন কোব্বাদ।
চাইনিজ সবজি পরিক্ষামূলকভাবে চাষ করে কোব্বাদ বুঝতে পারেন জমির ৩ ভাগে চাষ করা দেশীয় সবজি থেকে তার যা আয় হচ্ছে, বাকি ১ ভাগ অংশের চাইনিজ সবজি থেকে তারচেয়ে আয় হচ্ছে বেশি।
দেশীয় সবজীর তুলনায় কয়েক গুণ বেশি লাভ হওয়ায় পরবর্তীতে পুরো জমিতেই চাইনিজ সবজির আবাদ করেন কোব্বাদ। সেসময় জমির কিছু অংশে চাইনিজ ক্যাবেজ, কিছু অংশে লেটুস পাতা, চাইনিজ পাতার চাষ করা হতো।
"এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি আমাকে, প্রতি বছরই দ্বিগুণ পরিমাণ জমিতে চাইনিজ সবজি চাষের পরিধি বাড়াতে শুরু করি। কৃষিজমি লিজ নিয়ে এক বছর ১০ বিঘা জমিতে চাষ করলে পরের বছর জমি বাড়িয়ে ২০ বিঘা জমিতে চাষ করতাম। প্রতি বিঘা কৃষিজমি গড়ে বাৎসরিক ২০ হাজার টাকায় লিজ নেওয়া হয়। এভাবে করতে করতে এখন ২০০ বিঘা জমিতে অন্তত ৩০ প্রকারের চাইনিজ সবজি চাষ করছি," বলেন মো. কোব্বাদ হোসাইন।
যেসব চাইনিজ সবজি চাষ করছেন তিনি
বর্তমানে ঢাকার সাভার, কেরানীগঞ্জ ও মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর এলাকায় সব মিলিয়ে ২০০ বিঘা জমিতে চাইনিজ সবজি চাষ করছেন কোব্বাদ হোসাইন। এসব সবজির মধ্যে রয়েছে– চাইনিজ বাঁধাকপি, লেটুস পাতা, পেঁয়াজ পাতা, লিক পাতা, ডিল লিফ, ফেনেল, লেটুস রোলুসো, সুকাত পাতা, পেকচাই, বেবি কর্ণ, সুইট কর্ন, চাইনিজ পাতা, ব্রকলি, বিটরুট, রেড ক্যাবেজ, বানচিং ওনিওন, ক্যাপসিকাম, সিমলা চিলি, চেরি টমেটো, জুকিনি, থাই আদা, লেটুস আইসবার্গ, লেটুস ফ্রিজির মত বিভিন্ন ধরনের বিদেশি জাতের সবজি।
এরমধ্যে গত জানুয়ারিতে তার চাষ করা ২৩ টন পরিমাণ চাইনিজ বাঁধাকপি একটি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের হাত ধরে প্রথমবারের মত তাইওয়ানে রপ্তানি হয়েছে। ২৫ টাকা কেজি দরে এসব চাইনিজ বাঁধাকপি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করেছেন তিনি।
যেভাবে উৎপাদন করা হয় চাইনিজ বাঁধাকপি
কোব্বাদ হোসাইন জানান, অন্যান্য সবজির মতই স্বাভাবিকভাবে চাষাবাদ করা হয় চাইনিজ বাঁধাকপি। তবে অতিরিক্ত তাপ সহ্য করতে না পারায় মূলত শীত মৌসুমেই এর চাষ ভালো হয়। এছাড়া, তুলনামূলক নরম প্রকৃতির হওয়ায় ক্ষেত থেকে শুরু করে বাজারে পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত একটু সতর্কভাবে নাড়াচাড়া করতে হয় এসব চাইনিজ সবজি।
১ বিঘা জমিতে চাইনিজ বাঁধাকপি চাষ করতে খরচ হয় ৪০ হাজার টাকার মত। ৯০ দিনেই বিক্রির উপযোগী হয় চাইনিজ ক্যাবেজ। ১ বিঘা জমি থেকে ৮ টন পরিমাণ চাইনিজ ক্যাবেজ উৎপাদন করা যায়। দেশীয় বাজারে যা পরবর্তীতে বিক্রি হয় ১৫ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত কেজি দরে।
বর্তমানে ২০০ বিঘার মধ্যে প্রায় ৪০ বিঘা জমিতে শুধু চাইনিজ বাঁধাকপি চাষ করেন এই কৃষক।
যেভাবে রপ্তানি হলো কোব্বাদ হোসাইনের চাইনিজ বাঁধাকপি
কোব্বাদ হোসাইন জানান, দীর্ঘ সময় ধরে চাইনিজ সবজির চাষাবাদ করলেও এর রপ্তানির প্রক্রিয়ার সাথে খুব বেশি পরিচিত নন তিনি। সম্প্রতি একটি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান তার সাথে যোগাযোগ করে চাইনিজ ক্যাবেজ নেওয়ার আগ্রহ দেখালে তিনিও রাজি হয়ে যান। জানুয়ারিতে সেই প্রতিষ্ঠান তার কাছ থেকে ২৩ টন পরিমাণ চাইনিজ বাঁধাকপি সংগ্রহ করে, যা পরবর্তীতে তাইওয়ানে রপ্তানি করা হয়।
কোব্বাদ হোসাইন জানান, সম্ভাবনা থাকলেও এসব সবজি রপ্তানির জন্য এখনো প্রস্তুত নন তারা। এজন্য দেশের কৃষি বিভাগের সহযোগীতা কামনা করেন তিনি। তিনি বলেন, "সবজি রপ্তানির দিকে যেতে হলে কৃষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের প্রয়োজন আছে, তবে এ বিষয়ে খুব একটা উদ্যোগ নেই দেশের কৃষি বিভাগের। কৃষকদের রপ্তানিমুখী করা গেলে প্রতিবছর এই খাত থেকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব হবে।"
চাইনিজ সবজি চাষের উপযুক্ত মৌসুম
কোব্বাদ হোসাইন জানান বছরের সব সময়ই কোনো না কোনো চাইনিজ সবজি চাষ করা যায়। তবে শীত মৌসুমেই এর চাষ ভালো হয়। শীত মৌসুমে ১০ প্রকারের চাইনিজ সবজি চাষ করেন তিনি, যেখানে এই মৌসুমে ৩০ প্রকারেরও বেশি সবজি চাষ করেছেন।
চাইনিজ সবজি চাষে যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে
কোব্বাদ হোসাইন জানান, চাইনিজ সবজির একটি বড় অংশই নরম প্রকৃতির। তাই বাজারজাত করা পর্যন্ত এসব সবজি খুব সাবধানে নাড়াচাড়া করতে হয় তাদের। এছাড়াও এই সবজি চাষের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে দেশীয় ভোক্তাদের কাছে এই সবজির চাহিদা কম থাকায় উৎপাদিত এসব সবজি সংরক্ষণের প্রয়োজন হয়। কিন্তু দেশে উপযুক্ত কোল্ড স্টোরেজ সুবিধা না থাকা উৎপাদিত এসব সবজির প্রায় ২৫ শতাংশই নষ্ট হয়ে যায়, যা কৃষকদের আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি করছে।