বাজারে যাচ্ছেন? সরকার নির্ধারিত দামে পণ্য কেনার কথা ভুলে যান
রমজানে দামের ধাক্কা থেকে ভোক্তাদের কিছুটা অবকাশ দিতে সরকার ২৯টি নিত্যপ্রয়োজনীয় কৃষিপণ্যের খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে দিলেও বাজারে সে দাম কার্যকর হয়নি।
শনিবার (১৭ মার্চ) ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন বাজার পরিদর্শন করে দেখা যায়, অনেক পণ্যই নির্ধারিত দামে বিক্রি হচ্ছে না। সরকার নির্ধারিত দাম এবং বাজারের দামে বেশির ভাগ পণ্যের ক্ষেত্রে বিস্তর ফারাক দেখা গেছে।
শুক্রবার (১৬ মার্চ) কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মাসুদ করিম স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনের দাম অনুযায়ী ২৯টি পণ্য কিনতে একজন ক্রেতার চার হাজার ৮১৩ টাকা খরচ হওয়ার কথা।
কিন্তু এসব পণ্য কিনতে শনিবার ক্রেতাদের অতিরিক্ত দিতে হয়েছে প্রায় ৭৫০ টাকা। খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, তারা এখন পর্যন্ত সরকার নির্ধারিত দামের কোনো নির্দেশনা পাননি।
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে সরকার এলপিজি (তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস), চিনি, তেল, আলু, পেঁয়াজ এবং ডিমসহ ৬টি পণ্যের দাম নির্ধারণ করে। তবে এলপিজি সিলিন্ডার, আলু, ডিম ও তেল ছাড়া অন্য পণ্যের দাম কার্যকর হয়নি।
বিক্রেতা ও বিশেষজ্ঞরা এর জন্য সরকারের দুর্বল মনিটরিং এবং মূল্য নির্ধারণে ভুল পদ্ধতির প্রয়োগকে দায়ী করছেন।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসেন বলেন, সব পর্যায়ে দাম নির্ধারণ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
'কিন্তু এটা বাস্তবায়ন খুবই চ্যালেঞ্জিং। বিভিন্ন পণ্যের মূল্য নির্ধারণে সরকারের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। তাই সাধারণ ভোক্তাদের স্বস্তি দিতে নির্ধারিত দামে পণ্য বিক্রি করতে সরকারের সব সংস্থা-দপ্তরগুলোকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে,' বলেন তিনি।
বেঁধে দেওয়া দাম বনাম বাস্তবতা
শনিবার ঢাকার কারওয়ান বাজার, মগবাজার ও চট্টগ্রামের কাজীর দেউড়ির কাঁচাবাজারে নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে পণ্য বিক্রি হতে দেখা গেছে।
এ দিন মগবাজারে ব্রয়লার মুরগির কেজি ২১০ টাকা, সোনালী মুরগি ৩২০ টাকা, ডিম প্রতিটি ১১.৫ টাকা, দেশি জাতের পেঁয়াজ ৮০-৯০ টাকা কেজি, আদা ২১০ টাকা, কাঁচা মরিচ ৮০ টাকা, বেগুন ৬০ টাকা ও আলু ৪০ টাকায় বিক্রি হয়।
শুক্রবারের প্রজ্ঞাপনে ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজি ১৭৫.৩০ টাকা, সোনালী মুরগি ২৬২ টাকা, খাসির মাংস ১০০৩.৫৬ টাকা, পাঙ্গাস (চাষের) ১৮০.৮৭ টাকা, কাতলা (চাষের) ৩৫৩.৫৯ টাকা এবং ডিম প্রতিটি ১০.৪৯ টাকায় বিক্রি করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আবু বকর নামক এক খেজুর বিক্রেতা জানান, শনিবার জাহিদি জাতের খেজুরের দাম ছিল প্রতি কেজি ৩৫০ টাকা। সরকার নির্ধারিত ১৮৫ টাকা দামের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জবাব দেন, 'ওসব দাম শুধু টিভিতেই। বাজারে পাবেন না।'
'২৫০ টাকা কেজি দরে খেজুর কিনে ১৮৫ টাকায় বিক্রি করবে কোন পাগলে। ৩৫০ টাকার এক টাকা কমেও দিতে পারব না,' বলেন এ বিক্রেতা।
এদিকে শনিবার রাজধানীর অধিকাংশ বাজারে সাগর জাতের কলা বিক্রি হয়েছে প্রতি হালি ৪০ টাকায়, যা সরকার নির্ধারিত ৩০ টাকা দামের চেয়ে অনেক বেশি। একইভাবে কৃষি বিপণন বিভাগ কর্তৃক নির্ধারিত ৬৬৪ টাকার পরিবর্তে গরুর মাংস প্রতি কেজি ৭৫০ টাকায় বিক্রি হয়।
কারওয়ান বাজারের মাংস বিক্রেতা আমির হোসেন আক্ষেপ করে বলেন, 'আসল দাম বেশি, কম দামে গরুর মাংস বিক্রি করে আমরা তো লোকসান করতে পারি না।'
কাজির দেউরি কাঁচাবাজারে ব্রয়লার মুরগির কেজি ২০০ টাকা, সোনালী মুরগির দাম ২৮০ টাকা, গরুর মাংস ৮০০ টাকা, গরুর মাংস ১,১০০ টাকা, পাঙ্গাস (চাষের) ২০০ টাকা, কাতলা (চাষের) ৪৫০ টাকা এবং ডিম প্রতিটি ১১.৬৬ টাকায় বিক্রি হয় শনিবার।
ডালের মধ্যে আমদানি করা ছোলা প্রতি কেজি ১১৫ টাকা, উন্নত মসুর ডাল ১৪০ টাকা, মোটা মসুর ডাল ১১০ টাকা, মুগডাল ১৯৫ টাকা, খেসারি ডাল ১৪০ টাকা, মাসকলাই ১৮০ টাকা এবং বেসন ১১০ টাকা দামে বিক্রি করেন বিক্রেতারা।
তবে সরকারি নিয়মানুযায়ী আমদানি করা ছোলা ৯৮.৩০ টাকা, উন্নত মসুর ডাল ১৩০.৫০ টাকা, মোটা মসুর ডাল ১০৫.৫০ টাকা, মুগ ডাল ১৬৫.৪১ টাকা, খেসারি ডাল ৯২.৬১ টাকা, মাসকলাই ১৬৬.৪১ টাকা এবং বেসন ১২১.৩০ বিক্রি হওয়ার কথা।
একইভাবে শুকনো ও মসলাজাত পণ্যের মধ্যে দেশি পেঁয়াজ ৬৫.৪০ টাকা, দেশি রসুন ১২০.৮১ টাকা, আমদানি করা আদা ১৮০.২০ টাকা, শুকনা মরিচ ৩২৭.৩৪ টাকা, খেজুর (জাইদি) ১৮৫.০৭ টাকা, মোটা চাল ৬০ টাকায় বিক্রি হওয়ার কথা।
শনিবার বাজারে পণ্যের মধ্যে দেশি জাতের পেঁয়াজ ৯০ টাকা, রসুন ২২০ টাকা, আমদানি করা আদা ১৯০ টাকা, শুকনা মরিচ ৪৮০ টাকা, খেজুর (জাইদি) ৩০০ টাকা এবং মোটা চাল ৭০ টাকায় বিক্রি হয়।
কাজী দেউড়িসহ নগরীর বিভিন্ন কাঁচাবাজারে কাঁচা মরিচ ৬০ টাকা, বেগুন ৫০ টাকা, আলু ৪০ টাকা, বাঁধাকপি ২০ টাকা, ফুলকপি ৫০ টাকা, শিম ৬০ টাকা, টমেটো ৪০ টাকা, মিষ্টি কুমড়া ৪০ টাকা এবং সাগর জাতের কলার প্রতি হালি ৪৬.৬৬ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে।
শুক্রবারের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, প্রতি কেজি কাঁচা মরিচ ৬০.২০ টাকা, বেগুন ৪৯.৭৫ টাকা, আলু ২৮.৫৫ টাকা, বাঁধাকপি ২৪.৩০ টাকা, ফুলকপি ২৯.৬০ টাকা, মটরশুটি ৪৮ টাকা, টমেটো ৪০.২০ টাকা, মিষ্টিকুমড়া ২৩.৩৮ টাকা এবং সাগর কলার হালি ২৯.৭৮ টাকায় বিক্রি হওয়ার কথা।
বাজারদর অনুযায়ী বেসন, কাঁচামরিচ, বেগুন, বাঁধাকপি, টমেটো, মিষ্টি কুমড়া ছাড়া বাকি সব পণ্যই সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হয়েছে।
সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে পণ্য বিক্রির বিষয়ে কাজী দেউড়ি সিডিএ মার্কেটের জীবন গ্রোসারির স্বত্বাধিকারী এনাম উদ্দিন বলেন, 'দোকানের প্রায় প্রতিটি পণ্য রমজানের আগে বাড়তি দামে কেনা। অর্থাৎ সরকার যে দাম বেঁধে দিয়েছে, তার চেয়েও বেশি দামে আমাদের পাইকারি বাজার থেকে কিনতে হয়েছে।'
খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে পেঁয়াজ, রসুন, আদার মতো কাঁচাপণ্য ব্যবসায়ী গ্রামীণ বাণিজ্যালয়ের স্বত্বাধিকারী বলয় কুমার পোদ্দার বলেন, 'আমরাও চাই প্রতিটি পর্যায়ে পণ্যের দাম নির্ধারিত থাকুক। কারণ আমদানিকারক কিংবা মধ্যসত্বভোগীরা আমদানি খরচের চেয়ে অতিরিক্ত দামে পণ্য বিক্রি করে বাড়তি মুনাফা করে, অথচ বাজার মনিটরিংয়ে জরিমানা গুনতে হয় আড়তদার কিংবা কমিশন এজেন্টদের।' এ ব্যবসায়ী বিশ্বাস করেন, উৎপাদন কিংবা আমদানি থেকে শুরু করে খুচরা বাজার পর্যন্ত শক্ত মনিটরিং হলে বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
কয়েকটি পণ্যের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, সরকার খুচরা পর্য়ায়ে দেশি রসুন ১২০.৮১ টাকা, পেঁয়াজ ৬৫.৪০ টাকা এবং শুকনা মরিচ ৩২৭.৩৪ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। 'অথচ পাইকরি বাজার থেকে আমাদের প্রতিকেজি রসুন ১৯০ টাকা, পেঁয়াজ ৮৫ টাকা, এবং শুকনা মরিচ ৪৪০ টাকা দরে কিনতে হয়েছে। তাই আমদানি কিংবা উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে বাজার মনিটরিং না করে হঠাৎ করে নির্ধারিত দামে পণ্য বিক্রি কোনোভাবেই সম্ভব নয়,' বলেন তিনি।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ ফয়েজ উল্ল্যাহ বলেন, ভোক্তা অধিকারের নিয়মিত বাজার মনিটরিং চলমান আছে।
'ইতোমধ্যে নির্ধারিত দামে ২৯ পণ্য বিক্রির সরকারি নির্দেশনা আমরা পেয়েছি। নির্দেশনার আলোকে শিগগিরিই বাজার মনিটরিং শুরু হবে। সরকার আমদানি–উৎপাদন অর্থাৎ উৎস থেকে খুচরা বাজার পর্যন্ত সব স্তরের খরচ সমন্বয় করে এ দাম নির্ধারণ করেছে,' বলেন তিনি।
২০১৮ সালের কৃষি বিপণন আইনের অধীনে শুক্রবার ২৯টি পণ্যের দাম নির্ধারণ করা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং কৃষি মন্ত্রণালয় যৌথভাবে এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করবে।
উভয় মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা মাঠে উপস্থিত থাকবেন এবং ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা কৃষি বিপণন আইন প্রয়োগ করবেন, যার মধ্যে জরিমানাসহ বিভিন্ন শাস্তির বিধান রয়েছে।
এর আগে খুচরা বাজারে সাধারণ মানের খেজুর প্রতি কেজি ১৫০ থেকে ১৬৫ টাকায় এবং বহুল ব্যবহৃত জাইদি খেজুর ১৭০ থেকে ১৮০ টাকায় বিক্রি করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। তবে বাজারে এর বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে না। এর আগেও সয়াবিন তেল ও চিনিসহ কিছু পণ্যের দাম নির্ধারণ করেছিল সরকার।