ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়াসহ বিভিন্ন রোগের টেস্ট কিট উৎপাদন করবে সরকার
দেশে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, হেপাটাইটিস-বি, ম্যালেরিয়া, কোভিডসহ বিভিন্ন রোগ সনাক্তকরণ কিটে আমদানি নির্ভরতা রয়েছে। এই প্রবণতা কমাতে কিটগুলো দেশীয়ভাবে উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রেফারেন্স ইনস্টিটিউট ফর কেমিক্যাল মেজারমেন্টস (বিআরআইসিএম)।
এ লক্ষ্যে বিআরআইসিএম ডায়াগনস্টিক ডিভাইস উৎপাদন এবং স্মার্ট গবেষণাগারের উন্নয়নে প্রায় ১৪৪ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। প্রস্তাবিত প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, হেপাটাইটিস-বি প্রভূতি প্রাণঘাতি রোগ সনাক্তকরণে সহজলভ্য, মূল্য সাশ্রায়ী ও যথাযথ মান সম্পন্ন টেস্ট কিট উৎপাদন সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (বিডা)-র তথ্য অনুযায়ী, মেডিক্যাল ডিভাইসগুলোর বর্তমান বাজার মূল্য ৪৪২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। যার বাৎসরিক গ্রোথ রেট ১৩ শতাংশ। সেই হিসেবে ২০২৫ সাল নাগাদ বাজার মূল্য দাঁড়াবে ৮২০ মিলিয়ন ডলার; যার শতকরা ৯৩-৯৫ ভাগ আমদানি করতে হবে।
আমদানি নির্ভর টেস্টিং কিটের সংকট ব্যপকভাবে বোঝা গিয়েছিল কোভিড-১৯ এর সময়। ওই সময় আমদানি নির্ভর কিটের সংকটের কারণে টেস্টিং কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। শুধু কোভিড-১৯ নয়, বরং ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, হেপাটাইটিস-বিসহ প্রভূতি প্রাণঘাতি রোগের ক্ষেত্রেও সমস্যার চিত্র একইধরনের।
ঢাকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আরিফা আকরাম বলেন, "শুধু কোভিডের সময়ই নয়, সম্প্রতি ডলার সংকটের কারণে কিট আমদানিতে সমস্যা হয়েছে। কোনো কোনো দিন ল্যাবে কিটই ছিল না। ফলে দেশে উৎপাদন করা গেলে কম খরচে এবং সহজে কিট পাওয়া যাবে।"
বিআরআইসিএম-এর সিনিয়র সাইন্টিফিক অফিসার মোঃ মনিরুজ্জামান জানান, আমাদের দেশে টেস্ট কিটের বাজার প্রায় পুরোটাই রফতানি নির্ভর। বিআরআইসিএম ইতোমধ্যে ডেঙ্গুর কিট উদ্ভাবন করছে, যা ওষুধ প্রশাসনের অনুমোদনের অপেক্ষা আছে। এছাড়া বিআরআইসিএম আরও কিছু কিট উদ্ভাবনে কাজ করছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে আধুনিক ল্যাব স্থাপনের মাধ্যমে গবেষণা কার্যক্রম আরও জোরদার করা এবং উৎপাদনে যাওয়ার লক্ষ্য নিয়েছে বিআরআইসিএম।
কর্মকর্তারা জানান, বিআরআইসিএম-এর পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো উৎপাদনে আসলে ৪ থেকে ৫ বছরে টেস্ট কিটে আমদানি নির্ভরতা থাকবে না।
সম্প্রতি বিআরআইসিএম তাদের প্রকল্প প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে। গত ১৩ নভেম্বর প্রকল্প প্রস্তাবের ওপর পরিকল্পনা কমিশনে মূল্যায়ন কমিটির সভায় হয়েছে। সভায় প্রকল্পটি প্রাথমিকভাবে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এখন চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় উপস্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
ডেঙ্গু কিট
প্রকল্প প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, হংকংসহ বিভিন্ন দেশ থেকে বছরে আনুমানিক ৫০ লাখ ডেঙ্গু টেস্টিং কিট আমদানি করা হয়। সাধারণত জুলাই থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত বিস্তৃত সময়ে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ে এবং ঐসময় দৈনিক গড়ে ২০ হাজার এবং মাসে পাঁচ লক্ষ টেস্টের চাহিদা সৃষ্টি হয়।
প্রতিটি টেস্টের জন্য মোট প্রায় ১ হাজার টাকা ব্যয় হয়। এক্ষেত্রে, কিটের মূল্য ৩৮০ টাকা। কিন্তু, বিআরআইসিএম কর্তৃক উদ্ভাবিত প্রতিটি কিটের মূল্য ১০০ টাকা। এক্ষেত্রে, ব্যয় সাশ্রয় ছাড়াও বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে বলে প্রকল্প প্রস্তাবে বলা হয়েছে।
চিকুনগুনিয়া কিট
বাংলাদেশে এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত বিস্তৃত সময়ে চিকুনগুনিয়ার প্রভাব বাড়ে। এসময়ে দৈনিক গড়ে ৫ হাজার এবং মাসে গড়ে ২ লাখ টেস্টের চাহিদা সৃষ্টি হয়। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, হংকং প্রভৃতি দেশ থেকে বছরে প্রায় ২০ লাখ কিট আমদানি করা হয়। প্রতিটি টেস্টের জন্য গড়ে ৫০০ থেকে ১২০০ টাকা ব্যয় হয়। প্রতিটি কিটের মূল্য ৩২০ থেকে ৩৫০ টাকা।
অন্যদিকে বিআরআইসিএমের উদ্ভাবিত চিকুনগুনিয়ার প্রতিটি কিটের মূল্য ১০০ টাকা। এক্ষেত্রে, ব্যয় সাশ্রয় ছাড়াও বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে বলে আশা করছে প্রতিষ্ঠানটি।
এন্ডোটক্সিন ডিটেকশন কিট
এই টেস্টের চাহিদা দৈনিক গড়ে ২ হাজার এবং মাসে গড়ে ৬০ হাজার। কিট আমদানি করা হয় চীন, ভারত, জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। কিটের চাহিদা বছর প্রতি ২ লাখ। তবে এগুলো স্থানীয়ভাবে প্রস্তুত হয়না। সেক্ষেত্রে, প্রতিটি টেস্টের ব্যয় ১৪ হাজার টাকা। কিটের মূল্য ২ হাজার টাকা। অন্যদিকে বিআরআইসিএম বলছে, তাদের উদ্ভাবিত প্রতিটি কিটের মূল্য ৫০০ টাকা।
হেপাটাইটিস-বি সার্পেস এন্টিজেন্ট কিট
এই টেস্টের চাহিদা গড়ে দৈনিক তিন হাজার এবং মাসে গড়ে এক লাখ। কিট আমদানি করা হয় চীন, ভারত, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র ও তাইওয়ান থেকে। প্রতিবছর আমদানি করা হয় ১০ লাখ কিট। টেস্টের ব্যয় ১০৫০ টাকা; যেখানে কিটের মূল্য ২২০ টাকা। অন্যদিকে, বিআরআইসিএম'র উদ্ভাবিত প্রতিটি কিটের মূল্য ১০০ টাকা।
ম্যালেরিয়া
প্রকল্প প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ পার্বত্য অঞ্চলসহ প্রায় ১৩টি জেলায় ম্যালেরিয়ার প্রকোপ অত্যন্ত বেশি। সাধারণত মে থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত বিস্তৃত সময়ে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব বেশি পরিলক্ষিত হয় এবং ঐসময়ে প্রায় ৩ লাখের বেশি টেস্টের চাহিদা সৃষ্টি হয়।
তখন আমেরিকা, চীন, ভারত, কোরিয়া, হংকং প্রভৃতি দেশ থেকে এই সকল কিট আমদানি করা হয়। প্রতিটি টেস্টের জন্য প্রায় ২৫০ টাকা ব্যয় হয়। এক্ষেত্রে, কিটের বাজারমূল্য প্রায় ১০০ টাকা। বিআরআইসিএম কর্তৃক উদ্ভাবিত প্রতিটি কিটের উৎপাদন মূল্য প্রায় ৮০ টাকা।
প্রেগনেন্সি ট্র্যাকিং
এই কিটের মাসিক চাহিদা প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার; বছরে প্রায় ২০ লাখ। কিটসমূহ চীন, ভারত, হংকং, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান থেকে আমদানি করা হয়। হাসপাতালে প্রতিটি টেস্টের মূল্য গড়ে প্রায় ৪০০ টাকা; যেখানে প্রতিটি কিটের বাজার মূল্য গড়ে প্রায় ৭০ থেকে ১০০ টাকা। কিন্তু বিআরআইসিএম কর্তৃক উদ্ভাবিত প্রতিটি কিটের উৎপাদন মূল্য প্রায় ৮০ টাকা।
সার্স-কড-২ ভাইরাস সনাক্তকরণে মাল্টিপ্লেক্স আরটি-পিসিআর কিট
বর্তমানে সার্স-কভ-২ ভাইরাস সনাক্তকরণে দেশে উৎপাদিত কোন টেস্ট কিট নেই। এটি সম্পূর্ণ আমদানি নির্ভর। ফলে ব্যয়বহুল ও বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় সাপেক্ষ। দেশে উৎপাদিত হলে কিটের মূল্য কম হওয়ার ফলে টেস্ট ব্যয় সাশ্রয়ী হবে। একইসাথে টেস্টের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা দূর হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এইচআইভি টেস্ট
এই টেস্টের চাহিদা গড়ে মাসে ১ লাখ এবং বছরে প্রায় ১২ লাখ। কিট আমদানি করা হয় চীন, ভারত, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া ও হংকং থেকে। টেস্টের ব্যয় ৪০০ টাকা; যেখানে কিটের মূল্য ১০০ টাকা। কিন্তু, বিআরআইসিএম কর্তৃক উদ্ভাবিত প্রতিটি কিটের মূল্য ১০০ টাকা।
কোলাজেন বেইজড প্রোডাক্ট
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রসাধনী ও ঔষধ শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে মানব ত্বকের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান কোলাজেন। যে সকল প্রাকৃতিক উৎস হতে কোলাজেন আহরিত হয় তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মাছের আঁশ।
বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে স্বল্পমূল্যে মাছের আঁশ বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে এবং আমরা আমাদের প্রয়োজনীয় কোলাজেন উচ্চমূল্যে বিদেশ থেকে আমদানি করছি।
বিআরআইসিএম মাছের আঁশ থেকে কোলাজেন আহরণের সহজ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে। এর মাধ্যমে আমাদের দেশের মাছের আঁশ থেকে কোলাজেন আহরণের মাধ্যমে মুদ্রা আয় করা সম্ভব বলে প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা হয়েছে।
জিলেটিন
ক্যাপসুল সেল, প্রসাধনী ও খাবারে বহুল ব্যবহৃত একটি উপাদান হলো জেলাটিন, যা মূলত কোলাজেন থেকে তৈরি হয়। আমাদের দেশে ময়লাদ্রব্য হিসাবে বিবেচিত মাছের আঁশ থেকে জিলেটিন আহরণ করা সম্ভব।
মাছের আঁশ থেকে কোলাজেন আহরণের পর অবশিষ্ট অংশ থেকে জিলেটিন আহরণের সহজ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে বিআরইইসএম। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, এর মাধ্যমে জিলেটিন তৈরি করে আমাদের বর্তমান আমদানি নির্ভর চাহিদা পূরণ করে বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব হবে বলে।