আমের মুকুল কম আসায় শঙ্কায় রাজশাহীর কৃষকরা
গত বছরের তুলনায় এ বছর রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলে গাছে কম মুকুল আসায় শঙ্কায় পড়েছেন আমচাষীরা। এরমধ্যে গত কয়েকদিন আগের শিলাবৃষ্টিতে কিছু মুকুল ঝরে পড়েছে; পচন ধরেছে অনেক গাছের মুকুলে।
এমন পরিস্থিতিতে বিশেষ করে বাঘা উপজেলার কৃষকেরা বেশি উদ্বিগ্ন। বাঘার খিরসাপাত, ল্যাংড়া ও গোপালভোগ আমের সুনাম আছে দেশব্যাপী।
রাজশাহীর বাঘার আমচাষী শফিকুল ইসলাম সানা গতবছর প্রায় এক কোটি টাকার আম বিক্রি করেছিলেন। তার মধ্যে ২৬ মেট্রিক টন আম বিদেশে রপ্তানি করেছিলেন তিনি। এবছরও শফিকুল ৩০০ বিঘা জমিতে আমের চাষ করছেন। তবে এবছর গাছে মুকুল কম আসায় কিছুটা হতাশ তিনি।
শফিকুল বলেন, "গতবছর বাঘায় প্রচুর আম হয়েছিল। সে তুলনায় এবছর গাছে মুকুল কম এসেছে, ৫০ শতাংশ মুকুলও আসেনি গাছে। মুকুলগুলো গুটিতে পরিণত হওয়ার মধ্যেই গত কয়েকদিন আগে শিলাবৃষ্টিতে আমের মুকুল ও গুটি ঝরে গেছে।"
"এবার বাঘায় কারও গাছেই আম নেই। বাগান ফাঁকা পড়ে আছে। কৃষকরা সবাই হতাশ," বলেন তিনি।
যদিও বাঘার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শফিউল্লাহ সুলতান আশা প্রকাশ করে বলেন, "গুটিগুলো এখন মটরদানা আকৃতির হয়েছে। এই গুটিগুলোর ২০ শতাংশ টিকলেও আমের ফলন ভালো হবে।"
বাঘার এই কৃষি কর্মকর্তা জানান, গতবছর আমের উৎপাদন হয়েছিল প্রচুর। কিন্তু আমগুলো দেখতে ছোট আকৃতির হয়েছিল। এবার উৎপাদন বেশি না হলেও গুণগত মানসম্পন্ন আম হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
একই কথা জানালেন রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, "গতবছর উৎপাদন বেশি হওয়ায় আমের আকৃতি কিছুটা ছোট হয়েছিল। এবার গুটি কম আসায় আম আকৃতিতে বড় হবে এবং গুণগত মানসম্পন্ন হবে।"
মুকুল কম আসার বিষয়ে তিনি বলেন, গতবছর রাজশাহীতে আমের বাম্পার ফলন হয়েছে। আমের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে একবছর বাম্পার ফলন হলে পরের বছর গাছে কম মুকুল আসে। কারণ গাছ থেকে প্রচুর আম উৎপাদনের পর পরের বছর গাছে খাদ্য কম জমা হয়। খাদ্য কম জমা হওয়াতে গাছে কম মুকুলও আসে।
কৃষিবিদদের মতে, প্রকৃতিতে দীর্ঘ সময় শীতভাব থাকায় এবছর গাছে মুকুল দেরিতে এসেছে। সাধারণত ফেব্রুয়ারির শুরুতে বেশিরভাগ গাছে মুকুল এলেও এবার ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে গাছে মুকুল আসতে শুরু করে।
এবছর বাগান ঘুরে দেখা গেছে, পাশাপাশি দুটি আম গাছের একটি মুকুলে ছেয়ে গেলেও আরেকটিতে মুকুল নেই। বরং সেই গাছটিতে নতুন কচি পাতা গজাতে দেখা গেছে। এমনও দেখা গেছে, একই গাছের একটি ডাল মুকুলে ছেয়ে গেছে, কিন্তু অন্য ডালে কোনো মুকুল আসেনি।
সোমবার সকালে চারঘাটের লাওডারা এলাকার এক আমবাগানে ১০০টি গাছে খুঁজে অল্প কয়েকটাতে গুটি দেখতে পাওয়া যায়। আর সব গাছে শুধু পাতা আর পাতা। নতুন পাতায় ছেয়ে গেছে সব গাছ।
পাশেই চারা বটতলার আর একটি আম বাগানে গিয়েও একই অবস্থা পাওয়া যায়। ওই বাগানে কয়েকশ আম গাছ আছে। খুঁজে দুই-একটা গাছে গুটি দেখতে পাওয়া গেলেও বাকি গাছে পাতা ছাড়া আর কিছুই দেখা যায়নি। যেসব মুকুল টিকে আছে সেখানে এক একটি মুকুলে একটি দুইটির বেশি গুটি আম পাওয়া যায়নি।
চারঘাটের লাওডারা চারা বটতলা গ্রামের কৃষক সাইফুল ইসলাম বলেন, "এবার গাছে খালি পাতা আসছে। কোনো আম নাই।"
আরেক কৃষক মোতালেব হোসেন বলেন, "এবার পাতাই খেতে হবে, আম আর পাওয়া লাগবে না।"
চারাবটতলা এলাকার আমচাষী বিপ্লব জানান, গতবছর ২২ লাখ টাকার আম বিক্রি করেন তিনি। এবছর দুই লাখ টাকার আমও পাওয়া যাবে কি-না তাতে সন্দেহ।
তবে চারঘাট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আল মামুন হাসান জানান, উপজেলায় ৫০ শতাংশ মুকুলে গুটি এসেছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, জেলায় আমবাগানে মোটরদানা আকৃতির গুটি এসেছে ৬৫ শতাংশ, আর তার চেয়ে একটু বড় মার্বেল আকৃতির গুটি এসেছে ৩৫ শতাংশ।
আমচাষী আব্দুর রাজ্জাক জানান, তার বাগানের ৯০০টি গাছের মধ্যে ৫০০টি গাছে গুটি এসেছে। সেগুলোর পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন তিনি। ইতোমধ্যে গাছে দ্বিতীয় দফায় কীটনাশক স্প্রে করা হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, "গতবছর ব্যাপক আম উৎপাদন হয়েছিল। তবে আমের দাম আশানুরূপ না পাওয়ায় লাভবান হওয়া সম্ভব হয়নি। গতবছর ৪ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। এবছর গাছে মুকুল কম আসায় মৌসুমের শুরুতেই দুশ্চিন্তায় পড়তে হচ্ছে।"
রাজশাহীর নগরীর চৌদ্দপাই এলাকায় অবস্থিত বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণাগারের ভেতরের মাঠে ৩৭৬টি আম গাছ তিন বছরের জন্য ১৪ লাখ টাকায় ইজারা নিয়েছেন ইয়াদুল ইসলাম। গতবছর তিনি এই বাগান থেকে ২১ লাখ টাকার আম বিক্রি করেছেন। কীটনাশক স্প্রে করা, আগাছা পরিষ্কার ও সেচ দিতে খরচ হয়েছিল ১৫ লাখ টাকা।
ইয়াদুল ইসলাম বলেন, "এই বছর ইজারার টাকা পরিশোধের শেষ বছর। অথচ ইজারার এখনও ৯ লাখ টাকা বাকি আছে। অন্য জায়গায় মুকুল কম এলেও আমাদের এই বাগানে এবছর মুকুল ভালো এসেছিল, প্রায় ৭৫ শতাংশ গাছে আমের মুকুল এসেছিল।"
"কিন্তু গত কয়েকদিন আগের শিলাবৃষ্টিতে অনেক মুকুলে পচন ধরায় সেগুলো ঝরে পড়েছে। তবে অন্য মুকুলে গুটি এসেছে। ইতোমধ্যে গাছের পরিচর্যায় ৪ লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে। তারপরও প্রাকৃতিক দুর্যোগে মুকুল রক্ষা করতে হচ্ছে," বলেন তিনি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (উদ্যান) সাবিনা বেগম বলেন, "আম প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবেলা করেই টিকে থাকে। এখনো গাছে যে পরিমাণ মুকুল আছে তা টিকে থাকলে, কৃষকরা ঠিকভাবে পরিচর্যা নিলে, আমের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা পূরণ হবে।"
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রাজশাহী অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক মাহমুদুল ফারুক জানান, এবছর নওগাঁয় নতুন আম বাগানে প্রচুর মুকুল এসেছে। তবে অপেক্ষাকৃত কম মুকুল এসেছে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের বড় গাছগুলোতে।
নওগাঁ, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৯৩ হাজার হেক্টর জমিতে আমের উৎপাদন হচ্ছে।