কেন বাংলাদেশিদের জন্য সিঙ্গাপুরে চাকরির বাজার সংকুচিত হচ্ছে?
সামনের মাসগুলোতে সিঙ্গাপুরে দক্ষ শ্রম অভিবাসন কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে চলেছে। কারণ দেশটিতে হ্রাস পাচ্ছে নির্মাণ প্রকল্প। একইসঙ্গে নগর-রাষ্ট্রটি বাংলাদেশিদের জন্য কোটা কমিয়ে অন্যদেশ থেকে শ্রমিক নিয়োগ শুরু করেছে।
কোটা কমানোর জন্য বাংলাদেশি শ্রমিকদের ওপর আস্থা কমে যাওয়ার কারণকে দায়ী করেছেন সেদেশে কর্মী নিয়োগকারীরা। তারা বলছেন, অনেক বাংলাদেশি মিথ্যা বীমা দাবি থেকে শুরু করে এরকম আরও অনেক অপরাধের সঙ্গে জড়িত হওয়ায় এদেশের শ্রমিকদের ওপর থেকে আস্থা কমে গেছে। ফলে বাংলাদেশিদের জন্য কোটা কমিয়েছে সিঙ্গাপুর।
মিয়ানমার এবং ভারতের মতো প্রধান প্রতিযোগীদের টক্কর দেওয়ার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের অভিবাসন কূটনীতিকে দুর্বল হিসেবে দাবি করেছে তারা। এই দেশগুলোর তুলনায় অভিবাসন কূটনীতিতে দুর্বল হওয়ায় বাংলাদেশ সিঙ্গাপুরে বড় পরিসরে শ্রমিক নিয়োগের সুযোগ হারাচ্ছে বলে মত তাদের।
কোটা কমানোর বিষয়ে লেবার সেন্ডিং অর্গানাইজেশনস অব সিঙ্গাপুরের মহাসচিব হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, "মূলত কোভিডের পরপর সিঙ্গাপুরে কর্মীদের একটি ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়েছিল, যার কারণে আমরা কর্মী যাওয়ার ক্ষেত্রে একটি জাম্প (উন্নতি) দেখতে পেয়েছিলাম। কিন্তু এখন সেখানে নির্মাণ কাজ যেমন কমছে, তেমনি বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য কোটাও কমে গেছে।"
"সিঙ্গাপুরে কোনো একটি প্রতিষ্ঠানে একজন সিঙ্গাপুরিয়ানের বিপরীতে আগে সাতজন বাংলাদেশি কর্মী নেওয়া যেত, চলতি বছর থেকে সেটি কমে নেমে এসেছে ৫ জনে," বলেন তিনি।
সম্প্রতিকালে তারা মিয়ানমার এবং ভারত থেকে প্রচুর কর্মী নিয়োগ দিচ্ছে জানিয়ে কিরণ বলেন, "মাইগ্রেশন ডিপ্লোমাসিতে আমরা পিছিয়ে থাকার কারণেই এ সুযোগগুলো কাজে লাগাতে পারছি না।"
"এছাড়া বাংলাদেশি কর্মীদের ওপর নানান কারণে নিয়োগকর্তাদের অনাস্থা তৈরি হয়েছে। মিথ্যা বীমা দাবি করা, নিয়োগকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ দায়েরের মতো প্রভৃতি কারণে নিয়োগকর্তারা এখন অন্য দেশের কর্মীদের প্রতি ঝুঁকে পড়ছেন," যোগ করেন তিনি।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানান, সিঙ্গাপুরে কোভিড-পরবর্তী সময়ে কর্মীর চাহিদা ছিল উল্লেখযোগ্য। ফলে শ্রম অভিবাসন বেড়েছে। তবে সেদেশে নির্মাণ কাজ এখন হ্রাস পাওয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য কোটাও কমানো হয়েছে।
গত বছর বাংলাদেশ থেকে সিঙ্গাপুর প্রতিমাসে গড়ে সাড়ে চার হাজারেরও বেশি কর্মী নিয়োগ হয়েছে। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি)-এর তথ্য অনুসারে, চলতি ২০২৪ সালের প্রথম তিন মাসে সিঙ্গাপুরে নিয়োগকৃত কর্মীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩,৪০০ জনে।
গত বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মীদের জন্য শীর্ষ ৫ গন্তব্যের একটি সিঙ্গাপুর। সেদেশে বেশিরভাগ কর্মীই নিয়োগ হয় নির্মাণখাত ও জাহাজ নির্মাণ শিল্পে। গত বছর বাংলাদেশ থেকে মোট ৫৩,২৬৫ জন শ্রমিক নিয়োগ হয়েছে সিঙ্গাপুরে; ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল রেকর্ড ৬৪,৩৮৩ জন।
সিঙ্গাপুরে বর্তমানে প্রায় ১৫ লাখ অভিবাসী কর্মী কাজ করছেন। ভারত, চীন, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার এবং ফিলিপাইন থেকে আসা বেশিরভাগ কর্মী মিলে দেশটির মোট জনসংখ্যার প্রায় এক ষষ্ঠাংশে দাঁড়িয়েছে। এই কর্মীরা সিঙ্গাপুরের অর্থনীতির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাত যেমন— নির্মাণ, উৎপাদন, হস্পিটালিটি, স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন, সামুদ্রিক ও পেট্রোকেমিক্যালস এবং গার্হস্থ্য কাজে নিয়োজিত রয়েছেন বলে জানিয়েছে সিঙ্গাপুরে অভিবাসী কর্মীদের সহায়তায় নিয়োজিত 'ট্রানজিয়েন্ট ওয়ার্কার্স কাউন্ট টু (টিডব্লিউসি২) নামের একটি সংস্থা।
যদিও সিঙ্গাপুর সরকার জাতীয়তার ভিত্তিতে অভিবাসী কর্মীদের মধ্যে ভেদাভেদ করেনা, এরপরেও পরিসংখ্যানে দেখা যায়— দেশটির নির্মাণ শিল্পে বেশিরভাগ শ্রমিক নিয়োগ হয়েছে বাংলাদেশ, চীন ও ভারত থেকে।
২০১৬ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের হাইকমিশন অনুমান অনুযায়ী, সিঙ্গাপুরে নিয়োগকৃত ১,৬০,০০০ এরও বেশি বাংলাদেশি কর্মীর মধ্যে ৯০ শতাংশের বেশিই নিয়োজিত ছিল নির্মাণ ও সামুদ্রিক ভিত্তিক শিল্পের বিভিন্ন কাজে। (টিডব্লিউসি২, ২০১৭)
স্থানীয় নিয়োগকারীরা বলছেন, বাংলাদেশি কর্মীরা নতুন দক্ষতা অর্জনের ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে। অথচ সিঙ্গাপুরের নিয়োগকর্তারা এখন যাদের একাধিক দক্ষতার সার্টিফিকেট রয়েছে– তাদেরকেই নিয়োগের ক্ষেত্রে বেশি অগ্রাধিকার দেন।
সাধারণত, বাংলাদেশি কর্মীরা নির্ধারিত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে দক্ষতার সার্টিফিকেট পাওয়ার পর সিঙ্গাপুরে যান।
বাংলাদেশে মাত্র ছয়টি বিশেষ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অনুমোদন দিয়েছে সিঙ্গাপুর, যেগুলো প্রায় ২২ ধরনের ট্রেড সনদ প্রদান করে। এর বেশিরভাগই নির্মাণ খাতের সঙ্গে সম্পর্কিত; এগুলো মূলত বেসরকারি নিয়োগকারী সংস্থা দ্বারা পরিচালিত হয়।
বর্তমানে, একটি কেন্দ্র প্রতি মাসে ৭০ জন কর্মীর দক্ষতার পরীক্ষা নিতে পারে, যেখানে কোভিড মহামারি পরবর্তী সময়ে এই সংখ্যা ছিল প্রায় ২০০ এর কাছাকাছি।
রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো এখন প্রতিমাসে আরও বেশি কর্মীর দক্ষতা যাচাই পরীক্ষা নেওয়ার অনুমতি চাইছে, যাতে করে তারা বাংলাদেশ থেকে আরও বেশি কর্মী বিদেশে নিয়োগের ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারে।
বর্তমানে এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো থেকে প্রতিবছর প্রায় ৫,০০০ সিঙ্গাপুর অভিবাসন প্রত্যাশী সার্টিফিকেট নিয়ে বের হচ্ছেন।
নির্মাণখাত কি ছোট হয়ে আসছে?
বাংলাদেশি নিয়োগকারীদের দাবি, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সিঙ্গাপুরের নির্মাণখাতে শ্রমিকদের চাহিদা ক্রমশ কমছে।
তবে, সিঙ্গাপুরের বিল্ডিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন অথরিটির (বিসিএ) জানিয়েছে, চলতি ২০২৪ সালেও এই খাতে উল্লেখযোগ্য নির্মাণ প্রকল্প থাকবে।
চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি বিসিএ জানিয়েছে, ২০২৪ সালে ৩২ থেকে ৩৮ বিলিয়ন ডলারের নির্মাণ চুক্তি সম্পাদন হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
২০২৩ সালে আনুমানিক ৩৩.৮ বিলিয়ন ডলার মূল্যের নির্মাণ চুক্তির কাজ হয়েছিল। যদিও প্রাথমিক নির্মাণ চাহিদার পূর্বাভাসের এই পরিমাণ ছিল ২৭ থেকে ৩২ বিলিয়ন ডলার। দ্য স্ট্রেইট টাইমসের প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।
সিঙ্গাপুরে প্রায় ৯ বছর ধরে কাজ করছেন বাংলাদেশি কর্মী ভোলার রিহান শুভ।
দ্য বিজনেস স্টয়ান্ডার্ডকে তিনি বলেন, "সিঙ্গাপুরে প্রায় ৯৫ শতাংশ বাংলাদেশি কর্মী আসেন নির্মাণ খাতের শ্রমিক হিসেবে। নির্মাণ খাতে তাদের প্লাম্বার, পাইপ পিটিং, ওয়েল্ডিং, ঢালাই, ইলেক্ট্রিশিয়ান, সিসিটিভি ইনস্টলেশন প্রভৃতি কাজে দক্ষতার সার্টিফিকেশন নিয়ে আসতে হয়।"
৯০ শতাংশ বাংলাদেশি কর্মী ভালো আছেন জানিয়ে তিনি বলেন, "এখানে নিয়মকানুন ভাল। বাংলাদেশিরা এসে কেউ বেকার থাকে না।"
আরেক অভবাসী কর্মী জানান, "সিঙ্গাপুরে যেসব ভবন নির্মিত হয় সেগুলো সবই বহুতল। অন্তত ৩৫ থেকে ৭০ তালা পর্যন্ত ভবনগুলো নির্মিত হচ্ছে। তাই সেখানে নির্মাণ কাজের চাহিদা সবসময় থাকে।"
এখনেও কিছু জায়গা খালি আছে জানিয়ে তিনি বলেন, "একসময় নির্মাণ কাজের চাহিদা থাকবে না। এটি এখনই আস্তে আস্তে কমে আসতে শুরু করেছে।"
অভিবাসনের উচ্চ ব্যয় বড় উদ্বেগ হয়ে দাঁড়িয়েছে
মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়ার তুলনায় ভালো বেতনের কারণে সিঙ্গাপুর বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য হয়ে উঠেছে।
নির্মাণখাতে এদেশে একজন বাংলাদেশি মাসে গড়ে ৪০,০০০-৬০,০০০ টাকা আয় করতে পারেন। ওভার টাইম ও দক্ষতার ওপর ভিত্তি করে আয়ের এই পরিমাণ আরও বাড়ার সুযোগ রয়েছে।
তবে দেশটিতে পাড়ি দেওয়ার খরচ অনেক বেশি, যা কর্মীদের জন্য বড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ থেকে সিঙ্গাপুরে যেতে বর্তমানে প্রায় ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ করতে হচ্ছে অভিবাসন প্রত্যাশীদের।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সার্টিফিকেটধারী দক্ষ শ্রমিকদের সিঙ্গাপুরে যেতে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা খরচ হওয়ার কথা থাকলেও যথাযথ মনিটরিং ও জবাবদিহিতার অভাবে এই খরচ প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে।
দক্ষ অভিবাসনের পাশাপাশি অদক্ষ শ্রমিকদেরও সিঙ্গাপুরে অভিবাসনের সুযোগ রয়েছে। তবে নিয়োগকর্তাদের ব্যবস্থাপনায় প্রশিক্ষণ নিয়ে সেসব কর্মীদের সিঙ্গাপুরে গিয়ে দক্ষতার পরীক্ষা দিতে হয়।
খাত সংশ্লিষ্টদের দাবি, এ প্রক্রিয়ায় অভিবাসন ব্যয় হয়ে যায় অনেক বেশি। কারণ এক্ষেত্রে অদক্ষ কর্মীদেরকে সার্টিফিকেটধারী দক্ষ কর্মীদের চেয়ে অনেক বেশি খরচ করে সেদেশে পাড়ি জমাতে হয়।
"এভাবে যারা সিঙ্গাপুরে আসছেন তারা বেশি টাকা দিয়ে আসলেও অনেক সময় স্কিল টেস্টে (দক্ষতার পরীক্ষায়) পাশ করতে পারেন না। ফলে তাদেরকে আবার ফেরত পাঠিয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটে। এতে তারা উভয়কূলই হারাচ্ছেন," বর্তমানে সিঙ্গাপুরে কর্মরত বাংলাদেশি মো. রহিদ মুঠোফোনে টিবিএসকে এ কথা বলেন।
প্রায় ১০ লাখ টাকা খরচ করে সিঙ্গাপুর না যাওয়াই ভালো জানিয়ে তিনি বলেন, "৬০ শতাংশ কর্মীর বেতন হয় ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকার মধ্যে। এই বেতনে এত টাকা খরচ করে না আসাটাই ভালো। আর কিছু টাকা যোগ করে ইউরোপ দিকে যাওয়া ভালো সিদ্ধান্ত।"
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, "সিঙ্গাপুরে কিছু সুনির্দিষ্ট এজেন্সি কর্মী পাঠায়, যারা উভয় দেশের অথরিটি কর্তৃক স্বীকৃত। এটি ঠিক যে, সেখানে অভিবাসন খরচটা অনেক বেশি। বিষয়টি অবশ্যই দেখা উচিত।"
লেবার সেন্ডিং অর্গানাইজেশনস অব সিঙ্গাপুরের কিরণ বলেন, "নতুন শ্রমিকদের জন্য সর্বোচ্চ খরচ ৪ লাখ টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়। তবে আমরা জানি না কীভাবে তারা এই বড় অঙ্কের টাকা দিচ্ছে, আমরাও এ ধরনের অভিযোগ শুনি।"
জানা গেছে, সিঙ্গাপুরে কর্মী পাঠানোর জন্য ১০টি এজেন্সিকে ট্রেনিং সেন্টার স্থাপনের অনুমতি দিয়েছে উভয় দেশের কর্তৃপক্ষ। এসব এজেন্সিকে বিএমইটিতে ৩০ লাখ টাকা জামানত হিসেবে জমা দিতে হয়েছে।
তবে এসব এজেন্সির মাধ্যমে সার্টিফিকেশন পাওয়ার পরেও অন্য যেকোনো বৈধ এজেন্সির মাধ্যমে কর্মীরা মালয়েশিয়া যেতে পারছেন।
জামানত জমা না দিয়েও যারা সিঙ্গাপুরে কর্মী পাঠাচ্ছে, তাদের কারণে শ্রমবাজারটিতে উচ্চ অভিবাসন ব্যয়সহ নানান সংকট তৈরি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
সিঙ্গাপুরে কর্মী পাঠাতে ইচ্ছুক সব এজেন্সির জন্য জামানত জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করলে এখানে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে বলে অভিমত তাদের।