প্রায় শতকোটি টাকা ঋণখেলাপি উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী
পদ্মা ব্যাংক থেকে কয়েক কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ইচ্ছাকৃত খেলাপি হয়েছেন। তবু নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামায় নিজেকে খেলাপি ঘোষণা না করে, মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে চট্টগ্রামের চন্দনাইশ থেকে আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন তিনি।
তবে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশন এর দায় দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোকে (সিআইবি) ।
এই ঋণখেলাপি প্রার্থী জসিম উদ্দীন আহমেদ জেসিকা গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং কক্সবাজারের বিলাসবহুল হোটেল রামাদা, কক্সবাজারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। সংযুক্ত আরব আমিরাত ও চট্টগ্রামে আছে অন্যান্য বাণিজ্যিক সম্পত্তিও।
ব্যাংকের ঋণ শোধ না করায় এ ঋণখেলাপির বিরুদ্ধে দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ও সম্পদ জব্দ করা—এই তিনটি আদেশ রয়েছে আদালতের।
পদ্মা ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১৬ সালে পদ্মা ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে ট্রেডিং ব্যবসার জন্য ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল হিসেবে ৬০ কোটি টাকা ঋণ নেন জেসিকা ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের কর্ণধার জসিম।
ক্যাশ ক্রেডিট-হাইপোথেকেশন ক্যাটাগরিতে নেওয়া এই ঋণ ব্যবসা শেষে এক বছরের মধ্যে পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু সেই ঋণ শোধ হয়নি প্রায় আট বছরেও।
এরমধ্যে ২০২২ সালে সম্পূর্ণ সুদ মওকুফ সুবিধা নিয়ে ঋণটি পুনর্গঠন করলেও শর্ত অনুযায়ী এখনও টাকা পরিশোধ করেননি জসিম। বর্তমানে সুদাসলে প্রায় ৮৮ কোটি টাকা বকেয়া দাঁড়িয়েছে।
এই ঋণের বিপরীতে ব্যাংকটির কাছে নগরীর লালদীঘি এলাকার বাণিজ্যিক ভবন 'মহল মার্কেট'টি জামানত হিসেবে রয়েছে। ১৬.৫৯ শতক জমির উপর নির্মিত সাততলা ভবনটি ঋণ নেওয়ার বছর খানেক আগে মাত্র ৬ কোটি টাকায় কিনেছিলেন জসীম।
ঋণ শোধ না করায় ২০২০ সালের ১৮ জুলাই প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধারের বিরুদ্ধে খেলাপি মামলা (মামলা নম্বর-১০৩/২০২০) দায়ের করে পদ্মা ব্যাংক। পরে চলতি বছরের ২৯ জানুয়ারি ঋণ পুনর্গঠন করেও তা পরিশোধ না করায় জসিমকে সুদসহ ঋণ পরিশোধ করতে বলে মামলার রায় দেন অর্থঋণ আদালত।
মামলাটি এখন 'জারি মামলা' হিসেবে চলছে
এই মামলায় জসিম উদ্দীনের বিরুদ্ধে সর্বশেষ ৩০ এপ্রিল ৫ মাসের দেওয়ানী আটকাদেশসহ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। এর আগে আসামির বিরুদ্ধে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা ও সম্পদ জব্দ করারও আদেশ দেন একই আদালত।
এদিকে ব্যাংকের খাতায় খেলাপি হলেও আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে চট্টগ্রামের চন্দনাইশ থেকে চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়েছেন জসিম উদ্দীন। এমনকি গত ৫ মে মনোনয়নপত্র বৈধ হওয়ার পর নিজের ফেসবুকে পোস্টও করেছেন তিনি।
নির্বাচনি হলফনামায় জসিম উদ্দীন পদ্মা ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে নেওয়া ৬০ কোটি টাকা এবং সোনালী ব্যাংক মতিঝিল শাখা থেকে নেওয়া ১১ কোটি ৬৩ লাখ টাকা ঋণের কথা উল্লেখ করলেও খেলাপির ঘরে লিখেছেন প্রযোজ্য নহে।
অথচ ঋণ খেলাপি হওয়ায় তার বিরুদ্ধে ২০২০ সালের ২৮ জুলাই (মামলা নম্বর-১০৩/২০২০) অর্থঋণ মামলা দায়ের করে পদ্মা ব্যাংক। যা বর্তমানে জারি মামলা হিসেবে চলমান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পদ্মা ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, 'জেসিকা ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের উল্লেখযোগ্য কোনো ব্যবসা নেই। আগে কোনো ব্যবসা ছিল, এমন রেকর্ডও নেই। এরপরও ২০১৫ সালে ৬০ কোটি টাকা ঋণ কিভাবে পেল, তা আমাদের বোধগম্য নয়। এমনকি এই ঋণের বিপরীতে বন্ধক থাকা সম্পত্তির বর্তমান মূল্যও কোনোভাবে ২০ কোটি টাকার বেশি নয়। অথচ সুদাসলে প্রতিষ্ঠানটির কাছে ব্যাংকের পাওনা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯০ কোটি টাকা। এই ঋণ আদায়ে এখন প্রতিদিন আমাদের আদালতপাড়ায় দৌড়াতে হচ্ছে।'
শাখাটির প্রতিষ্ঠাকালীন ব্যবস্থাপক শওকত ওসমান চৌধুরীর যোগসাজশে ব্যবসায় না থেকেও জসিম এই ঋণ পেয়েছেন বলে অভিযোগ করেন ওই কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে পদ্মা ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক শওকত ওসমানের ব্যক্তিগত মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিলেও সংযোগ বন্ধ পাওয়া যায়।
জানতে চাইলে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও রিটার্নিং কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম প্রামাণিক বলেন, 'প্রার্থিতা যাছাইকালে প্রশাসন ও আর্থিক খাতের লোকজন উপস্থিত ছিলেন। সিআবিতে ঋণখেলাপি হিসেবে না দেখানোয় আমরা তার প্রার্থিতা বৈধ ঘোষণা করেছি।'
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে জসিমের ব্যক্তিগত মুঠোফোন এবং তার ব্যক্তিগত সহকারীর মুঠোফোনে কল দিলেও দুজনরই মোবাইল সংযোগ বন্ধ পাওয়া যায়।
'তথ্য গোপন'
চট্টগ্রাম ঋণ আদালতে এ ধরনের মামলা পরিচালনাকারী সিনিয়র আইনজীবী জিয়া হাবিব আহসান বলেন, ঋণের মামলায় সাজা হওয়ার পর তার (জসিম) বিরুদ্ধে 'জারি মামলা' চলমান রয়েছে। ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করা হয়েছে।
জিয়া হাবিব বলেন, 'তবে হলফনামায় নিজেকে তিনি ঋণখেলাপি নন, এমন ঘোষণা দিতে না পেরে তথ্য গোপনের অপরাধ করেছেন।
'নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তার জানানো তথ্যমতে প্রার্থীর সিআইবি রিপোর্ট পরিষ্কার থাকলেও নির্বাচনি প্রক্রিয়া চলাকালে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তা বা প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের খেলাপি ঋণের মামলাগুলোর তথ্য প্রকাশ্যে আনা উচিত ছিল।'
অর্থঋণ আদালতের বেঞ্চ সহকারী রেজাউল করিম বলেন, ইচ্ছাকৃত এই ঋণখেলাপির পক্ষ নিয়ে 'বেআইনি' আবেদন করায় পদ্মা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তারেক রিয়াজ খানকেও কারণ দর্শানোর নির্দেশ দিয়েছেন অর্থঋণ আদালত।
রেজাউল আরও বলেন, গত ২ মে অর্থঋণ আদালত আইনের ৩৪ (৬) ধারা অনুযায়ী, ৮৮ কোটি টাকার ২৫ শতাংশ হিসেবে ২২ কোটি টাকা পরিশোধ না করেই ঋণখেলাপির জামিনের এবং সম্পত্তি অবমুক্ত করার যৌথ আবেদন করে বিবাদী ও পদ্মা ব্যাংক।
নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব ফরহাদ আহমেদ খান বলেন, 'আসলে সিআইবির রিপোর্টই ব্যাংকের ঋণখেলাপিদের সম্পর্কে জানার একমাত্র উপায়। এ ধরনের খেলাপিদের তথ্য যদি সিআইবি রিপোর্টে না আসে, তাহলে এটি তাদের দিক থেকে সমস্যা। এর ওপর আমাদের কোনো হাত নেই।
'আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো রিটার্নিং অফিসার আইনি প্রক্রিয়া মেনে প্রার্থিতা গ্রহণ বা খারিজ করার জন্য মনোনীত ব্যক্তি। কেউ সংক্ষুব্ধ হলে, তিনি বা ব্যাংক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারেন। আপিল কর্তৃপক্ষ আবারও তা দেখবে। তারপর তাদের পদ্ধতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেবে।'
কে এই জসিম? :
নির্বাচনি হলফনামা, ব্যাংক তথ্য ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার উত্তর গাছবাড়িয়া গ্রামের মফজল আহমদের ছেলে জসিম উদ্দীন আহমেদ।
ভাগ্য বদলাতে প্রথমে সৌদি আরব যান স্বশিক্ষিত জসীম। সৌদিতে খুব বেশি সুবিধা করতে না পেরে পরবর্তীতে পাড়ি জমান আরব আমিরাতে। পরে তিনি আবাসন খাতে, বিশেষ করে কক্সবাজার ও দুবাইয়ে আন্তর্জাতিক চেইন হোটেল 'হোটেল রামাদা' গড়ে তুলতে বিনিয়োগ করেন।
চট্টগ্রামের খুলশির অভিজাত এলাকায় ভবন কিনে 'জসিম হিল' নামে গড়ে তুলেন অভিজাত বাড়ি।
ইতিমধ্যে দেওয়া অর্থঋণ আদালতের আদেশে জসিমকে হোটেল রামাদা কক্সবাজারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ নির্বাচনি হলফনামায় ব্যবসার ঘরে জসিম শুধু কক্সবাজারে 'হোটেল আইবিআইএস' লিমিটেড ও জেসিকা ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের কথা উল্লেখ করেছেন।