মোটরসাইকেলের গতি ঘণ্টায় ৩০ কি.মি.– দুর্ঘটনা বাড়ার আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের
সরকার শহরাঞ্চলের মধ্যে মোটরসাইকেল ও ট্রাকের সর্বোচ্চ গতিসীমা ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার নির্ধারণ করে দিয়েছে। একইসঙ্গে, অন্যান্য যানবাহন শহর এলাকায় ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৪০ কিলোমিটার বেগে চলতে পারবে বলে জানানো হয়েছে।
তবে সরকারের সিদ্ধন্তকে স্বাগত জানালেও, এর বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডাররা। এতে দুর্ঘটনা বৃদ্ধিসহ সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা করছেন তারা।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, "কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্য ভালো, তবে এটি একটি অবৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত।"
তার মতে, দেশে বিভিন্ন ধরনের যানবাহন চলাচলের জন্য উপযুক্ত ও নির্ধারিত লেন না থাকায়, একই রাস্তায় ভিন্ন ভিন্ন গতিতে যানবাহন চলাচলের সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তায়ন কঠিন হয়ে উঠতে পারে।
এতে রাস্তায় চলাচলের সময় দ্রুতগতির যানবাহনগুলো ধীরগতির মোটরসাইকেলকে পেছন দিক থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে পারে। অর্থাৎ, এতে দুর্ঘটনার প্রবণতা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
অধ্যাপক হাদিউজ্জামান একই রাস্তায় বিভিন্ন যানবাহনের জন্য ভিন্ন ভিন্ন গতি নির্ধারণের আগে লেন-ভিত্তিক ট্রাফিক ব্যবস্থা বাস্তবায়নের পরামর্শ দেন।
২০৩০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার অর্ধেকে নামিয়ে আনার উদ্দেশ্যে 'মোটরযানের গতিসীমা নির্দেশিকা, ২০২৪' নামের এই বিধিমালাটি জারি করেছে সরকারের সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ।
নীতিমালা অনুযায়ী সিটি করপোরেশন, পৌরসভা এবং জেলা শহরের মধ্যে মোটরসাইকেল ও ট্রাক-লরি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৩০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারবে। অন্যান্য যানবাহনের জন্য এ গতিসীমা ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার।
জাতীয় সড়কে (ক্যাটাগরি বি) বাইকের গতিবেগ হবে ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটার আর গাড়ি-বাস-মিনিবাস চলবে ঘণ্টায় ৭০ কিলোমিটার গতিতে। ট্রাক ও আর্টিকুলেটেড লরির জন্য এই গতিসীমা সর্বোচ্চ ৪৫ কিলোমিটার। জেলা সড়কেও একই গতির মধ্যে থাকতে হবে।
এক্সপ্রেসওয়েতে ও জাতীয় মহাসড়কে (ক্যাটাগরি এ) প্রাইভেটকার, এসইউভি, মাইক্রোবাস, বাস, মিনিবাসসহ অন্যান্য হালকা যানবাহন সর্বোচ্চ ৮০ কিলোমিটার গতিতে চলাচল করতে পারবে এবং ট্রাক, বাইক ও আর্টিকুলেটেড লরির জন্য সীমা হবে ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটার।
স্থানীয় প্রশাসন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, বাজার ও আবাসিক এলাকার কাছাকাছি গতিসীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হবে। তবে সেটা জাতীয় সড়কে ৪০ কিলোমিটার এবং আঞ্চলিক মহাসড়কে ৩০ কিলোমিটারের বেশি হবে না।
সরকারি সিদ্ধন্তকে স্বাগত জানান স্টেকহোল্ডাররা
দুর্ঘটনা রোধে বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের গতিসীমা নির্ধারণ করে দেওয়ার সরকারি এই স্বাগত জানিয়েছেন স্টেকহোল্ডাররা। বিশেষ করে, যেখানে ওভারস্পিডের কারণে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেশি।
তবে, একইসঙ্গে তারা রস্তায় ভিন্ন ভিন্ন যানবাহনের জন্য পৃথক লেন না থাকা ও ট্রাফিক আইনের দুর্বল প্রয়োগে নতুন নীতি কার্যকর করা কঠিন হতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে সঠিক লেন বিভাজনের অভাব রয়েছে। এতে বিভ্রান্তি তৈরি হয় এবং পেছন দিক থেকে আরেক যানবাহনের ধাক্কায় সড়কে দুর্ঘটনা সংঘঠিত হয়।
এছাড়া দেশে যথাযথভাবে ট্রাফিক আইন প্রয়োগ না হওয়ার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, নতুন নির্দেশিকা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে উঠতে পারে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের মতে, ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে সড়ক দুর্ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ২০২৩ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৬,৯১১টি; এতে নিহত হয়েছেন ৬,৫২৪ জন। এরমধ্যে শুধু মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় (২৩.০৪ শতাংশ) নিহত হয়েছেন সবচেয়ে বেশি ২,৪৮৭ জন (৩৮.১২ শতাংশ)।
আর এপ্রিল মাসের সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবেদন বলছে, মোট দুর্ঘটনা ঘটেছে ৫৪৩টি। দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের সংখ্যা ১,১৬৮টি; যার মধ্যে মোটরসাইকেলের সংখ্যা সর্বোচ্চ, ৩৩৪টি (২৮.৫৯ শতাংশ)।
নির্দেশিকায় আরও যা বলা হয়েছে
এদিকে নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, এই নিয়ম অ্যাম্বুলেন্স এবং ফায়ার সার্ভিসের মতো জরুরি পরিষেবা দেওয়া যানবাহনের জন্য প্রযোজ্য হবে না।
গতিসীমা নির্ধারণের নীতিমালায় বলা হয়েছে, এক্সপ্রেসওয়ে ও জাতীয় সড়কে তিন চাকার যান চলাচলের অনুমতি দেওয়া হবে না।
সর্বোচ্চ গতিসীমার এই বাধ্যবাধকতা শুধু স্বাভাবিক অবস্থায় প্রযোজ্য হবে বলে জানানো হয়েছে। তবে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া, প্রখর রোদ, অতিরিক্ত বৃষ্টি, ঘন কুয়াশা ইত্যাদি প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিয়ন্ত্রণযোগ্য নিরাপদ গতিসীমা প্রযোজ্য হবে। দৃষ্টিসীমা বেশি মাত্রায় কমে গেলে বা একেবারেই দেখা না গেলে, মোটরযান চালানো বন্ধ রাখতে হবে।
এক্সপ্রেসওয়ে, জাতীয় মহাসড়ক, আঞ্চলিক মহাসড়ক এবং জেলা সড়কের উভয় দিকের প্রবেশমুখ ও নির্দিষ্ট দূরত্বে যানবাহনভিত্তিক নির্ধারিত গতিসীমা-সংক্রান্ত সাইন, রাস্তা নির্মাণকারী বা উপযুক্ত প্রতিষ্ঠানকে প্রদর্শন করতে হবে।
মোটরযানের শ্রেণি বা ধরন অনুযায়ী, ভিন্ন ভিন্ন গতিসীমার জন্য একই পোস্টে মোটরযানের নাম ও ছবিসংবলিত গতিসীমার সাইন প্রদর্শন করতে হবে। পাহাড়ি এলাকা, আঁকাবাঁকা সড়ক, বাঁক, ব্রিজ, রেল বা লেভেল ক্রসিং, সড়ক সংযোগস্থল, বাজার, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালের সামনে সাইনে প্রদর্শিত গতিসীমা প্রযোজ্য হবে।
নির্দেশিকায় বিশেষ কিছু নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে— সড়ক বাঁক, জংশন, জ্যামিতিক কাঠামো, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, দুর্ঘটনার ঝুঁকি ও অন্যান্য বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সংশ্লিষ্ট রাস্তা নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক মোটরযানের শ্রেণি বা ধরন অনুযায়ী নির্দিষ্ট দূরত্বের জন্য ট্রাফিক সাইন ম্যানুয়াল অনুযায়ী স্ট্যান্ডার্ড ট্রাফিক সাইন পোস্ট ও গতিসীমা প্রদর্শন বা স্থাপন করবে।
বিশেষ নির্দেশে আরও বলা হয়, মালবাহী মোটরযানসহ অন্যান্য স্বল্পগতির মোটরযান সর্বদা সড়কের বাঁ পাশের লেন দিয়ে চলাচল করবে। শুধু ওভারটেক করার সময় ডান লেন ব্যবহার করতে পারবে, কখনো বাঁ লেন দিয়ে ওভারটেক করা যাবে না।
ওভারটেকিং নিষিদ্ধ না থাকলে রাস্তার ট্রাফিক সাইন, রোড মার্কিং দেখে এবং সামনে, পেছনে পর্যাপ্ত ও প্রয়োজনীয় জায়গা থাকলে নিরাপদ পরিস্থিতি বিবেচনায় ওভারটেক করা যাবে। ওভারটেক করার সময় সামনে বিপরীত লেনে আসা গাড়ি এবং পেছনের গাড়ির অবস্থান ও গতিবেগ দেখে ওভারটেকিংয়ের জন্য নিরাপদ দূরত্ব আছে কি না, সে সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে।
বিআরটিএর মুখপাত্র মাহবুব ই রব্বানী বলেন, "আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইন লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। এছাড়া, চালকদেরও কিছু দায়বদ্ধতা রয়েছে।"
নতুন গতিসীমা লঙ্ঘন নিয়ন্ত্রণে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ ব্যবহার করা হবে। অপরাধীদের তিন মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড ও ১০,০০০ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডেই দণ্ডিত করা যেতে পারে।