মালিকানা দ্বন্দ্ব: সি পার্ল গ্রুপের বিরুদ্ধে বেঙ্গল ফাইন সিরামিক্সের কারখানা দখলের অভিযোগ
কোম্পানির মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চলমান দ্বন্দ্বের মধ্যেই আদালত কর্তৃক জারিকৃত ১৪৫ ধারার আদেশ উপেক্ষা করে পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত কোম্পানি বেঙ্গল ফাইন সিরামিক্স লিমিটেডের কারখানা দখলের অভিযোগ উঠেছে পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত আরেক প্রতিষ্ঠান সি পার্ল বিচ রিসোর্টের মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে।
রোববার (২৬ মে) সকালে ঢাকার সাভারে অবস্থিত কোম্পানিটির কারখানা জোরপূর্বক দখলের ঘটনা ঘটে বলে জানা গেছে।
বেঙ্গল ফাইন সিরামিক লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক অভিজিৎ কুমার রায় দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড'কে বলেন, "সকাল ৯টার দিকে সি পার্ল গ্রুপের লোকজন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও কয়েকশ সন্ত্রাসী নিয়ে জোরপূর্বক আমাদের কারখানায় প্রবেশ করে।"
এ সময় হামলাকারীরা কারখানা থেকে আমাদের নিরাপত্তা কর্মী, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের বের করে দিয়ে কারখানা ও অফিস ভবনের দখল নেয়।
এ সময় হামলাকারীরা কারখানার সকল সিসিটিভি ক্যামেরা ভেঙ্গে ফেলে।
অভিজিৎ কুমার রায় বলেন, ২"০০৭ সালে কোম্পানিটি মোটা অংকের দায় মাথায় নিয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আমার পরিবার এক এমওইউ চুক্তির মাধ্যমে কোম্পানির ২৪.২৯ শতাংশ স্পন্সর শেয়ার ক্রয় করে এজিএম এর মাধ্যমে কোম্পানির পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে।"
বিভিন্ন জটিলতা শেষ করে ২০১৯ সালে কারখানাটি পুনরায় সচল করা হয় বলে জানান তিনি।
"পরবর্তীতে আগের মালিকপক্ষ চুক্তি ভঙ্গের অভিযোগ তুলে আবারও কোম্পানির মালিকানা দাবি করে আদালতে একটি মামলা দায়ের করে। পরে এ বিষয়ে উচ্চ আদালত আমার বাবা বিশ্বজিৎ কুমার রায়কেই কারখানা পরিচালনার নির্দেশ দেয়।"
"কিন্তু ২০২৩ সালে এসে আগের মালিকপক্ষ আমাদের কাছে বিক্রিত শেয়ার পুনরায় সি পার্ল বিচ রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা- এর মালিকদের কাছে বিক্রি করে দেয়। বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি সি পার্ল গ্রুপ কয়েক দফায় কারখানাটি দখলের চেষ্টা করলে আমরা আদালত থেকে এ বিষয়ে একটি ১৪৫ ধারার আদেশ নিয়ে আসি, যেন কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে," যোগ করেন অভিজিৎ কুমার রায়।
কিন্তু আদালতের সেই আদেশ উপেক্ষা করেই আজ প্রকাশ দিবালোকে এভাবে কারখানাটি দখল করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এ সময় পুলিশের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা না পাওয়ার অভিযোগ তুলে অভিজিৎ কুমার রায় বলেন, "সাভার মডেল থানার কাছে আদালতের ১৪৫ ধারার আদেশের কপি থাকা সত্ত্বেও পুলিশ আজ নিরব ভূমিকা পালন করেছে। থানা থেকে মাত্র কয়েকশো গজ দূরে এই কারখানা। সকালে আমরা ৯৯৯ এর মাধ্যমে পুলিশকে দখলের এই বিষয়টি অবগত করলে পুলিশ যদিও কারখানায় এসেছে, কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তারা বলছেন, আমরা লিখিত অভিযোগ দিলে তারা ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।"
সাংবাদিকের উপর হামলা
এদিকে সকালে কারখানা দখলের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে সংবাদ সংগ্রহের জন্য গেলে দ্য ডেইলি স্টারের নিজস্ব সংবাদদাতা আকলাকুর রহমান আকাশের উপর হামলার ঘটনা ঘটে।
এ সময় হামলাকারীরা ওই সাংবাদিকের কাছে থাকা মুঠোফোন ছিনিয়ে নিয়ে তাকে এলোপাতাড়ি মারধর করে কারখানা থেকে বের করে দেয়।
পরে গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে প্রথমে সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও পরে সাভার এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
হামলার শিকার সাংবাদিক আকলাকুর রহমান আকাশ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "সকালে বেঙ্গল ফাইন সিরামিক লিমিটেডের কারখানা জোরপূর্বক দখল হচ্ছে, এমন সংবাদ পেয়ে আমি কারখানার সামনে যাই। পরে ভিতরে পুলিশ দেখে আমিও তথ্য সংগ্রহে কারখানার ভিতরে প্রবেশ করি। এ সময় কিছু লোকজনকে সিসিটিভি ক্যামেরা, ডিভিআর, ল্যাপটপ ভাংচুর করে নিয়ে যেতে দেখে আমি আমার মোবাইলে সেই ঘটনায় ছবি তুলতে গেলে শতাধিক লোকজন আমাকে ঘিরে ধরে এলোপাতাড়িভাবে মারধর শুরু করে। এক পর্যায়ে তারা আমার মুঠোফোন কেড়ে নিয়ে আমাকে কারখানা থেকে বের করে দেয়।"
এ বিষয়ে জানতে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও কারখানার ভিতরে উপস্থিত সি পার্ল বিচ রিসোর্টের কোম্পানি সচিব ও গ্রুপটির ডিজিএম মো. তানভীরের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
কারখানায় গেইটে উপস্থিত সি পার্ল গ্রুপের ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মশিউর রহমান টিবিএসকে বলেন, "অবৈধভাবে কারখানা দখলের কোনো ঘটনা ঘটেনি। বরং যারা ছিলেন (বিশ্বজিৎ কুমার রায়) তারাই অবৈধভাবে ছিলেন। আমরা সকালে শান্তিপূর্ণভাবে কারখানায় প্রবেশ করেছি। এছাড়া, কোনো সাংবাদিককে মারধরের বিষয় আমাদের জানা নেই।"
কারখানা পরিদর্শনের পর সাভার মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শাহজামান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমরা ঘটনাস্থলে এসে কোনো বিশৃঙ্খলা পাইনি। মূল মালিক যে কারা, তা আমরা এখনো জানিনা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক পেয়েছি। কেউ অভিযোগ করলে তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।"
এ সময় ১৪৫ ধারা জারি থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা বলেন, "আদেশে কী ছিল, সেটি আদেশের কপি না দেখে বলতে পারছি না।"
সরেজমিনে বেঙ্গল ফাইন সিরামিক্সের কারখানা পরিদর্শন করে দেখা যায়, সি পার্ল গ্রুপের লোকজন ব্যতীত কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিশ্বজিৎ কুমার রায়দের নিয়োগকৃত কোনো কর্মকর্তা, কর্মচারীই কারখানাটিতে নেই।
এ সময় কারখানাটির অভ্যন্তরে অন্তত শতাধিক বহিরাগত লোকজনকে দেখা গেছে। এদের কয়েকজনের সাথে কথা বললে তারা নিজেদের স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতা হালিমের অনুসারী বলে দাবি করেন।
এ সময় সি পার্ল গ্রুপের কর্মকর্তাদের দেখা যায়, কারখানার বিভিন্ন গেইটের পুরাতন তালা ভেঙ্গে নতুন তালা লাগিয়ে দিচ্ছেন তারা। পাশাপাশি কারখানার অভ্যন্তরে যেন সহজে কেউ প্রবেশ করতে না পারে সে বিষয়ে বিভিন্ন নির্দেশনাও দিচ্ছেন।