ঢাকাসহ সারাদেশে যেভাবে পৌঁছায় রাজশাহীর আম
রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও নাটোর জেলা মিলিয়ে গতবছর ৯২ হাজার ৯১৩ হেক্টর জমিতে ১২ লাখ সাত হাজার ২৬৩ মেট্রিক টন আম উৎপাদন হয়েছিল। গড় দাম ৪০ টাকা কেজি হিসেবে এর বাজারমূল্য চার হাজার ৮২৯ কোটি টাকারও বেশি। কেবল রাজশাহীতেই প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা মূল্যের আম বেচাকেনা হয়।
গতবছরের তুলনায় এবার আমের আবাদ কিছুটা বেড়েছে। এবার চার জেলায় ৯৩ হাজার ২২৪ হেক্টর জমিতে আমের আবাদ হয়েছে। ফলনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১২ লাখ ১৯ হাজার ৯১০ মেট্রিক টন। রাজশাহীর আমের ভোক্তা সারাদেশের মানুষ। পরিপক্ক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশালসহ দেশের বিভিন্নস্থানে রাজশাহীর আম পৌঁছে যায়।
রাজশাহী অঞ্চলের আমের সারাদেশ ভ্রমণের এ যাত্রা শুরু হয় বাগান থেকে। পাইকারী ব্যবসায়ী ও আড়তদারেরা সরাসরি বাগান থেকে আম কিনে দেশের বিভিন্নস্থানে সরবরাহ করেন। আম পরিবহনের জন্য সাধারণত ট্রাক, বাস, কুরিয়ার সার্ভিস ও রেলপথ ব্যবহার করেন ক্রেতারা। এ বছর রাজশাহীর আম এখনো পুরোদমে সারাদেশে পৌঁছানো শুরু হয়নি।
বাগান থেকে সরাসরি কেনাবেচা
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, একজন বাগানি সাধারণত কয়েকভাবে তার আম বিক্রি করেন। সরাসরি বাগান থেকে পাইকারদের কাছে, স্থানীয় আড়তদারের কাছে, স্থানীয় বাজারে কিংবা দেশের বিভিন্ন আড়তদারদের কাছে বিক্রি করেন তারা। যিনি আম ক্রয় করেন, তিনি আমের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে বাস, ট্রাক, কুরিয়ার সার্ভিস ও ম্যাঙ্গো স্পেশাল ট্রেনের মাধ্যমে আম পরিবহন করেন।
চারঘাটের আমচাষী মামুনুর রশীদ বলেন, আমের মৌসুমে সারাদেশের পাইকারেরা এ অঞ্চলে এসে সাধারণত বাগান থেকে আম ক্রয় করে নিয়ে যান। অনেকে আবার আমের হাট থেকে আম কেনেন। স্থানীয় আড়তদারেরাও আম কিনে দেশের বিভিন্নস্থানে পাঠান। আম পাঠানোর জন্য ট্রাক ও মিনিট্রাক ব্যবহার করা হয়।
'আমরা শ্রমিক দিয়ে ক্রেটে আম প্যাকিং করে ট্রাক ও মিনিট্রাকে চাপিয়ে আমের আড়তগুলোতে পাঠাই। আড়তদারেরা সে আম আবার পাইকারিতে বিক্রি করেন। আড়তদারেরা আম পেয়ে ব্যাংকে বা বিকাশের মাধ্যমে টাকা পরিশোধ করেন,' জানান মামুনুর রশীদ।
রাজশাহীর বাঘার আমচাষি শফিকুল ইসলাম সানার ৩০০ বিঘা জমিতে আমের বাগান আছে। অন্য আমবাগানিদের তুলনায় তার ফলনও ভালো। তার বাগানের আম সারাদেশে বিক্রি হওয়ার পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানি হয়।
এ আমচাষি বলেন, 'আম সাধারণত আমরা দেশের বিভিন্ন আড়তে পাঠাই। তারা পাইকারিভাবে আম বিক্রি করে বিক্রির ১০ শতাংশ কমিশন রেখে আমাদের অবশিষ্ট টাকা দেন। আবার স্থানীয় বাজারেও আম বিক্রি করি। এছাড়া ম্যাঙ্গো স্পেশাল ট্রেনে সাধারণত ঢাকাতে আম পাঠানো যায়।'
শফিকুল ইসলাম জানান, রপ্তানিকারকদের মাধ্যমে বিদেশে তিনি আম রপ্তানি করেন। 'আমার বাগানের দুই টন হিমসাগর আম আগামীকাল যুক্তরাজ্যে পাঠানো হচ্ছে। ১০০ টাকা কেজি করে রপ্তানিকারকদের কাছে বিক্রি করেছি।'
আমের মোকাম
আম বেচাকেনাকে কেন্দ্র করে রাজশাহীর বানেশ্বর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট ও নওগাঁর সাপাহারে বড় আমের মোকাম বসে। এক থেকে দেড় মাস প্রতিদিন এসব মোকামে আম বেচাকেনা হয়। মোকামে সারাদেশ থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা যেমন আম কিনতে আসেন, তেমনি আবার স্থানীয় আড়তদারেরাও আম কিনে সারাদেশের আড়তে পাঠান।
মোকামগুলোতে বিভিন্ন কুরিয়ার সার্ভিসের শাখা থাকে। আড়ত থেকে এগুলো সরাসরি আম বুকিং নিয়ে দেশের বিভিন্নস্থানে পৌঁছে দেয়। এছাড়া আমের মৌসুমে রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের মহাসড়কের ধারেও শতাধিক অস্থায়ী আমের আড়ত গড়ে ওঠে। বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ আম পরিবহনের জন্য এ সময়টায় ম্যাঙ্গো স্পেশাল ট্রেন চালু করে।
রাজশাহী জেলা প্রশাসনের তৈরি করা 'ম্যাঙ্গো কালেন্ডার' অনুযায়ী রাজশাহীর বানেশ্বর বাজারে গোপালভোগ, হিমসাগর, লখনা ও গুটি আম বিক্রি হচ্ছে। গত বছরের তুলনায় মনে এক থেকে দেড় হাজার টাকা বেশি দামে আম বিক্রি হচ্ছে এবার।
আম পরিবহন পরিস্থিতি
বানেশ্বর বাজারের হাট ইজারাদার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ফলন বিপর্যয়ের কারণে অন্যান্য বছরের মতো এ বছর এখনো আমের হাট তেমন জমে ওঠেনি। 'এখনো ট্রাকে আম লোড শুরু হয়নি। এখন খাওয়ার আম ক্রয় করে ক্রেতারা বাসে ও কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমেই বিভিন্নস্থানে পাঠাচ্ছেন।
জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বেশি আম ক্রয় করা ক্রেতারা সাধারণত ট্রাকে আম পরিবহন করেন। সারাদেশের বিভিন্ন আড়তে রেখে আমগুলো বিক্রয় করা হয়। 'আর যারা পরিবারের লোকজন, আত্মীয়স্বজনের জন্য নেন কিংবা অনলাইনে বেচাবিক্রি করেন, তারা সাধারণত কুরিয়ার বা বাসে আম পাঠান। এক্ষেত্রে সাধারণত ব্যক্তিভেদে ২০ থেকে ৩০ কেজির আম ক্রয় করে পাঠাতে দেখা যায়।'
সুন্দরবন রাজশাহী শাখার এজিএম মাহমুদুল আলম সবুজ বলেন, 'এ বছর রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আম কম পরিবহন হচ্ছে। গতবছর যেখানে প্রতিদিন তিনগাড়ি আম যেত, এবার সেখানে একগাড়ি বা আধাগাড়ি আম যাচ্ছে।'
এসএ পরিবহনের রাজশাহীর শাখার ম্যানেজার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, 'হয়তোবা হিমসাগর নামার পর আম পরিবহন কিছুটা বাড়বে। এখন অল্পকিছু করে দেশের বিভিন্নস্থানে আম যাচ্ছে প্রতিদিন।'
আম পরিবহনের খরচ
কৃষি উদ্যোক্তা ও আম ব্যবসায়ীরা সবাই সাধারণত ট্রাক বা মিনিট্রাকেই আম পরিবহন করেন। এক্ষেত্রে গাড়িপ্রতি খরচ বেশি পড়ে। ৫০০ ক্রেটের একটি ট্রাকে ঢাকায় আম পরিবহনে খরচ পড়ে ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা, চট্টগ্রামে ৩৫ হাজার ও সিলেটে ২৫ হাজার টাকার মতো।
মিনিট্রাকে ১০০ থেকে ২০০ ক্রেট আম পরিবহন করা যায়। তবে সেক্ষেত্রে ভাড়া বেশি পড়ে। একটি মিনিট্রাকে আম পরিবহনের জন্য খরচ হয় ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা। সাধারণত মিনি ট্রাকে ঢাকা, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়াসহ আশপাশের জেলায় আম পরিবহন করা হয়।
অন্যদিকে কুরিয়ার সার্ভিসে ঢাকায় আম পাঠাতে সার্ভিসভেদে কেজিপ্রতি খরচ হয় ১৩ থেকে ১৫ টাকা। আর ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, সিলেটের দিকে কেজিপ্রতি ১৬ থেকে ২০ টাকা খরচ হয়।
ম্যাঙ্গো স্পেশাল ট্রেন
তবে সবচেয়ে কম খরচে আম পরিবহন করা যায় ম্যাঙ্গো স্পেশাল ট্রেনে। কেজিতে মাত্র এক টাকা ৪৩ পয়সা খরচে আম রাজশাহী থেকে ঢাকায় নেওয়া যায়। আগামী ১০ জুন চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে চালু হবে বিশেষ এ ট্রেনটি। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে রহনপুর হয়ে রাজশাহী ও আব্দুল্লাহপুর পার হয়ে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে ঢাকায় পৌঁছাবে এটি।
রেলওয়ের মাধ্যমে নিরাপদে, স্বল্প খরচে ও স্বল্প সময়ে আম পরিবহনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ২০২০ সালে চালু করা হয় ম্যাঙ্গো স্পেশাল ট্রেন। তবে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও নাটোর জেলায় সাড়ে ১২ লাখ মেট্রিক টন আম উৎপাদন হলেও গত চারবছরে মাত্র চারহাজার মেট্রিক টন আম রেলপথে পরিবহন করা সম্ভব হয়েছে।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক সুজিত কুমার বিশ্বাস জানান, ম্যাঙ্গো স্পেশাল ট্রেন চালুর জন্য রেল কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে। 'আমরা রাজশাহী ও চাঁপাইনাবগঞ্জের বিভিন্ন কৃষকদের সঙ্গে সভা করেছি, মাইকিং করেছি ও লিফলেট বিতরণ করেছি।'
এবার আমের উৎপাদন কিছুটা কম হলেও তারপরও আমচাষী ও ব্যবসায়ীরা আম পরিবহনের জন্য ম্যাঙ্গো স্পেশাল ট্রেন ব্যবহার করবেন বলে আশা প্রকাশ করেন এ কর্মকর্তা।