পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালের কার্যক্রম শুরু
চট্টগ্রাম বন্দরের বহুল প্রত্যাশিত পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সোমবার (১০ জুন) সিঙ্গাপুরের পতাকাবাহী 'মার্স্ক দাভাও' নামের একটি কন্টেইনার জাহাজ আজ সকালে টার্মিনালে নোঙর করার মধ্য দিয়ে নিয়মিত পরিচালনা কার্যক্রম শুরু হয়। কর্তৃপক্ষ আশা করছে যে টার্মিনালটি বছরে প্রায় ৫ লাখ বিশ-ফুট সমতুল্য ইউনিট (টিইইউ) পরিচালনা করবে।
পিসিটি চট্টগ্রাম বন্দরের ইতিহাসে প্রথম টার্মিনাল যা একটি বিদেশি সংস্থা 'রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল'দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। এটি বিদেশি বিনিয়োগ এবং অপারেশনাল মডেলের নতুন যুগের সূচনা করে। এই রূপান্তর চট্টগ্রামকে একটি ল্যান্ডলর্ড বন্দর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে, যা বাংলাদেশের সামুদ্রিক অবকাঠামোর জন্য একটি উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন।
সৌদি আরবের জেদ্দাভিত্তিক রেড সি গেটওয়ে টার্মিনালের (আরএসজিটি) সঙ্গে ৬ মাস আগে চুক্তি হয় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের। কাস্টমস আনুষ্ঠানিকতা ও প্রয়োজনীয় ইক্যুইপমেন্ট সংগ্রহ করে রেড সি গেটওয়ে বাংলাদেশ লিমিটেড সোমবার থেকে কাজ শুরু করছে।
বন্দর সংশ্লিষ্টরা জানান, নতুন এ টার্মিনালে বাড়বে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা। কমে আসবে জাহাজের গড় অবস্থানকাল। নতুন নির্মিত এ টার্মিনাল বছরে ৫ লাখ টিইইউএস (২০ ফুট সমমানের) কনটেইনার হ্যান্ডলিং করতে সক্ষম হবে। গত বছর দেশের প্রধান এ সমুদ্রবন্দর ৩০ লাখ ৫০ হাজার টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিং করেছে।
এর আগে সোমবার 'মায়ের্কস দাবাও' নামের একটি কনটেইনার জাহাজ ভেড়ানোর কথা বলেছিলেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক। তিনি আরও বলেছিলেন, এ উপলক্ষে মঙ্গলবার বিদেশি প্রতিষ্ঠানটি টার্মিনালে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে।
সমুদ্রগামী জাহাজের তথ্যসংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইট মেরিন ট্রাফিকের তথ্যে দেখা গেছে, শনিবার দুপুরে জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছে।
বন্দর সূত্র জানায়, দায়িত্বপ্রাপ্ত বিদেশি প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে পিসিটিতে আসা প্রথম জাহাজ মায়ের্কস দাবাও। এটি সিঙ্গাপুরের পতাকাবাহী। মালয়েশিয়ার পোর্ট কেলাং হয়ে কনটেইনার নিয়ে চট্টগ্রাম এসেছে। জাহাজটির দৈর্ঘ্য ১৮৫ দশমিক ৯৯ মিটার ও ড্রাফট (পানির নিচে থাকা অংশ) ৯ মিটার।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, বন্দরের নিজস্ব অর্থায়নে এক হাজার ১৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গা উপকূলে নির্মিত হয়েছে পিসিটি। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) আওতায় সৌদি আরবের আরএসজিটি এ টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব পায়। তারা শর্তসাপেক্ষে আগামী ২২ বছর টার্মিনাল পরিচালনা করবে। গত বছরের ৬ ডিসেম্বর আরএসজিটির সঙ্গে এ বিষয়ে চুক্তি হয়। অবশ্য তার আগেই টার্মিনালের নির্মাণকাজ শেষে উদ্বোধন করা হয়েছিল।
পরীক্ষামূলকভাবে সীমিত আকারে এখানে পণ্যও খালাস করা হয়। তবে গ্যান্ট্রি ক্রেন না আসায় শুরুতেই তারা পূর্ণ সক্ষমতায় যেতে পারছে না বলে জানা গেছে। আপাতত ক্রেনযুক্ত জাহাজ ভেড়ানো হবে। গ্যান্ট্রি ক্রেন আসলে ক্রেনবিহীন জাহাজও হ্যান্ডলিং করা হবে। গ্যান্ট্রি ক্রেন দিয়ে অল্প সময়ে জাহাজে অধিক কনটেইনার ওঠানো-নামানো যায় ।
এর আগে একটি অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়াল অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল জানিয়েছিলেন, সব সরঞ্জাম সংগ্রহ করে পিসিটি পূর্ণ সক্ষমতায় যেতে আরও এক থেকে দেড় বছর সময় লাগতে পারে। শর্ত অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সব ইকুইপমেন্ট সংগ্রহ করবে দায়িত্ব পাওয়া বিদেশি প্রতিষ্ঠান। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ তাদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট হারে চার্জ পাবে।
পিসিটি'তে তিনটি কনটেইনার ও একটি তেল খালাসের (ডলফিন) জেটি রয়েছে। এগুলোতে একসঙ্গে চারটি জাহাজ ভেড়ানো যাবে। কনটেইনার জেটির দুটিতে গ্যান্ট্রি ক্রেন থাকবে। যেখানে ভিড়তে পারবে গিয়ারলেস (ক্রেনবিহীন) জাহাজ এবং অপরটিতে গিয়ার্ড (ক্রেনযুক্ত) জাহাজ। পিসিটির চারটি জেটিতে একসঙ্গে চারটি জাহাজ বার্থিং নিয়ে পণ্য ওঠানামা করার সুযোগ রয়েছে। ফলে বন্দরের বহির্নোঙরে জাহাজের চাপ কমে যাবে। পণ্য খালাসের অপেক্ষায় জাহাজকে দীর্ঘদিন বসে থাকতে হবে না।
উল্লেখ্য, চিটাগাং ড্রাইডক লিমিটেডের পাশ থেকে বোট ক্লাব পর্যন্ত আগেকার বিমানবন্দর সড়কের বাঁকগুলো সোজা করে উদ্ধার করা নদীপাড়ের ৩২ একর জায়গায় পিসিটি নির্মাণ করা হয়।
২০১৭ সালের ৮ সেপ্টেম্বর পিসিটি নির্মাণ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে। বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব তহবিল থেকে প্রায় ১ হাজার ২৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে পিসিটি নির্মাণ করে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নকশা অনুযায়ী সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের তত্ত্বাবধানে দেশীয় প্রতিষ্ঠান ই-ইঞ্জিনিয়ারিং এটির নির্মাণ কার্যক্রম পরিচালনা করে।
২০২২ সালের মাঝামাঝি নির্মাণকাজ শেষ হলেও নানা কারণে চালু হয়নি। অবশেষে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের আওতায় সৌদি আরবের রেড সী গেটওয়ে লিমিটেডের সঙ্গে গত ডিসেম্বরে চুক্তি সম্পাদনের পর তাদের এই টার্মিনালটি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়।