সাবেক এমপি পাপুলের বিরুদ্ধে মামলার তদন্ত শেষ হয়নি সাড়ে ৩ বছরেও
লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলের বিরুদ্ধে 'মানিলন্ডারিং' প্রতিরোধ আইনে দায়ের করা মামলার তদন্ত শুরু হওয়ার পরে সাড়ে তিন বছর কেটে গেছে। প্রথমে গতি দেখালেও পরে তদন্তটি স্থবির হয়ে পড়েছে এবং অসমাপ্ত রয়ে গেছে।
কুয়েতে দায়ের মামলায় গত তিন বছর যাবত সেদেশের কারাগারে সাজাভোগ করছেন পাপুল।
বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের তদন্ত কার্যক্রম শেষ পর্যায়ে। কিন্তু কুয়েত সরকারের কাছ থেকে পাপুলের সম্পদের তথ্য না পাওয়ায় প্রতিবেদন জমা দিতে পারছেন না।
মামলার সিআইডি পরিদর্শক ও তদন্ত কর্মকর্তা মেহেদী মাকসুদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, তারা পাপুলের সম্পদ সম্পর্কে আরও তথ্যের জন্য কুয়েত সরকারকে চিঠি দিয়েছেন।
তিনি বলেন, 'জবাব পেলেই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।'
তবে কবে নাগাদ এটি হতে পারে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারেননি এই কর্মকর্তা।
২০২০ সালের ৭ জুন অবৈধ ব্যবসা, মানবপাচার এবং অর্থ পাচারের অভিযোগে পাপুলকে গ্রেপ্তার করে কুয়েত পুলিশ। পরে তাকে ১৭ দিনের রিমান্ডে পাঠানো হয়। ২০২০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয় তার বিচার কার্যক্রম।
২০২১ সালের ২৮ জানুয়ারি বিচারপ্রক্রিয়া শেষ করে কুয়েতের একটি আদালত পাপুলকে চার বছরের কারাদণ্ড দেওয়ার পাশাপাশি ৫৩ কোটি টাকা জরিমানা করেন।
পরে একটি আপিল আদালত তার কারাদণ্ডের মেয়াদ চার বছর থেকে বাড়িয়ে সাত বছর করেন। সেইসঙ্গে তাকে আরও ৫৬.৩২ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়। পাপুল ২০২০ সাল থেকে কুয়েতের কারাগারে রয়েছেন।
এদিকে ২০২০ সালের ২৫ ডিসেম্বর কাজী পাপুল ও তার মেয়ে কাজী ওয়াফা ইসলামসহ আরও ছয়জনের বিরুদ্ধে ৩৮.২২ কোটি টাকা পাচারের দায়ে মানিলন্ডারিংয়ের মামলা দায়ের করে সিআইডি।
২০২১ সালের শেষের দিকে তৎকালীন সিআইডিপ্রধান মাহবুবুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, পাপুলের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার তদন্ত কার্যক্রম প্রায় শেষ পর্যায়ে। দ্রুত মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।
তদন্তে ধীরগতি
মামলার অগ্রগতি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, প্রথমদিকে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পান সিআইডির ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইমস ইউনিটের তৎকালীন অতিরিক্ত সুপারিন্টেন্ডেন্ট ইকবাল হোসেন।
২০২১ সালের ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত কাজী পাপুল এবং তার স্ত্রী, সন্তান ও শ্যালিকাসহ পাঁচজনের ৫৫টি অ্যাকাউন্টের তথ্য জব্দ করা হয়। এর মধ্যে এককভাবে পাপুলের ১০টি, তার স্ত্রী সেলিনা আক্তারের ১৫টি, শ্যালিকা জেসমিন আক্তারের ১১টি এবং মেয়ে ওয়াফা ইসলামের ৬টি অ্যাকাউন্ট ছিল।
এছাড়া পাপুলের স্ত্রী ও মেয়ের যৌথ মালিকানাধীন আরও ৮টি একাউন্টের তথ্য পায় সিআইডি।
ওই বছরেরই ৮ ফেব্রুয়ারি কুয়েত সরকারের মর্টগেজ লেন্ডিং অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রিটার্নকে (এমএলএআর) তাদের তদন্তে প্রাপ্ত পাপুলের সম্পদের তথ্য চেয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দেন ইকবাল হোসেন।
এরপর ২০২১ সালের এপ্রিলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে ইকবাল হোসেনের জায়গায় আসেন পরিদর্শক মেহেদী মাকসুদ।
সিআইডির একাধিক কর্মকর্তা জানান, প্রথমদিকে সিআইডি মামলাটি বেশ গুরুত্বসহকারে তদন্ত শুরু করে এবং অর্থপাচারসহ পাপুলের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হয়েছিল।
তবে তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হওয়ার পর তদন্ত কার্যক্রম কিছুটা স্থবির হয়ে যায় বলে জানান তারা।
কুয়েতের উত্তরের অপেক্ষায়
সিআইডির এক শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, সিআইডি থেকে পাপুলের সম্পদের তথ্য চেয়ে কুয়েত সরকারের কাছে আবেদন করা হয়েছে। সেটির উত্তর পেলেই চার্জশিট দেওয়া হবে।
ওই কর্মকর্তা বলেন, 'এমএলএআরের বিষয়গুলো মূলত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকে। এখানে সিআইডির কিছু করার থাকে না।'
সিআইডির প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, তদন্ত সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে কুয়েতের এমএলএআরের উত্তর পাওয়া জরুরি।
'উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে,' বলেন তিনি।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন, তিন বছরেও কুয়েতের কাছ থেকে উত্তর না পাওয়ার বিষয়টি অস্বাভাবিক। সঠিক পদ্ধতিতে তথ্য চাওয়া হয়েছে কি না বা সরকারের এ বিষয়ে আন্তরিকতা আছে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, 'আমরা দেখেছি একবার এক বিদেশি রাষ্ট্রদূত মিডিয়াতে বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে
সঠিক পদ্ধতিতে তথ্য চাওয়া হয় না । এছাড়া মানিলন্ডারিংয়ের সঙ্গে জড়িতদের অধিকাংশই ক্ষমতাসীনদের দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে অভিযোগ রয়েছে।'
এ ধরনের মামলার তদন্ত কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করতে বিভিন্ন সংস্থা ও দপ্তরের সমন্বয় করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তিনি । সমন্বিতভাবে কাজ করলে এমএলএআরের মাধ্যমে এসব তথ্য পাওয়া সম্ভব বলে মনে করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক।