সাঁতরে আধা কি.মি নদী পাড়ি দিয়েও যে কারণে ৪ ফাঁসির আসামির শেষ রক্ষা হলো না!
বগুড়া জেলা কারাগারের কনডেম সেলে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত চার আসামি একসঙ্গে ছিলেন ২৬ দিন। ওই সেলে বসেই তারা ছাদ ফুটো করে পালানোর পরিকল্পনা করেন। প্রথমে তারা বাইরে থেকে ছাদ ফুটো করার যন্ত্র সংগ্রহ করেন। এরপর যে জায়গায় ছাদ ফুটো করার পরিকল্পনা করেন, সেখানে কাপড় দিয়ে বসার ঝুলন্ত জায়গা তৈরি করেন। এরপর সেখানে বসেই অ্যালুমিনিয়ামের বালতির হাতল দিয়ে দিনের পর দিন খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ফুটো করেন ইট-সুরকির ছাদ। এছাড়া ব্যবহার করেছিলেন একটি স্ক্রু ড্রাইভার ও লোহার পাত। মানুষ বের হওয়ার সমপরিমাণ ছিদ্র করেন তারা। ওই ছিদ্র তারা গামছা দিয়ে ঢেকে রাখতেন। পরে সুযোগ বুঝে সেই স্থান দিয়ে কৌশলে ছাদের উপরে ওঠেন চার আসামি।
ছাদে ওঠার পর কনডেম সেলের সামনে উন্মুক্ত স্থান ও লোহার খাঁচা পেরিয়ে যান তারা। এরপর তাদের সামনে পড়ে বাইরের উঁচু সীমানাপ্রাচীর। কাপড়, বিছানার চাদর, গামছা, লুঙ্গি গিঁট দিয়ে রশি বানিয়ে ওই প্রাচীর বেয়ে নিচে নেমে যান তারা। তখন সময় মঙ্গলবার (২৫ জুন) দিবাগত রাত প্রায় ৩টা।
করতোয়া নদীর পাড়েই কারাগার। উত্তরে বগুড়া জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, পশ্চিমে পুলিশ সুপার ও পৌর কার্যালয়। চার আসামি চেয়েছিলেন পাড়ি দিয়ে পালাবেন। কিন্তু বেশি দূর যেতে পারেননি, তাদের পালানোর খবর জানাজানি হয়ে যায়। কারাগার থেকে আধা কিলোমিটার দূরে শহরের চেলোপাড়া চাষিবাজারের মাছের আড়ত এলাকা থেকে ভোর সোয়া ৪টার দিকে তাদেরকে আটক করা হয়।
পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তার করেছেন জেলা পুলিশের উপপরিদর্শক খোরশেদ আলম। কীভাবে সেই চার আসামিকে ধরেছেন, তা নিয়ে এই পুলিশ কর্মকর্তা কথা বলেছেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে।
খোরশেদ আলম বলেন, ফাঁসির আসামিরা জেলাখানা থেকে পালিয়েছেন, এই খবর শুনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক টিম রাতেই মাঠে নামে। এই টিমের এক দলের নেতৃত্বে ছিলেন তিনি।
খোরশেদ জানান, করতোয়া নদীর পাড়েই জেলা করাগার। কনডেম সেল যে জায়গায় সেটিও নদীর পাশেই। ঠিক সেই কর্নারেই করতোয়া নদী ও নাটাইপাড়ার মধ্যে একটি পায়ে চলা সংযোগ সেতু রয়েছে। আর উত্তর দিকে জেলা প্রশাসন ভবন। দক্ষিণে সদর উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়। পূর্বদিকে করতোয়া নদী। পশ্চিমে বগুড়া পৌরসভাসহ শহরের জনবহুল এলাকা। ভৌগোলিক এসব দিক বিবেচনা করে তিনি ধারণা করেন, আসামিরা করতোয়া নদী পার হয়ে পূর্ব দিকে যেতে পারেন। বিষয়টি মাথায় নিয়েই তিনি করতোয়া নদীর পূর্ব দিকে খোঁজ-খবর নেওয়া শুরু করেন।
এই পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, করতোয়া নদীর পূর্ব পাড়ের রাস্তা ধরে হেঁটে একসময় চাষীবাজার এলাকায় পৌঁছান তিনি। এ সময় নদীর পানির শব্দ পান। তখন নিচের দিকে তাকিয়ে দেখেন কয়েকজন মানুষ করতোয়া নদীর পানি থেকে তীরে উঠছেন। পরে তাদের ডাক দিলে তীরে এসে বসে পড়েন। এ সময় তারা খুব ক্লান্ত থাকায় দৌড়াতে পারছিলেন না, কারণ জেলখানা থেকে নদী সাঁতার দিয়ে তারা প্রায় আধা কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছেন। এরপর তাদের দেখে সন্দেহ হলে তাদের আটক করেন খোরশেদ। পরে জেলা পুলিশের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও কারা কর্তৃপক্ষ চার আসামিকে শনাক্ত করে।
পালিয়ে যাওয়ার পর পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারকৃতরা হচ্ছেন: কুড়িগ্রাম জেলার ভুরুঙ্গামারী থানার দিয়াডাঙ্গা গ্রামের আজিজুল হকের ছেলে নজরুল ইসলাম ওরফে মজনু (৬০), নরসিংদী জেলার মাধবদী থানার ফজরকান্দি গ্রামের মৃত ইসরাফিলের ছেলে আমির হামজা ওরফে আমির হোসেন (৪১), বগুড়া কাহালু উপজেলার উলট্ট গ্রামের আব্দুল মান্নানের ছেলে জাকারিয়া (৩৪) এবং বগুড়া সদরের কুটিরবাড়ি গ্রামের ইসরাইল শেখের ছেলে ফরিদ শেখ (৩০)। তারা প্রত্যেকেই হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি।
আসামিদের গ্রেপ্তারের পর এক সংবাদ সম্মেলনে তারা কীভাবে পালালেন, সে বিষয়ে জেলা পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী বলেন, 'কারাগার পরদর্শন করে দেখা গেছে, তারা চারজন একইসাথে একটি কক্ষে অবস্থান করতেন। তারা পরিকল্পিতভাবে ছাদ ফুটো করে পরিধেয় বস্ত্র এবং বিছানার চাদর জোড়া দিয়ে রশি বানিয়ে দেওয়াল টপকে পালিয়ে করতোয়া নদী পার হন।'
আসামি পালিয়ে যাওয়ার এই ঘটনায় একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
কারাগার থেকে আসামি পালানোর ঘটনার পরপরই সকালে জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ সুপার, ডিআইজি প্রিজনসহ একাধিক কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এরপর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে জেলা প্রশাসন।
জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, বগুড়া কারাগার অনেক পুরাতন। এটি ব্রিটিশ আমলে তৈরি। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে দেখা গেছে, ভবনের অনেক স্থান নাজুক। ওই চার আসামিকে এ বছরের ১ জুন এখানে নিয়ে আসা হয়। তাদের রাখাও হয়েছিল একই সেলে।
তিনি বলেন, 'আজকে পরিদর্শন করে দেখা গেছে, তারা ছাদের যে অংশে ফুটো করেছেন, সেখানে ছাদে কোনো রড ছিল না। তারা ছাদে গামছা পেঁচিয়ে ফুটো করে। আমরা এসব স্থান সংস্কারের কথা বলেছি। এছাড়া আসামিরা যেদিক দিয়ে পালিয়েছেন, সেখানে নিরাপত্তা চৌকি স্থাপনের কথা বলা হয়েছে।'