‘বাবা সেজে’ ৩ ব্যক্তিকে সরকারি চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল, দুদকের মামলা
বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার এক বীর মুক্তিযোদ্ধা তার সনদ ব্যবহার করে ভুয়া তিন 'সন্তান'কে সরকারি চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন। এ তিনজন বাদেও তার বিরুদ্ধে এভাবে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার একাধিক অভিযোগ রয়েছে। তবে তিনজনকে সনদের মাধ্যমে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন তিনি।
এভাবে সরকারের এক কোটি টাকার বেশি আত্মসাতের অভিযোগে রফিকুল ইসলাম নামক ওই বীর মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে তিনটি পৃথক মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
রফিকুল বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার ক্ষিতারেরপাড়া (রানীরপাড়া) মৃত ফয়েজ উদ্দিন মন্ডলের ছেলে। তিনি সোনাতলা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার। এছাড়া সোনাতলার ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন।
নিজের মুক্তিযোদ্ধা সনদ ব্যবহার করে চাকরি জুটিয়ে দেওয়া ভুয়া তিন সন্তান হলেন আহসান হাবিব হান্নান, বেলাল হোসেন ও ফরহাদ হোসেন। তবে তাদেরকে পালক সন্তান বলে দাবি করেছেন রফিকুল।
এর বাইরে আরও একাধিক ব্যক্তিতে জালিয়াতির মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে রফিকুল দাবি করেছেন, তিনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকায় কেউ প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে তার সম্মানহানির চেষ্টা করছে।
'ছোটবেলা থেকে লালন-পালন করেছি'
বীর মুক্তিযোদ্ধার সনদের মাধ্যমে চাকরি পাওয়া এ তিন ব্যক্তি বর্তমানে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসে কর্মরত আছেন। তবে অভিযোগ ওঠার পর তিনজনকেই সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সোনাতলা উপজেলার দক্ষিন রানীরপাড়া (নয়াপাড়া) এলাকার বাসিন্দা আহসান হাবিবের প্রকৃত বাবার নাম জাফর আলী। ২০২৪ সালে রফিকুল ইসলাম বাবা সেজে আহসানকে মুক্তিযোদ্ধার কোটায় চাকরি পাইয়ে দেন।
আহসান হাবিব বর্তমানে গাইবান্ধা জেলা পুলিশের রিজার্ভ পুলিশে কর্মরত আছেন (সাময়িক বরখাস্ত)।
অন্যদিকে ক্ষিতারেরপাড়ার বেলাল হোসেনের প্রকৃত বাবার নাম মৃত জবেদ আলী। ২০০১ সালে বেলালকে ছেলে সাজিয়ে পুলিশ কনস্টেবল হিসেবে চাকরি পাইয়ে দেন রফিকুল।
বেলাল হোসেন বর্তমানে ঢাকা মহনাগর পুলিশের (ডিএমপি) শাহবাগ ট্রাফিক জোনের এটিএসআই (অ্যাসিস্ট্যান্ট টাউন সাব-ইন্সপেক্টর) হিসেবে কর্মরত আছেন। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
আর একই এলাকার বাসিন্দা ফরহাদ হোসেনের প্রকৃত বাবা জাহিদুল ইসলাম। ফরহাদ রফিকুল ইসলামের মুক্তিযোদ্ধা সনদের বদৌলতে ফায়ার সার্ভিসে চাকরি পেয়েছেন। তিনি এখন ফায়ার সার্ভিস গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি উপজেলায় কর্মরত আছেন (সাময়িক বরখাস্ত)।
রফিকুল ইসলামের স্ত্রীর নাম রেবেকা সুলতানা। এ দম্পতির দুই সন্তান রয়েছে। রফিকুল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমাদের ঔরসজাত সন্তান হলেন রাশেদা আক্তার ও মোশের্দা আক্তার। এ দুজনেরই বিয়ে হয়েছে।'
মুক্তিযোদ্ধা সনদ ব্যবহার করে অন্যের সন্তানকে নিজের সন্তান সাজিয়ে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার বিষয়ে রফিকুল ইসলাম বলেন, 'আমি এ তিনজনকে ছোটবেলা থেকেই লালন-পালন করে আসছি। তাদেরকে লেখাপড়া শিখিয়েছি।'
'তাদের জন্মসনদ, ভোটার আইডি কার্ড থেকে শুরু করে সব ধরনের সনদে বাবার নামের জায়গায় আমার নাম রয়েছে। এ কারণে তিন ছেলেকে আমার সনদ ব্যবহার করে চাকরি পাইয়ে দিয়েছি,' বলেন তিনি।
১ কোটি ৩২ লাখ টাকা আত্মসাৎ; দুদকে মামলা
মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের এক চিঠির পর ডিএমপিতে কর্মরত বেলাল হোসেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন অনুসন্ধান শুরু করে। দুই বছরের অনুসন্ধান শেষে ঘটনার সত্যতা পায় দুদক।
এরপর দুদক বগুড়ার সহকারী পরিচালক জাহিদ হাসান বাদি হয়ে চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি রফিকুল ইসলাম ও তার ভুয়া সন্তানদের বিরুদ্ধে পৃথক তিনটি মামলা দায়ের করেন।
এসব মামলার প্রতিটিতে রফিকুল ইসলামকে ১ নম্বর এবং তার তিন সন্তানকে আলাদাভাবে ২ নম্বর আসামি করা হয়েছে।
একটি মামলায় বলা হয়, রফিকুল ইসলাম ও বেলাল হোসেন মুক্তিযোদ্ধার জাল সনদ ব্যবহার করে চাকরি নিয়ে এ পর্যন্ত সরকারের ৫০ লাখ ১৮ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
অপর দুই মামলায় রফিকুল ও আহসান হাবিব এবং রফিকুল ও ফরহাদ হোসেন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি নিয়ে রাষ্ট্রের যথাক্রমে ৫০ লাখ ১৮ হাজার টাকা ও ৩২ লাখ ৫০ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
দুদক-এর বগুড়া শাখা বলছে, এ তিনজনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরুর পর জালিয়াতি ও প্রতারণার অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গিয়েছে। এর বাইরে অভিযোগ থাকা অন্যদের বিরুদ্ধেও তদন্ত অব্যাহত আছে।
বগুড়া দুদকের সহকারি পরিচালক মো. তারিকুর রহমান টিবিএসকে বলেন, 'প্রতারণার মাধ্যমে সরকারি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়েছে। মামলাগুলোর তদন্ত চলমান।'
'সম্মানহানির চেষ্টা'
স্থানীয়দের অভিযোগ, রফিকুল ইসলাম টাকার বিনিময়ে আরও অনেককে এভাবে চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন।
স্থানীয় গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, আহসান-বেলাল-ফরহাদ ছাড়াও জনৈক সালেক উদ্দিন, রাকিব হাসান ও মৌসুমী আক্তারের বাবা সেজেও বীর মুক্তিযোদ্ধা সনদে চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন রফিকুল।
কিন্তু রফিকুল ইসলাম এসব বিষয় অস্বীকার করে দাবি করেছেন, অন্য কেউ প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে তার বিরুদ্ধে এসব করছে।
দুদকে মামলা হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, একটি মহল তার সম্মানহানি করার জন্য এসব করেছে। 'আমি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। সম্প্রতি আমার স্ত্রী উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান হয়েছেন,' বলেন তিনি।
'তবে মামলায় আমি কারও কাছ থেকে টাকা নিয়েছি, এমন কিছু নেই। আমার ছেলেরা যে বেতন-ভাতা নিয়েছে, তার বিরুদ্ধে দুদক মামলা করেছে,' আরও বলেন তিনি।
এ সময় তিনি জানান, তিনি [মামলার বিষয়ে] আদালতে জবাব দেবেন।