দুর্ঘটনায় শিক্ষার্থীদের প্রাণহানি: সড়ক নিরাপদ হওয়ার আগে আর কত মৃত্যু দেখতে হবে?
দুই বাসের যাত্রী ধরার বেপরোয়া প্রতিযোগিতার কারণে ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই ঢাকায় দুই কলেজশিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর, শুরু হওয়া স্কুল-কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। টানা ১১ দিনের সেই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে একই বছরের সেপ্টেম্বরে সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ পাস হয়।
নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের ৬ বছর পার হলেও শিক্ষার্থীদের জন্য সড়ক যে এখনো নিরাপদ হয়ে উঠেনি, তার প্রমাণ হলো গত সাড়ে পাঁচ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ৫,৬১৯ শিক্ষার্থীর মৃত্যু। এমন তথ্য প্রকাশ পেয়েছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের (আরএসএফ) প্রতিবেদনে।
২০১৯ সাল থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত মোট ৩৪,৪৭৮ জনের মধ্যে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ১৬.২৯ শতাংশ।
সড়ক-পরিবহন আইনটির বাস্তবায়ন হতে না হতেই পরিবহন শ্রমিকদের সংগঠন ধর্মঘট ডাকে। ২০২১ সালে পরিবহন ব্যবসার মালিক-শ্রমিকনেতাদের চাপে সে আইনের ১২৬টি ধারার মধ্যে ২৯টি সংশোধন করে শিথিল করা হয়।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক এবং বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক এম শামসুল হক বলেন, "২০১৮ সালের ঘটনায় মনে হয়েছিল পরিবহন খাতে কিছুটা পরিবর্তন আসবে। কিন্তু আসলে পরিস্থিতি আগের মতোই আছে। তখন ব্রিজ বানিয়ে দায় সারা হয়েছে। রোড সেফটি আইন নিয়ে সংসদে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে এর বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে না।"
"পরিবহন মালিকদের কাছে সরকার জিম্মি হয়ে আছে। এ কারণে সরকার পরিবহন খাতের উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন করতে পারছে না। আবার সরকারের পরিবহন খাত নিয়ে সুষ্ঠু পরিকল্পনারও অভাব রয়েছে।"
তিনি বলেন, "উন্নত দেশগুলোর পরিসংখ্যান বলছে, দুই চাকার যান বানবাহন চার চাকার তুলনায় অন্তত ৩০ গুণ ঝুঁকিপূর্ণ। আর আমাদের দেশে এ হার তো অবশ্যই আরও বেশি। উন্নত দেশগুলো যেখানে মোটরসাইকেল উঠিয়ে দিচ্ছে, আমরা সেখানে মোটরসাইকেল নেওয়ার প্রক্রিয়াকে আরও সহজ করছি। বিক্রেতাদের ইনসেন্টিভ দেওয়া হচ্ছে।"
"আবার সিদ্ধান্ত হয়েছে ৩৫০ সিসির মোটরসাইকেল অনুমোদনের। আমাদের যে সড়ক ব্যাবস্থা তাতে ৩৫০ সিসি যে ব্যাবহার করবে, সে তো গতির ঝড় তুলবেই। আর শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি অনেক বেশি। কারণ তারা বয়সের কারণে একটু বেপরোয়া চালাতে চায়," যোগ করেন তিনি।
সড়ক পরিবহন আইন পাস হলেও আরএসএফ-এর হিসাব বলছে, এর পরের বছর থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত টানা তিন বছর সড়কে শিক্ষার্থী মৃত্যু বেড়েছে। ২০১৯ এ যেখানে ৬৯৩ জন শিক্ষার্থী মারা যায়, ২০২২ সালে তা ছিল ১,৪৩৭ জন।
দুর্ঘটনায় শিক্ষার্থী নিহতের ধরন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মোটরসাইকেরলের চালক ও আরোহী হিসেবে নিহত হয়েছে সর্বাধিক ২,৭৮৩ জন (৪৯.৫২%)।
এছাড়া পথচারী হিসেবে যানবাহনের চাপা/ধাক্কায় নিহত হয়েছে ১,৫৩৪ জন (২৭.৩০%), যানবাহনের যাত্রী হিসেবে নিহত হয়েছে ৭২১ জন (১২.৮৩%) শিক্ষার্থী।
অন্যদিকে, বাইসাইকেল আরোহী হিসেবে নিহত হয়েছে ৪৯৭ জন (৮.৮৪%) এবং অটোরিকশার চাকায় ওড়না/পোশাক পেঁচিয়ে নিহত হয়েছে ৮৪ জন (১.৪৯%)।
মিরসরাই ট্র্যাজেডি
মিরসরাই ট্র্যাজেডি দিবস উপলক্ষে শনিবার 'সড়ক দুর্ঘটনায় শিক্ষার্থীর প্রাণহানি: পরিসংখ্যান ও বিশ্লেষণ' শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে আরএসএফ প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করে।
২০১১ সালের ১১ জুলাই চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে একটি পিকআপ ট্রাক খালে উল্টে গিয়ে ৪২ ছাত্রসহ মোট ৪৫ জন নিহত হন। এই ঘটনার স্মরণে দিনটিকে আরএসএফ 'মিরসরাই ট্র্যাজেডি দিবস' হিসেবে পালন করে। শিক্ষার্থীরা ওইদিন মিরসরাই স্টেডিয়ামে বঙ্গবন্ধু-বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট শেষে ফিরছিল।
আরএসএফ চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এআই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বলেন, "মিরসরাই ট্র্যাজেডির পর থেকে অসংখ্য বড় বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। তবে সড়ক পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য কোনো দীর্ঘমেয়াদী টেকসই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি। যেসব উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, তা মূলত অবৈজ্ঞানিক ও সমন্বয়হীন।"
শিক্ষার্থীদের মধ্যে সড়ক নিরাপত্তা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতে এবং নিহত শিক্ষার্থীদের পরিবারের প্রতি সম্মান ও সমবেদনা জানাতে জাতীয়ভাবে 'মিরসরাই ট্র্যাজেডি দিবস' পালনের আহ্বান জানিয়েছে আরএসএফ।
ড. এআই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, "বিশৃঙ্খল সড়ক পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে একটি দীর্ঘমেয়াদী, সমন্বিত টেকসই পরিবহন কৌশল বাস্তবায়ন করতে হবে।"
বাড়ছে শিক্ষার্থীদের মৃত্যু
প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, উল্লিখিত সময়ে ৫ থেকে ১২ বছর বয়সী ২,৬৪১ জন শিক্ষার্থী স্কুলে যাওয়া-আসার পথে, বাড়ির আশেপাশে খেলার সময় অটোরিকশার ধাক্কায়, বাইকের ধাক্কায়, পণ্যবাহী যানবাহনের ধাক্কায়/চাপায় দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে— যা মোট সংখ্যার ৪৭ শতাংশ। এসব দুর্ঘটনা গ্রামীণ সড়কে ঘটেছে বেশি।
এছাড়া, ১৩ থেকে ২৫ বছর বয়সী শিক্ষার্থীরা বাইকের চালক ও আরোহী হিসেবে বেশি নিহত হয়েছে। এসব দুর্ঘটনা আঞ্চলিক ও মহাসড়কে বেশি ঘটেছে। এই বয়সী ভুক্তভোগীদের সংখ্যা ২,৯৭৮ জন— যা মোট সংখ্যার ৫৩ শতাংশ।
সড়ক-ভিত্তিক নিহতের চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গ্রামীণ সড়কে নিহত হয়েছে ১,৩৩৯ জন (২৩.৮২%); শহরের সড়কে ১,৪৮৬ জন (২৬.৪৪%); আঞ্চলিক সড়কে ১,৬৫১ জন (২৯.৩৮%) এবং মহাসড়কে ১১৪৩ জন (২০.৩০%) ।
এছাড়া, ২০১৯ থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৮৩৩ জন শিক্ষার্থী কানে হেডফোন পরা অবস্থায় অসাবধানতাবশত রেললাইন পারাপারের সময় বা রেললাইন ধরে হাঁটার সময় নিহত হয়েছে।
আরএসএফ শিক্ষার্থীদের মৃত্যুর জন্য বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছে; যেমন— ত্রুটিপূর্ণ রাস্তা এবং অনিরাপদ যানবাহন, নিরাপদ সড়ক ব্যবহার সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব এবং শিক্ষার্থীদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো।
দুর্ঘটনা রোধের উপায়
এই ধরনের দুর্ঘটনা রোধে আরএসএফ বিভিন্ন উপায়ের পরামর্শ দিয়েছে। যেমন— অপ্রাপ্তবয়স্কদের হাতে মোটরসাইকেল ধরিয়ে না দেওয়া বা চালানোর অনুমতি না দেওয়া, সড়কে কঠোর আইন প্রয়োগ করা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সড়ক নিরাপত্তা অভিযান চালানো, সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে শিক্ষকদেরকে প্রশিক্ষণ দেওয়া, পরীক্ষার সিলেবাসে সড়ক নিরাপত্তা বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা, সড়কে ত্রুটিপূর্ণ অনিরাপদ যানবাহন নিষিদ্ধ করা ইত্যাদি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের সড়ক নিরাপত্তা শাখার পরিচালক শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানি বলনে, "সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে আমাদের সচেতনতা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বিশেষ করে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে লিফলেট ও তাদের কাছে রোড সেফটি নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে। মোটরসাইকেলে যেন স্ট্যান্ডার্ড হেলমেট ছাড়া কেউ না চড়ে, সে বিষয়ে আমাদের কঠোর অবস্থান রয়েছে।"
"এ নিয়ে মোবাইল কোর্টও চলমান রয়েছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, যে মোটরসাইকেল চালাচ্ছে তার উপর নির্ভর করে। সতর্কভাবে চলাফেরা করলে দুর্ঘটনা অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব," যোগ করেন তিনি।