‘বাবা তুই গাড়ি বের করলে ওরা গুলি করে মেরে ফেলবে’; মায়ের আশঙ্কাই সত্যি হলো
'বাবা তুই গাড়ি বের করিস না, গাড়ি বের করলে ওরা গুলি করে মেরে ফেলবে।'
ছেলে রনি প্রামাণিকের সঙ্গে মোবাইল ফোনে এটাই ছিল তার মায়ের শেষ কথা। দিনটি ছিল ২০ জুলাই। ওইদিন বিকেল ৪টার দিকেই ফোনে রনির মৃত্যুর খবর পান তার মা। ছেলের মৃত্যুর খবরে তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে।
রনি ঢাকার সাভারে রিকশা চালাতেন। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সেখানেই ভাড়া থাকতেন। তার বাড়ি বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার বুড়িগঞ্জ ইউনিয়নের পঞ্চদাস গ্রামে। এখানে ঝুপড়ি ঘরে একাই থাকেন তার মা শাহানা খাতুন। ছেলের মৃত্যুর পর থেকে এখনো বিলাপ করছেন তিনি।
কোটা আন্দোলনের জেরে সাভারে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে গত শনিবার (২০ জুলাই) মারা যান রনি। স্বামীকে হারিয়ে স্ত্রী সাথী বেগম দুই ছেলে ইভান ও ইয়াসিনকে নিয়ে এখন দিশাহারা। ইভানের বয়স দেড় বছর, আর ইয়াসিনের পাঁচ।
রনির একমাত্র বোন ঢাকাতেই এক পোশাক কারখানায় চাকরি করেন। বাবা দিলবর প্রামাণিক চার বছর আগে মারা গেছেন। বাড়িতে তার মা একাই থাকেন।
সম্প্রতি রনির মায়ের সঙ্গে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা হয়। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, 'আমার ছেলেকে শনিবারে ফোন করেছিলাম। তখন বলেছিলাম- বাবা তুই গাড়ি বের করিস না। গাড়ি বের করলে ওরা গুলি করে মেরে ফেলবে। চাউল এক পোয়া থাকলে তা খেয়েই ঘরে থাকিস। ছেলে বলেছিল- না মা আমি যামু না। পরে বলে- মা, বাহিরে না গেলে আমি খামু কী। তোমার নাতনিরা জিনিসপত্র খায়। আমার কাছে একটা টাকাও নাই।'
তিনি আরও বলেন, 'রনি বলেছিল- মা আমি তো দেশে (বগুড়ায়) ঘুরে যেতে পারব না। বাবার মতো ঢাকা শহরেই আমার মরণ আছে হয়ত। ওইদিনই বিকেল ৪টায় ছেলের মৃত্যুর খবর পাই।'
ছেলের জন্য বিলাপ করতে করতে রনির মা বলেন, 'পেটের দায়ে রিকশা চালাতে গিয়ে আমার ছেলে খুন হলো। ছেলে ওষুধের টাকা না দিলে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। ছেলের কাছে শুধু ওষুধের টাকা নিই। মাসে মাসে ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা দিত আমার ছেলে। এখন আমার ভিক্ষা করা ছাড়া আর কোনো পথ রইল না।'
তিনি বলেন, 'আমার ছেলের স্ত্রী-সন্তানদের এখন কী হবে!' এ সময় সরকারের কাছে সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।
ঘটনার পরদিন ভোরে রনির লাশ বগুড়ায় নিয়ে যান সাথী বেগম। ওইদিন বাদ জোহর জানাজা শেষে তার লাশ দাফন করা হয়।
গ্রামের বাসিন্দারা জানান, রনির বাবা দিলবর দিনমজুর ছিলেন। বছর চারেক হলো তিনি মারা গেছেন। মা শাহানা খাতুন সরকারি জমিতে একটি ঝুপড়ি ঘরে থাকেন। মানুষের সহযোগিতায় কোনো রকমে তার জীবন চলে।
রনির স্বজনদের বরাত দিয়ে স্থানীয়রা জানান, রনি রিকশা নিয়ে সাভার স্ট্যান্ডে যাত্রীর অপেক্ষায় ছিলেন। এ সময় শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কারের দাবিতে সেখানে মিছিল বের করলে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে রনির শরীরে গুলি লাগে। এরপর সাভারের এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
সাথী বেগমের বরাতে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী- তাদের ছোট ছেলে অসুস্থ ছিল। রনির শরীরও ভালো ছিল না। এর মধ্যে শুরু হয় ছাত্র আন্দোলন। আয়-রোজগার কমে যায়। ঘরে চাল-ডাল কিছুই ছিল না। ওষুধও কেনা দরকার। এজন্য ২০ জুলাই সকাল ৯টার দিকে রিকশা নিয়ে বের হন রনি। দুপুর ১২টার দিকে এক প্রতিবেশী ফোন করে জানান যে রনির বুকে গুলি লেগেছে। পরে হাসপাতালে গিয়ে রনির গুলিবিদ্ধ নিথর দেহ দেখতে পান তার স্ত্রী।
সাথী বেগম বলেন, 'ঘরে একবেলা খাওয়ার মতো চাল-ডালও নেই।' সন্তানদের নিয়ে এখন দিশাহারা তিনি।
শিবগঞ্জ থানার ওসি আব্দুর রউফ জানান, সাভারে আন্দোলনের মধ্যে এক রিকশাচালক মারা গেছেন। তার লাশ দাফন হয়েছে।