‘আমার শারীরিক প্রতিবন্ধী বাবার কি দোষ ছিল’, প্রশ্ন ছেলের
'আমার বাবা সোজা হয়ে হাঁটতেও পারতেন না। তার মেরুদণ্ডে সমস্যা ছিল। তিনি প্রতিবন্ধী ভাতা পেতেন। সাভার বাজার এলাকায় ঝামেলার কথা শুনে দুপুর ১টার দিকে আমার ছোট বোন ফোন করে বাবাকে বাসায় চলে আসতে বলে। বাবা তখন বলেছিল দোকান বন্ধ করেছে, বাসায় চলে আসবে। বাবার সাথে এটাই ছিল শেষ কথা।'
মুঠোফোনে কান্নাজড়িত কণ্ঠে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে কথাগুলো বলছিলেন মো. রমজান শেখ। ঢাকার সাভারে গত ২০ জুলাই কোটা আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষ শুরু হলে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তার বাবা মো. কোরমান শেখ (৪৯)।
রমজান বলেন, 'দুপুর ১টা ৪৭ মিনিটে আমার কাকা মো. মোতালেব শেখ ফোন দিয়ে জানান বাবার গুলি লেগেছে। কিছুক্ষণ পর কয়েকজন বাবাকে বাসার দিকে নিয়ে আসছিল। পথে দেখা হওয়ায় আমি সেখান থেকে বাবাকে সাভারের এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানকার চিকিৎসকরা বাবাকে মৃত ঘোষণা করেন।'
কোরমান শেখের গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ী জেলার কালুখালি থানার রতনদিয়া গ্রামে। ছয়-সাত বছর ধরে সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন কাঁচাবাজারে তার একটি মুরগির দোকান আছে। এর আগে ওই বাজারেই সবজির দোকান করতেন তিনি।
রমজান বলেন, 'বাবার পায়ে ও বুকে গুলির চিহ্ন পেয়েছি। বুকে অনেকগুলো ছররা গুলির চিহ্ন ছিল। আর ডান পায়ে ছিল একটি গুলির চিহ্ন।'
ঘটনার দিন রাতেই গ্রামের বাড়িতে কোরমানকে দাফন করা হয়।
কোরমান শেখের পরিবারের সদস্যরা জানান, একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন কোরমান শেখ। তার আয়েই সংসার চলত। তার এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলে মো. রমজান শেখ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের ৪র্থ বর্ষে পড়েন। মেয়ে মিতু আক্তার মিতা একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী। পরিবার নিয়ে সাভারের ডগরমোড়া এলাকার একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন কোরমান।
রমজান বলেন, 'আমার বাবা কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত ছিলেন না। এমনকি কোনো আন্দোলনেও তিনি ছিলেন না।' তার প্রশ্ন- 'আমার শারীরিক প্রতিবন্ধী বাবার কি দোষ ছিল?'
কোরমান শেখের স্ত্রী শিল্পি আক্তার মুঠোফোনে টিবিএসকে বলেন, 'আমার স্বামী এভাবে মারা গেল। কি অপরাধ ছিল তার? বাজারে মুরগির ব্যবসা করে যা আয় করত, তা দিয়েই সংসার, সন্তানদের পড়ালেখার খরচ চলত। এখন কি করবো আমি? সন্তানদের নিয়ে কোথায় যাবো?'
এ সময় তার স্বামীকে যারা হত্যা করেছেন, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন তিনি।
রমজান বলেন, 'ওইদিন সকালে আম্মু বাবাকে বলছিল দোকানে যাওয়ার দরকার নাই। বাবা বলেছিল দোকানে কয়েকটা মুরগি আছে। ওগুলো বিক্রি করেই চলে আসব। সেই যে গেলেন, আর ফিরলেন লাশ হয়ে।'রমজান জানান, গ্রামে তাদের একটি পরিত্যক্ত ঘর রয়েছে। এছাড়া সম্পদ বলতে আর কিছুই নেই তাদের।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে রমজান শেখ বলেন, 'যতদূর জানতে পেরেছি ওইদিন দুপুরে সংঘর্ষ শুরু হলে বাজারের সবাই দোকান বন্ধ করে এদিক-ওদিক দৌড়াতে শুরু করেন। কিছুক্ষণ পর বাবাকে বাজারের বরফকলের ভেতরে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন তারা।'
রবিবার (২৮ জুলাই) দুপুরে সরেজমিনে ওই বাজারে দেখা যায় কোরমান ও তার ভাই মোতালেবের দোকানটি বন্ধ। বাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, কোরমান শেখ নিহত হওয়ার পর তার পরিবারের সবাই লাশ নিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছেন। এখনও ফেরেননি।