দিনভর সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় রণক্ষেত্র বগুড়া, নিহত ৫
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা অসহযোগ আন্দোলনে বগুড়ায় সংঘর্ষের মধ্যে ৫ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে চারজন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। দিনভর সংঘর্ষে হামলা করা হয়েছে জেলার তিন থানায়। বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় আগুন দেওয়া হয়েছে। সদর আসনের এমপির গাড়ি ও বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে রণক্ষেত্র ছিল পুরো জেলা।
নিহতরা হলেন, বগুড়া সদর বানদিঘী এলাকার রিকশাচালক আব্দুল মান্নান (৬৫), গাবতলীর গোরদহ এলাকায় বাসিন্দা জিল্লুর রহমান (৪২) ও উপজেলা পৌর শ্রমিক দলের সহসভাপতি, বগুড়ার শিবগঞ্জের পালিকান্তা পীরব এলাকার বাসিন্দা সেলিম রেজা (৩৪), কাহালু উপজেলার মুনিরুল ইসলাম ও অজ্ঞাত এক যুবক।
তাদের মধ্যে মান্নান শহরের কাঠালতলা এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন। জিল্লুর বগুড়া সদরের হরিগাড়ি এলাকায় বসবাস করতেন। কাহালুর মুরইল এলাকার মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন। আর দুপচাঁচিয়া এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন মুনিরুল।
তাদের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. আব্দুল ওয়াদুদ। তিনি জানান, হাসপাতালে এখনো ভর্তি রয়েছেন ৭৩ জন।
সরকারের পদত্যাগের এক দফা কর্মসূচির অংশ হিসেবে বগুড়া শহরের সাতমাথাসহ বিভিন্ন স্থান অবরোধ করেন আন্দোলনকারীরা। এ সময় দফায় দফায় সংঘর্ষ হয় পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের মাঝে। একপর্যায়ে তিন থানায় হামলা, টিএন্ডটি, সদর ভূমি অফিস, আওয়ামী লীগ কার্যালয়সহ সদর আসনের সংসদ সদস্য রাগেবুল আহসান রিপুর বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
এছাড়া বিটাক বগুড়া কার্যালয়ের মেইন ফটকসহ কম্পিউটার হিউ মেডিকেল কন্ট্রোল রুমের দরজা-জানালা ভাঙচুর করা হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ডাকা অসহযোগ কর্মসূচির কারণে স্থবির হয়ে পড়ে বগুড়া।
বেলা ১১টা থেকে বগুড়া শহর ও আশপাশের এলাকা থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীরা মিছিল নিয়ে আসেন শহরের সাতমাথার দিকে। সকাল থেকে শহরের কলেজ বটতলা, ফুলবাড়ি, বিসিক, মাটিডালী, কলোনী, দত্তবাড়ি, ইয়াকুবিয়া মোড়, মফিজপাগলার মোড়, ঠনঠনিয়া, পলিটেকনিক, বনানী এলাকাসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলার প্রধান বন্দর গুলোতে মিছিল ও সড়কে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন আন্দোলনকারীরা। এসময় পুলিশের সাথে দফায় দফায় সংঘর্ষ বাধে ছাত্র-জনতার। পুলিশকে লক্ষ্য করে তারা ইট-পাটকেল ছোড়তে থাকে। পুলিশও তাদের ছত্রভঙ্গ করতে রাবার বুলেট, টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে।
এদিন শহরের সাতমাথায় আওয়ামী লীগসহ অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীরা সকাল থেকে অবস্থান নেন। আন্দোলনকারীরা শহরের সাতমাথায় আসার চেষ্টা করলে যুবলীগের সাথে তাদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরে আন্দোলনকারীরা তাদের হটিয়ে দেন।
এছাড়া সদর ভূমি অফিস, সদর আসনের সংসদ সদস্য রাগেবুল আহসান রিপুর বাড়ি ও গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এদিন দুপুরে বিটাক বগুড়া কার্যালয়ের মেইন ফটকসহ কম্পিউটার হিউ মেডিক্যাল কন্ট্রোল রুমের দরজা-জানালা ভাঙচুর, সদর থানা, দুপচাঁচিয়া ও শেরপুর থানায় হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
দুপচাঁচিয়ায় নিহত ১
জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনাকারীরা অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে বগুড়া-নওগাঁ মহাসড়কের দুপচাঁচিয়া উপজেলার সামনে সকাল ১০ টার দিকে অবস্থান নেন। সেখানে বিক্ষোভ মিছিল করতে থাকেন। এ সময় উত্তেজিত জনতা নেতা-কর্মীদের উপস্থিতি টের পেয়ে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে হামলা করে। পরে সেখানে থাকা একটি পুলিশ বক্স ভাঙচুর করা হয়। উপজেলা ভূমি অফিসসহ একাধিক সরকারি স্থাপনায় হামলা করা হয়। এ সময় পুলিশের সাথে আন্দোলনকারীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে পুলিশ থানার মধ্যে অবস্থান নেন। তখন আন্দোলনকারীরা থানার গেট ভাঙচুরের চেষ্টা চালায়। পরে থানার মধ্যে থেকে পুলিশ আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করেন। আন্দোলনকারী ও পুলিশের সংঘর্ষের মধ্যে আহত হয়ে মুনিরুল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মারা যান।
বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোছা. শামসুন্নাহার জানান, মুনিরুলের মাথায় গুলি লেগেছিল।
শেরপুরে সংষর্ঘ
এছাড়াও বগুড়ার শেরপুরে পুলিশ বক্সে আগুন ও থানা ঘেরাওয়ের চেষ্টাকালে সংঘর্ষে পুলিশ, সাংবাদিকসহ শতাধিক ছাত্র-জনতা আহত হয়েছেন। এর মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত ৩০ স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। এছাড়া শহরের স্থানীয় বাসস্ট্যান্ডস্থ উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে ঢুকে ভাঙচুর চালায় আন্দোলনকারীরা। রবিবার বেলা এগারোটা থেকে শুরু হয়ে বিকেল চারটা পর্যন্ত দফায় দফায় এই হামলা-ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এসময় পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিনত হয়।
উত্তরে চলেনি যানবাহন
এদিন রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১৬ জেলায় বড় বাস-ট্রাক-মিনিট্রাক চলাচল বন্ধ ছিল। রাস্তায় ছোট ছোট যানবাহন চলাচল করলেও যাত্রী ছিল কম। আন্দোলনকারী বিভিন্ন সড়কে গাছের গুড়ি-বাঁশ ফেলে চলাচলা বাধা সৃষ্টি করে। এছাড়া সড়কে তারা টায়ার জ্বালিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। এ কারণে জরুরি সেবার যানবাহন ছাড়া রাস্তা দিয়ে কেউ চলাচল করতে পারেনি। জেলার সহাসড়কে বড় যান চলাচলও দেখা যায়নি।
উত্তরবঙ্গ পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম জানান, উত্তরবঙ্গে প্রায় ৫০ হাজারের উপরে যানবাহন চলাচল করে। রাস্তায় গাড়ি চলাচল করার কারণে গত ১২ ঘণ্টার মধ্যে আমাদের আটটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। এই কারণে উত্তরবঙ্গের কোনো সড়কে আর বড় যানবাহন চলাচল করেনি।
বগুড়া জেলা পুলিশ সুপার জাকির হাসান জানান, বগুড়া সদর, দুপচাঁচিয়া ও শেরপুর থানায় হামলা করা হয়েছে। এছাড়াও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপর হামলা করা হয়। জেলার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি স্থাপনাতেও হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।