বরিশাল: মেয়র ও অধিকাংশ কাউন্সিলর অনুপস্থিত, নগর ভবন স্বাভাবিক হলেও বিপাকে ওয়ার্ডবাসী
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় আন্দোলনকারীরা বরিশাল সিটি করপোরেশনের ১২ ও ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের দুই কাউন্সিলরের কার্যালয় পুড়িয়ে দেন। এরপর থেকে প্রকাশ্যে আসছেন না এ দুই কাউন্সিলর।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আগুনে ওয়ার্ডবাসীর জন্মনিবন্ধন, ওয়ারিশ সার্টিফিকেটের মতো বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র পুড়ে গেছে।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকেই আত্মগোপনে আছেন বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়রসহ অনেক কাউন্সিলর। করপোরেশনের ৪০টি ওয়ার্ডের মোট ২০–২২ জন কাউন্সিলর কার্যালয়ে আসছেন না।
তবে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মেয়র ও কাউন্সিলরেরা অনুপস্থিত থাকলেও সেবা কার্যক্রম ক্রমশ স্বাভাবিক হচ্ছে।
পুড়েছে গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র
৪ আগস্ট সন্ধ্যায় আন্দোলনকারীরা ভাঙচুর করে পুড়িয়ে দেয় বরিশাল সিটি করপোরেশনের ১২ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আনোয়ার হোসেন রয়েল এবং ১৩ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মেহেদী পারভেজের কার্যালয়।
আগুনে ওয়ার্ডবাসীর জন্মনিবন্ধন, ওয়ারিশ সার্টিফিকেট, প্রত্যয়নপত্রসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নথি পুড়ে যায়। ওই ঘটনার পর থেকে আতঙ্কে প্রকাশ্যে আসছেন না কাউন্সিলর দুজন।
আনোয়ার হোসেন রয়েল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের গুরুত্বপূর্ণ কাগজ কার্যালয়ে রাখা ছিল। সবকিছুই পুড়ে ছাই। অনেক ডকুমেন্টস ছিল আমার ল্যাপটপে। তাও নিয়ে গেছে।'
'আমার হয়তো কার্যালয়, আসবাবপত্র পুড়েছে — কিন্তু মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে সাধারণ বাসিন্দাদের। জন্মনিবন্ধনসহ গুরুত্বপূর্ণ কাগজ পুড়ে যাওয়ায় এগুলো পুনরায় সংগ্রহ করা তাদের জন্য সত্যি কষ্টসাধ্য,' বলেন তিনি।
বর্তমানে বাড়ি থেকে কাজ করার চেষ্টা করছেন বলে জানান এ কাউন্সিলর। 'ঘরে থেকেই যতটুকু পারছি কাজ করছি। কার্যালয় না থাকায় কেউ কেউ বাসায় আসেন। তখন তাদের কাজ করে দিই।'
কার্যালয়ে আসেন না মেয়র
আনোয়ার হোসেন রয়েল এলাকায় ফিরলেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক জনপ্রতিনিধি এলাকা ছেড়েছেন। খোদ সিটি করপোরেশনের মেয়র আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ প্রকাশ্যে আসছেন না।
নির্ভরযোগ্য সূত্র টিবিএসকে জানিয়েছে, মেয়র খায়ের আব্দুল্লাহ বরিশাল ত্যাগ না করলেও ঘরবন্দি অবস্থায় রয়েছেন।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নিরাপত্তার জন্য মেয়র প্রকাশ্যে আসছেন না। ৫ আগস্টের পর থেকে তিনি আর কার্যালয়ে আসেননি।
দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, অফিস না করলেও সকলের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে জনসেবা নিরবচ্ছিন্ন করে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন মেয়র। এছাড়া জুলাই মাসের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ১৪ আগস্ট পরিশোধ করা হয়েছে।
'মেয়র বরিশালেই আছেন এবং নগরভবন সচল রাখতে সর্বাত্মক ভূমিকা রাখছেন। তিনি তার দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে কাজ করবেন বলেও জানান,' নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন এক কর্মকর্তা।
তবে মেয়র আবুল খায়ের আব্দুল্লাহর মুঠোফোনে কল করা হলেও তিনি রিসিভ না করায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
পলাতক ২০–২২ কাউন্সিলর
বরিশাল সিটি করপোরেশনে মোট ৪০টি ওয়ার্ড। এর মধ্যে ৩০টি সাধারণ ওয়ার্ড এবং সাধারণ ওয়ার্ড নিয়ে ১০টি সংরক্ষিত ওয়ার্ড।
বর্তমানে সংরক্ষিত ওয়ার্ড কাউন্সিলরেরা এলাকায় থাকলেও ২০–২২ জন কাউন্সিলর পলাতক রয়েছেন।
১৯ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা আব্দুল্লাহ আল রায়হান বলেন, 'সাদিক আব্দুল্লাহর বাসায় দেওয়া আগুনে আমাদের ওয়ার্ড কাউন্সিলর গাজী নঈমুল হোসেন লিটু পুড়ে মারা গেছেন। তিনি না থাকায় আমরা নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। কবে নাগাদ আবার নির্বাচন ও কাউন্সিলর পাব তা অনিশ্চিত।'
বরিশাল সিটি করপোরেশনের যেসব কাউন্সিল বর্তমানে এলাকাছাড়, তারা হলেন মুন্না হাওলাদার (২ নং ওয়ার্ড), সৈয়দ শামসুদ্দোহা (৪), কেফায়েত হোসেন রনি (৫), খান মো. জামাল হোসেন (৬), রফিকুল ইসলাম খোকন (৭), সৈয়দ হুমায়ুন কবির লিংকু (৯), জয়নাল আবেদীন হাওলাদার (১০), শাকিল হোসেন পলাশ (১৪), সামজিদুল কবির (১৫), সাহিন শিকদার (১৬), আকতার উজ্জামান গাজী (১৭), জিয়াউল হক (১৮), জিয়াউর রহমান (২০), শেখ সাঈদ আহমেদ মান্না (২১), এনামুল হক বাহার (২৩), সুলতান মাহমুদ (২৫), হুমায়ুন কবির (২৬), মনিরুজ্জমান তালুকদার (২৭), হুমায়ুন কবির (২৮), ইমরান মোল্লা (২৯) ও খায়রুল মামুন (৩০)।
সংরক্ষিত ১ নং ওয়ার্ড (সাধারণ ১, ২, ৩) কাউন্সিলর ডালিয়া পারভীন বলেন, সিটি করপোরেশনে সাধারণ ওয়ার্ডের পুরুষ কাউন্সিলর অনেকেই বর্তমানে এলাকায় নেই। বিভিন্ন কারনেই তারা এলাকায় ফিরছেন না।
'এতে নারী কাউন্সিলরদের ওপর কাজের চাপ বেড়েছে। আমার কার্যালয় নিয়মিত খুলছি। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মানুষের ভিড় লেগেই থাকছে। পুরুষ কাউন্সিলরেরা এলাকায় ফিরলে কাজের চাপ কমে আসবে,' বলেন তিনি।
স্বাভাবিক হচ্ছে নগর ভবন, বিপাকে ওয়ার্ডবাসী
গণআন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের অস্থিরতায় তিন-চারদিন নগরভবনে নাগরিক সেবা বিঘ্নিত হলেও বর্তমানে স্বাভাবিক অবস্থায় কার্যক্রম চলছে বলে দাবি করেছেন কর্মকর্তারা। সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইসরাইল হোসেনের তত্ত্ববধায়নে কার্যক্রম চলছে।
তবে যে-সব কাউন্সিলর এলাকায় আছেন, তাদের দ্বারা নাগরিক সুবিধার কাজ চললেও অন্য ওয়ার্ডগুলোতে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষ।
৫ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা শাওন বলেন, তার ওয়ার্ড কাউন্সিলর কেফায়েত হোসেন রনি বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বরিশাল সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর ঘনিষ্ঠ ছিলেন। সরকার পতনের পর তিনি [রনি] পালিয়েছেন।
'খুব শীঘ্রই যে এলাকায় ফিরতে পারবেন, তা বলা যাচ্ছে না। এদিকে আমরা খুব অসুবিধায় পড়েছি। তার কার্যালয়ে আমাদের বেশকিছু কাগজ আটকে আছে,' বলেন শাওন।
৩ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর সৈয়দ হাবিবুর রহমান ফারুক বলেন, 'রাজনৈতিক দলের কাউন্সিলরেরা এলাকা ছেড়েছেন। তবে আমার কোনো সমস্যা হয়নি। আমি নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছি। আরো কয়েকজন এলাকায় আছেন।'
নগর ভবনে প্রথম ২–৩ দিন একটু সমস্যা হয়েছিল, তবে এখন সবই স্বাভাবিক উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'মূলত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এখন নগর ভবনের তত্ত্বাবধায়ন করছেন। আশা করছি, দিন যত যাবে, আরও স্বাভাবিক হবে পরিস্থিতি।'
জনসংযোগ কর্মকর্তা আহসান উদ্দিন রোমেল বলেন, 'নগর ভবনে সব সেবাই স্বাভাবিক গতিতে চলছে। আশা করছি ওয়ার্ড পর্যায়েও দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে।'