টাঙ্গাইলে ফলচাষে বিপ্লব ঘটাচ্ছে স্প্রিঙ্কলার সেচ পদ্ধতি
টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার হুমায়ুন কবির ৫১ একর কৃষি জমির কিছু অংশে আনারস ও জি-৯ কলা চাষ করছেন।
স্থানীয় এক কৃষকের দেখাদেখি সম্প্রতি নিজের কৃষি খামারে তিনিও ১.২০ লাখ টাকা ব্যয়ে আধুনিক স্প্রিঙ্কলার প্রযুক্তি স্থাপন করেছেন।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, "পুরনো পদ্ধতির তুলনায় স্প্রিঙ্কলার সেচের সুবিধা বেশি। এতে বিদ্যুত খরচ কম হয় এবং ফলন ভালো হয়।"
স্প্রিঙ্কলার সেচ পদ্ধতি অবলম্বন করে হুমায়ুনের মতো টাঙ্গাইলের ফল চাষীরা (ড্রাগন ফল, আনারস ও কলা) চাষাবাদে বিপ্লব ঘটাচ্ছেন।
কৃষক এবং কৃষি কর্মকর্তারা বলেছেন, অনেকেই এখন ফল চাষে এই সেচ পদ্ধতি অবলম্বন করছেন, কারণ এতে ব্যাপকভাবে খরচ কমার পাশাপাশি পানি ও সেচের সময় বেঁচে যাচ্ছে।
স্প্রিঙ্কলার সেচ পদ্ধতিতে ফসলের উপর বৃষ্টির পানির মতো করে পানি ছেটানো। এতে পুরো ক্ষেতে সমানভাবে পানি পৌঁছায়, যা ফসলের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
গবেষণার বরাতে পল্লী-কর্ম সহায়ক সংস্থা (পিকেএসএফ) কর্মকর্তারা বলছেন, আধুনিক প্রযুক্তি অর্থাৎ স্প্রিঙ্কলার বা ড্রিপ ইরিগেশনের ফলে বিদ্যুৎ বিল কমেছে ৭৫%। পানির অপচয় কমেছে প্রায় ৮০%। কমেছে শ্রমিকের খরচও। মোট কথা কারও সেচের জন্য আগে ৪ দিন লাগলে এখন এখন তা ২৪ ঘণ্টায় হচ্ছে।
চাষীদের দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সাধারণত ১ বিঘা পরিমাণ ড্রাগন বাগানে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে বছরে শ্রমিক খরচ ২৫ হাজার টাকা লাগে। স্প্রিঙ্কলার ইরিগেশনে লাগে সাড়ে ১২ হাজার। আর ড্রিপ (গাছের গোড়ায় ফোটায় ফোটায় পানি) ইরিগেশনে খরচ হয় ৯ হাজার টাকা। একই পরিমাণ জমিতে সেচের জন্য ম্যানুয়ালি বিদ্যুৎ খরচ হয় ৭ থেকে ১২ হাজার টাকা। আর স্প্রিঙ্কলারে খরচ হয় ৪ থেকে ৭ হাজার টাকা। ড্রিপ ইরিগেশনে খরচ হয় ২ থেকে ৩ হাজার টাকা।
এক বিঘা জমিতে ম্যানুয়ালি প্রায় ৬০ লাখ লিটার পানি লাগে। স্প্রিঙ্কলারে লাগে ৩৬ লাখ লিটার। আর ড্রিপ ইরিগেশনে লাগে ১৮ লাখ লিটার।
টাঙ্গাইলে কৃষকদের মাঝে এই প্রযুক্তির পরিচয় ঘটিয়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সোসাইটি ফর সোস্যাল সার্ভিসের (এসএসএস)। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরও একে সময়োপযোগী প্রযুক্তি হিসেবে উল্লেখ করেছে।
টাঙ্গাইল জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. কবির হোসেন বলেন, "জেলায় বড় বড় কৃষি খামারিরা কৃষিবান্ধব আধুনিক এই প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন। এটি অনেক উন্নত। এটি ব্যবহার করতে পারলে খুবই ভালো। এতে খরচ খুব কম হয়। পানির অপচয় রোধ করা সম্ভব। বাণিজ্যিকভাবে যারা বাগান করেন তাদের জন্য অত্যন্ত ভালো। উন্নত বিশ্বে এই প্রযুক্তি ব্যবহার হয়ে আসছে। আবহাওয়ার দিক বিশ্লেষণ করলে কৃষি এসব প্রযুক্তি বিকশিত হওয়া দরকার।"
ঘাটাইলের আলেক সিকদার ১৩ একর জমিতে ড্রাগন চাষ করে এলাকায় বিপ্লব ঘটিয়েছেন। স্প্রিঙ্কলার প্রযুক্তি ব্যবহার করে সুফল তিনিও পেয়েছেন। জানালেন, এভাবে বাগানে পানি দেওয়ার ফলে গাছগুলো গোসল করে সতেজ হয়। বন্যা পদ্ধতির মাধ্যমে সেচ দিয়ে কোনোভাবেই গাছের উপরে পানি দেওয়া সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, "এখন উৎপাদিত ফল দেখলেই মনে হয় সতেজ ও নিরাপদ। স্বীকার করতেই হবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এসএসএসের পরিচয় করিয়ে দেওয়া স্প্রিঙ্কলার কৃষকবান্ধব আধুনিক প্রযুক্তি।"
সোসাইটি ফরসোস্যাল সার্ভিসের নির্বাহী পরিচালক আব্দুল হামিদ ভূইয়া জানান, "টাঙ্গাইল ফল উৎপাদনে সমৃদ্ধ জেলা। এখানে অনেক বড় বড় উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে। পানি-খরচ সাশ্রয় করে আধুনিক কৃষি ব্যবস্থার মাধ্যমে উন্নত ও নিরাপদ ফসল উৎপাদন আমাদের লক্ষ্য। এই প্রযুক্তি কৃষির প্রায় সব ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যাবে। এতে উপকৃত হবে দেশ ও জনগণ।"
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, অন্য ফলের হিসাব না থাকলে টাঙ্গাইলে ১৯ হাজার হেক্টর জমিতে ফল (আম, কাঠাল ও আনারস) চাষাবাদ হয়। এসব চাষাবাদেও ভূ-গর্ভস্থ পানি ব্যবহার করতে হয়।
মুধুপুর ও ঘাটাইল উপজেলা অনেক কৃষক বহুমাত্রিক সুবিধার কারণে এখন পানি সাশ্রয়ী আধুনিক সেচ ব্যবস্থার মধ্যে এসেছেন। এতে কিছুটা রক্ষা হবে পানির মতো অমূল্য এই সম্পদ।
গত কয়েক বছর ধরে তাপমাত্রা ব্যাপকভাবে বাড়ার কারণে ড্রাগনের চাষাবাদ নিয়ে চিন্তায় ছিলেন টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার মো. আবদুর রশিদ। অতিরিক্ত তাপদাহে জ্বলে যাচ্ছিল ড্রাগন গাছের পাতা। বন্যা পদ্ধতিতে প্রতিদিন সেচ দিয়েও রক্ষা হচ্ছিল না। তবে বর্তমানে তিনি চিন্তামুক্ত।
রশিদ বলেন, "এখন বাগানের সবগুলো গাছে স্প্রিঙ্কলার সেচ ব্যবস্থাপনা স্থাপন করে সুষমভাবে বৃষ্টির মতো করে পানি দেওয়া হচ্ছে। এতে খরচ কমেছে। বেড়েছে ফলনও।"
আগামীতে তিনি অন্য ফসলেও স্প্রিংলার পদ্ধতিতে জমিতে পানি সেচ দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন।
কৃষি বিজ্ঞানীদের মতে, বর্তমানে আবহাওয়ার বৈরীতার কারণে ফল পুষ্ট কম হচ্ছে। স্বাদ কমে যাচ্ছে। কিন্তু বৃষ্টির মতো পানি অথবা ড্রিপ ইরিগেশন পদ্ধতিতে পানি ও গাছের প্রয়োজনীয় খাদ্য দেওয়া গেলে ফল পুষ্ট ও স্বাদ হবে।
এসব দিক বিবেচনা করে রুরাল মাইক্রোএন্টারপ্রাইজ ট্রান্সফরমেশন প্রজেক্টের (আরএমটিপি) মাধ্যমে উচ্চমূল্যের ফল-ফসলের জাত সম্প্রসারণ ও বাজারজাতকরণ দেশে এই উপ-প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এই প্রকল্পে অর্থায়ন করছে আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিল (ইফাদ), পল্লীকর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) ও ডানিডা।
পিকেএসএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. নমিতা হালদার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, এই প্রকল্পের মাধ্যমে মানসম্মত সেবা, উপকরণ এবং প্রযুক্তি সহজলভ্যকরণ, উৎপাদিত পণ্যের বাজার সংযোগ নিশ্চিতকরণ ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন ঘটছে। পাশাপাশি, ভোক্তাদের নিকট নিরাপদ ও পুষ্টিগুণসম্পন্ন পণ্য পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।
সংস্থাটি জানায়, এই প্রকল্প টাঙ্গাইল, নওগাঁ, দিনাজপুর, খাগড়াছড়ি, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংসহসহ দেশের মোট ১২টি জেলায় বাস্তবায়িত হচ্ছে। এখানে অন্তত ৫৮ হাজার চাষী আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন।