‘সিস্টেম লসের’ নামে বছরে ১ বিলিয়ন ডলারের গ্যাস চুরি হচ্ছে: ইজাজ হোসেন
'সিস্টেম লস' এর নামে বছরে ১ বিলিয়ন ডলারের গ্যাস চুরি হয়ে যাচ্ছে বলে দাবি করেছেন বিশিষ্ট জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ইজাজ হোসেন।
বুধবার (৪ আগস্ট) ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম অব বাংলাদেশ (আইবিএফবি) কনফারেন্স সেন্টারে এক সেমিনারে ড. ইজাজ আরও বলেন, "সিস্টেম লস (বর্তমান লস ৯.৮২) যদি অর্ধেক কমানো যায়, তাহলে বছরে ৫০০ মিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করা সম্ভব হবে। অর্থাৎ, আমদানি সাশ্রয় করার সুযোগ রয়েছে।"
২০১৪ সালে তিতাস গ্যাসের সিস্টেম লস (পদ্ধতিগত ক্ষতি) হ্রাস সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে, বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ সিস্টেম লসকে এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে, যেটি ব্যবহারযোগ্য গ্যাসের পরিমাণের সঙ্গে হিসাব করা হয় না। অর্থাৎ, গ্যাস বিতরণকালে কারিগরি বা অন্যান্য কারণে যে পরিমাণ গ্যাস নষ্ট হয়ে যায়, সেটিই হলো গ্যাসের সিস্টেম লস বা পদ্ধতিগত ক্ষতি।
এটি বিভিন্ন কারণে হতে পারে; যেমন— মিটারিং সিস্টেম ও সরঞ্জামের ত্রুটি, মিটার টেম্পারিং করা কিংবা মিটার ছাড়াই সংযোগ দেওয়া, অবৈধ সংযোগ স্থাপন অথবা বিতরণকালে সিস্টেমের পাইপলাইনে ফুটোসহ বেশ বিভিন্ন কারণে এই সিস্টেম লস হতে পারে।
আইবিএফবি ও এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ারের যৌথ উদ্যোগে 'বাংলাদেশের বিদ্যুৎ, জ্বালানি খাত সংস্কারের চ্যালেঞ্জ' শীর্ষক সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন।
আইবিএফবি সভাপতি হুমায়ুন রশীদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ার পত্রিকার সম্পাদক মোল্লাহ এম আমজাদ হোসেন।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন বলেন, "এলএনজি আমদানি সমর্থন করি, তবে এটা সীমিত রাখতে হবে। দেশীয় গ্যাস উৎপাদন ও অনুসন্ধান কার্যক্রম জোরদার করার বিকল্প নেই। আমরা যদি নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ জ্বালানি সরবরাহ দিতে চাই তাহলে এ খাতে আমদানি ব্যয় দাঁড়াবে ২৪ বিলিয়ন ডলারে, যা আমাদের অর্থনীতির জন্য খুবই জটিল।"
তিন বলেন, "আমাদের দেশীয় গ্যাস ফিল্ডগুলোর মজুদ কমে যাওয়ায় উৎপাদন কমে যাচ্ছে। আমরা যদি বর্তমান উৎপাদন ক্ষমতা ২,০০০ মিলিয়ন ঘনফুট ধরে রাখতে চাই, তাহলে বছরে কমপক্ষে ১০ অনুসন্ধান কূপ খনন করতে হবে। আমরা এক সময় ২,৮০০ মিলিয়ন উৎপাদন করতাম, আমাদের অনুসন্ধান কার্যক্রমের অভাবে তা কমে গেছে। পৃথিবীর কোনো দেশে উৎপাদন কমে যাওয়ার নজির দেখাতে পারবেন না।"
মোল্লাহ আমজাদ হোসেন বলেন, "বাংলাদেশের বিদ্যুৎ জ্বালানি খাতের দেনার পরিমাণ ৫ বিলিয়ন ডলার। গত ১৫ বছরে বিদ্যুতের দাম ১২৮ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। জ্বালানির দায় মিটিয়ে সরবরাহ নিশ্চিত করা না গেলে অর্থনীতি ঝুঁকিতে পড়বে। ইতোমধ্যে গার্মেন্টে ৬ শতাংশ রপ্তানি কমে গেছে, যা আমাদের জন্য ঝুঁকির।"
"২০৩০ সালে কয়লা আমদানি করতে হবে ১৫ মিলিয়ন টন। দেশীয় কয়লার বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসা দরকার। শিল্পে গ্যাসের পাশাপাশি অন্যান্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে হবে," যোগ করেন তিনি।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ম তামিম বলেন, "ক্যাপাসিটি পেমেন্ট নিয়ে কথা হয়, এখানে অব্যহৃত ক্যাপাসিটির পেমেন্ট কতো, সেটা দেখা উচিত। সেখানে যদি কারচুপি হয়ে থাকে তার ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তেমনি, বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা যখন ২৩ হাজার মেগাওয়াটে পৌঁছেছে, তখন ক্যাপটিভ দিয়ে দেখানো হলো। সরকার সারাক্ষণ হস্তক্ষেপ করেছে, পেট্রোবাংলার সিদ্ধান্ত মন্ত্রণালয়ে গিয়ে পলিটিক্যাল কারণে বদলে গেছে।"
তিনি আরও বলেন, "সরকার উন্নত আয়ের পরিকল্পনা ধরে ২০ বছরে ৯ শতাংশ জিডিপি গ্রোথ ধরে জ্বলানি খাতে পরিকল্পনা করেছে। আয় ১২ হাজার ডলার ধরে, মাথাপিছু ভাগ করে দেওয়া হয়েছে।"
"আমরা বলেছি আমদানি নির্ভরতা কমাতে হবে, শেভরনের মতো অন্য ফিল্ডগুলোতে উৎপাদন বাড়ানো সুযোগ রয়েছে। ডাবল ট্যাক্স অনেক জায়গায়, যে কারণে দাম বেড়ে যাচ্ছে। বিজনেসকে বাঁচাতে হবে, না হলে ফরেন কারেন্সিতে টান পড়বে," যোগ করেন তিনি।
আইবিএফবি সহসভাপতি এমএস সিদ্দিকী বলেন, "প্রথম থেকে যখন সংকট শুরু হয়, আমরা অন্তবর্তীকালীন ব্যবস্থার দিকে গেছি, ভাগভাগির মাধ্যমে করা হয়েছে। প্রতিযোগিতা না থাকলে স্বচ্ছতা থাকে না, প্রতিষ্ঠান দাঁড়ায় না। প্রগতি ইন্ডাস্ট্রির গাড়ি সরকার ছাড়া কেউ কেনে না। আইন করে বিনা টেন্ডারে তাদের থেকে বেশি দামে কেন কিনতে হবে?"
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট শওকত আজিজ রাসেল বলেন, "ম্যাক্স পাওয়ারকে কাজ দেওয়া হয়েছে ৩ টাকা বেশি দরে। ৩ টাকা বেশি মানে ঘণ্টায় তার ৩ লাখ টাকা বেশি। দেশের লোকাল কোম্পানি রাতারাতি সিঙ্গাপুরী কেম্পানি হয়ে গেলো, আগে দেশে দিতাম, এখন সিঙ্গাপুরে ডলার পৌঁছে দিচ্ছি।"
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক প্রকৌশলী রাজিব হায়দার বলেন, "১.০২ ট্রিলিয়ন টাকা ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। গ্যাস চুরি হচ্ছে, ক্যাপসিটি চার্জ দিচ্ছি, সব নিতে হচ্ছে আমাদেক (ব্যাবসায়ীদের)।"
"হঠাৎ করে দাম বেড়ে যাচ্ছে, কিন্তু আমার চুক্তি দীর্ঘ মেয়াদি, আমরা ফাটা বাঁশের মধ্যে পড়ে আছি, রপ্তানিকারকের পাস্থ্রু করার কোনো পথ নেই। বায়ারকে তো আর বলতে পারছি না আমাদের গ্যাসের দাম বেড়েছে।"
"আজকে কারখানায় গ্যাস চাপ পেয়েছি ২.৫ পিএসআই, আমার ২টি জেনারেটর বন্ধ। ৪০-৫০ শতাংশ যদি অব্যবহৃত থাকে তাহলে মুখ থুবড়ে পড়বে ব্যবসা। গ্যাসের দাম কমাতে হবে, এই দাম দিয়ে শিল্প টিকিয়ে রাখা যাবে না," যোগ করেন তিনি।