বন্যা দুর্গতদের নতুন সংকট এখন মাথা গোঁজার ঠাঁই নিয়ে
ফেনীর পরশুরাম উপজেলার উত্তর কাউতলী গ্রামের বাসিন্দা আমেনা আক্তার ৬ বছর আগে স্বামীকে হারিয়ে দুই ছেলেকে নিয়ে রাস্তার পাশে একটি টিনের ঘরে বসবাস করতেন। সাম্প্রতিক বন্যায় আমেনার ঘরটি ভেঙে ভেসে যায় বানের পানিতে।
আমেনা আক্তার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "বন্যার পানির স্রোত থেকে আমাদের জীবন ছাড়া আর কিছুই বাঁচাতে পারিনি।"
তিনি বলেন, "২১ তারিখ রাতে হঠাৎ করে ২-৩ ঘণ্টার মধ্যে খাটের ওপরে পানি উঠে যায়। পানির স্রোতের গতি এতোই বেশি ছিল যে, পানির সাথে ঘরের অর্ধেকটাই ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এখন ভাঙা অংশের টিনের নিচে থাকছি। বৃষ্টি হলেই ভিজে যাই। মাথা গোঁজার জায়গাটুকু করাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।"
বন্যার সময় দুই সন্তান নিয়ে কোনোভাবে পাশ্ববর্তী একটি মাদ্রাসা ভবনের দোতলায় আশ্রয় নিলেও আমেনার ঘর ও মূল্যবান জিনিসপত্র সব ভেসে গেছে পানির স্রোতে।
আমেনা আরও জানান, "আমাদের বাড়ি একেবারে সীমান্তের কাছাকাছি হওয়ায় এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে সেভাবে ত্রাণ পৌঁছায়নি। ২/১ বার শুকনা খাবার পেলেও আমাদের আশ্রয়ের জন্য কেউ পাশে দাঁড়ায়নি।"
"আমাদের খাবার লাগবে না, একটু মাথাগোঁজার ঠাঁই চাই সরকারের কাছে। দুই ছেলেকে বাধ্য হয়ে এখন এতিমখানায় রাখতে হয়েছে," যোগ করেন আমেনা।
এ আক্ষেপ শুধু আমেনারই নয়, ফেনীর প্রায় সবগুলো উপজেলার অধিকাংশ নিম্নবর্তী ও মধ্য-নিম্নবর্তী পরিবারগুলো বন্যায় সবকিছু হারিয়ে এখন নিঃস্ব প্রায়। এমনকি, পাকা বাড়িগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অনেক স্থানে। বিশেষ করে, মুহুরী নদীর পাড় ঘেঁষে গ্রাম ও বাঁধ ভাঙা এলাকাগুলো বন্যার পানির তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড অবস্থা।
গত ২ দিন ফেনী জেলার সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরশুরাম, ফুলগাজী, দাগনভূঞা, ছাগলনাইয়ার প্রায় ১০টি গ্রাম ঘুরে বন্যার ভয়াবহতা দেখেন এই প্রতিবেদক। এসব উপজেলার অধিকাংশ এলাকা থেকে বন্যার পানি নেমে গেলেও রেখে গেছে ভয়াবহ ক্ষত।
অধিকাংশ কাঁচা বাড়ির চাল পর্যন্ত পানি পৌঁছে গিয়েছিল। ভাসিয়ে নিয়ে গেছে অনেক কাঁচাবাড়ি। এসব বাড়ির বাসিন্দারা অশ্রয় নিয়েছিলেন আশপাশের বহুতল ভবন, মসজিদ, মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এমনকি, অনেক বাসিন্দাদের উঁচু ব্রিজের ওপরেও বাধ্য হয়ে আশ্রয় নিতে হয়েছিল।
ফেনীর অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলার পরশুরামের ১ নং মির্জানগর ও ৩ নং চিথলিয়া ইউনিয়ন ঘুরে দেখা যায়, সীমান্তবর্তী গ্রাম নিজকালিকাপুরের মুহুরী নদীর বাঁধ ভেঙে আশপাশের এলাকায় পানি প্রবেশ করে ঘরবাড়ি ও গাছপালা উল্টে ফেলে। পানিতে নষ্ট হয়েছে শত শত একর ফসলের ক্ষেত।
পরশুরামের ৯ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা পঞ্চাষোর্ধ নূরজাহান বেগম টিবিএসকে বলেন, "আমরা একটা মাদ্রাসাতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলাম। বন্যার প্রথম এক সপ্তাহ শুধু শুকনা খাবার খেয়ে থাকতে হয়েছে।"
"এদিকে এত পানি ছিল যে, উদ্ধারকারীরাও আসতে পারেনি। বাধ্য হয়ে বন্যার দূষিত পানি খেতে হয়েছে। কোনোভাবে জীবন নিয়ে বাড়িতে ফিরতে পারলেও এখন ঘরে থাকার মতো পরিস্থিতি নেই।"
তিনি আরও বলেন, "ঘরের মেঝে কাদায় ভরা, রান্নার চুলা নষ্ট; লেপ-তোশক, কাপড়-চোপড় সবই প্রায় ভেসে গেছে, যতটুকু আছে তাও ব্যবহার অনুপযোগী। আমাদের ত্রাণ দরকার নেই, মাথার ওপর একটু ছাদ দরকার। সরকারের কোনো সহায়তা আমরা পাইনি।"
দাগনভূঞা মাতুভূঞা বাজার এলাকার একটি বিদ্যালয়ের চারতলা ভবনে এখনও প্রায় ১০০ পরিবার আশ্রয় নিয়ে আছেন। তাদের বাড়ি থেকে পানি নেমে গেলেও বিধ্বস্ত বাড়িগুলো এখনও সারিয়ে উঠতে পারেনি বাসিন্দারা।
আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা মঈন আহমেদ টিবিএসকে বলেন, "কাঁচা ঘরের মেঝের মাটি সরে গিয়ে দুমড়েমুচড়ে আছে কাঠ ও টিন। লোকজন নিয়ে ঠিক করাও সম্ভব হচ্ছে না, কারণ সবার বাড়িরই একই অবস্থা। তাই দিনে গিয়ে বাড়ি মেরামত করছি এবং রাতে এসে আশ্রয়কেন্দ্রে থাকছি। এখানে কোস্ট ফাউন্ডেশন নামের একটি সংস্থা আমাদের তিনবেলাই খাবার দিচ্ছে।"
ফেনী সদর উপজেলার মোটবী ইউনিয়নের প্রায় ১০০টি জেলে পরিবার নদীর পাড়ে বসবাস করায় সবার ঘরই পানিতে ডুবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভাসিয়ে নিয়ে গেছে বেশ কয়েকটি ঘর। পানি কমে গেলেও অনেকে এখন পর্যন্ত ঘর ঠিক করতে পারেনি।
এ এলাকার ঘর হারানো মিনতি রানী টিবিএসকে বলেন, "স্বামী নেই, ৪ মেয়ে নিয়ে অসহায় অবস্থায় আছি। আমার ঘরের একটি পাতিলও রক্ষা করতে পারিনি। কোনোভাবে কয়েকটি টিন দিয়ে এখন থাকছি। সরকার কিংবা কোনো সংস্থা যদি এখন আমার ঘর তুলে না দেয়, তাহলে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে বাঁচতে হবে।"
এ এলাকার আর এক বাসিন্দা কমলা রানী দাস বলেন, "৪২টি মুরগি, ৭টি হাঁস ছিল সব ভেসে গেছে। আমরা একটি স্কুলে আশ্রয় নিয়েছিলাম, সেখান থেকে বাধ্য করায় চলে আসতে হয়েছে, কিন্তু আমাদের ঘর এখনও ঠিক করতে পারিনি। আমার এক ছেলে ডিগ্রি পড়ে, তার সার্টিফিকেট পর্যন্ত ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। ঘুমের মধ্যে দেখি পানি উঠেছে।"
ভারতের ত্রিপুরা থেকে নেমে আসা পানির ঢলে গত মাসে ফেনীসহ দেশের পূর্বাঞ্চলের ১১টি জেলার বন্যায় অন্তত ৭১ জনের প্রাণহানি হয়। বন্যাকবলিত ৬৮টি উপজেলায় প্রায় ৬ লাখ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়ে। এর এ বন্যায় ফেনী জেলায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। ফেনীতেই মারা গেছেন ২৯ জন।
পরশুরাম উপজেলার ইউএনও আফরুজা হাবিব শাপলা টিবিএসকে বলেন, "আমাদের দুইটি ইউনিয়নে প্রায় সবগুলো ঘরই ভেঙে পড়েছে। মুহুরী নদীর পাড়ে ও বাঁধ ভাঙা এলাকা হওয়ায় প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের বাড়িঘর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব এলাকায় ত্রাণও কম পৌঁছেছে। এখন আমরা চেষ্টা করছি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার এবং বিভিন্ন এনজিও এর মাধ্যমেও সহায়তা পৌঁছানো হচ্ছে।"
ফেনীর জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মুসাম্মৎ শাহিনা আক্তার বলেন, "ফেনীতে বন্যায় ৬৪ হাজার ৪১৫টি বসতঘর আংশিক ও সম্পূর্ণ ধসে গেছে। বিভিন্ন এনজিও খাবার সহায়তা দিলেও শেল্টারের সহায়তা খুবই কম পাচ্ছে।"
"আমরাও বিভিন্ন উপজেলার তালিকা প্রস্তুত করছি, সে অনুযায়ী আমরা সরকারের পক্ষ থেকেও শেল্টারের ব্যবস্থা করছি," যোগ করেন তিনি।
স্টার্ট ফান্ড বাংলাদেশের সহায়তায় কোস্ট ফাউন্ডেশন ফেনীর বর্তমান সংকটে বন্যা দুর্গতদের পাহসে দাঁড়িয়েছে।
গত সাত দিনে, তারা ৮টি আশ্রয়কেন্দ্রে ১,৮০০ জনের মধ্যে রান্না করা খাবার বিতরণ করেছে।
কোস্ট ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক এম রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, "এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের পুনর্বাসন করা। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর জন্য আমরা খাদ্য সহায়তা, বাড়ি মেরামতের জন্য নগদ অর্থ এবং দীর্ঘমেয়াদে 'কাজের বিনিময়ে টাকা' কর্মসূচি চালুর পরিকল্পনা করছি।"