চীনে শুল্কমুক্ত সুবিধা পেলেও রপ্তানি বৃদ্ধির আশা সামান্য
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীন বাংলাদেশের শতভাগ পণ্য রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিলেও তা নিয়ে তেমন উচ্ছাস নেই রপ্তানিকারক, নীতি নির্ধারক ও অর্থনীতিবিদদের মধ্যে। বাংলাদেশের রপ্তানি ঝুড়িতে তৈরি পোশাক ছাড়া কোনো পণ্য না থাকায় ডিসেম্বর থেকে চীনা বাজারে শতভাগ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়া গেলেও তাতে রপ্তানি বাড়ার সম্ভাবনা দেখছেন না তারা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০২২ সালে চীন যখন বাংলাদেশকে ৯৮ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়– তখন অ্যালকোহল, অস্ত্র, ভুট্টা ও নিউক্লিয়ার আইটেম ছাড়া বাংলাদেশের সকল পণ্য এর আওতাভুক্ত থাকে। বাংলাদেশ থেকে উল্লেখ করার মতো অ্যালকোহল, অস্ত্র, ভুট্টা ও নিউক্লিয়ার আইটেম রপ্তানি হয় না, তাই চীনে বাংলাদেশের পণ্যে শতভাগ শুল্কমুক্ত সুবিধা চালু হলেও, তাতে বাস্তবে বাংলাদেশের রপ্তানি সক্ষমতা বাড়বে না।
রপ্তানিকারক ও নীতি নির্ধারকরা বলছেন, চীনের বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানি বাড়ানোর কোনো সুযোগ বাংলাদেশের সামনে নেই। আবার চীন বিশ্ববাজার থেকে অন্য যেসব পণ্য আমদানি করে, বাংলাদেশের রপ্তানি ঝুড়িতে সে ধরনের কোনো পণ্যও নেই। ফলে শুল্কমুক্ত সুবিধা বাড়ালেও বাংলাদেশের শিল্পখাতে চীনা বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে না পারলে দেশটিতে রপ্তানি বাড়ানোর কোনো সুযোগ থাকছে না।
অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রে চীনে উৎপাদন ব্যয় এখনও বিশ্বে সর্বনিম্ন। ফলে চীনা উৎপাদকরা যে দামে পণ্য বিক্রি করে, বাংলাদেশ ওই খরচে পণ্য উৎপাদন করতে পারে না।
তারা বলছেন, চীন বিশ্ববাজার থেকে বছরে মাত্র ১০ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক আমদানি করে— যার বড় অংশই বিভিন্ন উন্নত দেশ থেকে উচ্চমূল্যে আমদানি করা হয়। এর বাইরে ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ায় গড়ে ওঠা চীনা ব্যবসায়ীদের কারখানা থেকে কিছু তৈরি পোশাক আমদানি করে থাকে দেশটি।
২০১৫ সাল থেকে বাংলাদেশের প্রায় ৩,০০০ পণ্য এশিয়া-প্যাসিফিক ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট এর আওতায় চীনে শুল্কমুক্ত সুবিধা পেতো। তখন শুল্কমুক্ত সুবিধা পেতে বাংলাদেশকে ৩৫ শতাংশ ভ্যালু অ্যাডিশন করতে হতো। ওই সুবিধা বাতিল করে ৪০ শতাংশ ভ্যালু অ্যাডিশনের শর্তে ২০২০ সালে বাংলাদেশকে প্রথম ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয় চীন; দুই বছর পর এটি বাড়িয়ে ৯৮ শতাংশ করা হয়। আগামী ডিসেম্বর থেকে বাংলাদেশসহ সকল এলডিসিকে ১০০ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে চীন।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলছে, চীনে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা বাড়লেও দেশটিতে বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়ার বদলে উল্টো কমছে। যদিও এই সময়ে কোভিড সংক্রমণ এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের সামগ্রিক রপ্তানির চিত্রে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশটিতে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৮৩১ মিলিয়ন ডলার; ২০২২-২৩ অর্থবছরে যা কমে ৬৭৭ মিলিয়ন ডলারে নেমেছে।
ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের তথ্য তুলে ধরে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর গত ডিসেম্বরে প্রকাশিত 'অ্যাক্সেসিং দ্য গ্রোয়িং ইমপোর্ট মার্কেট অফ চায়না স্ট্র্যাটেজিস টু রিয়ালাইজ পোটেনশিয়াল অপরচুনিটিস' শিরোনামে এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০২২ সালে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে হাওয়া বাণিজ্যের মোট পরিমাণ ছিল ২৯.১ বিলিয়ন ডলার– যেখানে বাংলাদেশ থেকে চীনে রপ্তানির অংশ ছিল ১.১৩ বিলিয়ন ডলার এবং চীন থেকে আমদানির পরিমাণ ছিল ২৮ বিলিয়ন ডলার।
শুল্কমুক্ত সুবিধা বাড়লেও চীনে রপ্তানি না বাড়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ এর সেক্রেটারি জেনারেল আল মামুন মৃধা টিবিএসকে বলেন, "চীন যেসব পণ্য আমদানি করে, সেগুলো রপ্তানি করার সক্ষমতা আমাদের নেই। শুধু তৈরি পোশাক নিয়ে চীনের বাজারে সুবিধা করতে পারবে না বাংলাদেশ।"
চীন বাংলাদেশের কাছে এক্সপোর্টেবল পণ্যের তালিকা চেয়েছিল। বাংলাদেশ আইসিটি, লেদার, সামুদ্রিক মাছ, চিংড়ি ও আম রপ্তানিতে আগ্রহের কথা জানিয়েছে। এখন পেয়ারা রপ্তানির বিষয়েও বাংলাদেশ আগ্রহ দেখাচ্ছে। চীন এসব পণ্য বাংলাদেশ থেকে আমদানি বাড়াতে আশ্বাস দিয়েছে।
আল মামুন মৃধা আরও জানান, বাংলাদেশ চীনকে প্রস্তাব দিয়েছে যে, চীন বিভিন্ন দেশ থেকে যেসব পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক জোনগুলোতে বিনিয়োগ করে, চীন সেসব পণ্য উৎপাদন করে চীনে রপ্তানি করতে পারে। বাংলাদেশ থেকে রপ্তানিতে যেহেতু শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়া যাবে, তাই চীনা কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে উৎপাদিত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে বড় ধরনের লাভবান হতে পারে।
আল মামুন মৃধা বলেন, "চীন তাদের বিভিন্নখাতের শিল্প কারখানা বিশ্বজুড়ে রি-অ্যালোকেট করছে। তার একটি অংশ বাংলাদেশে স্থানান্তর হলে বাংলাদেশ থেকে চীনে রপ্তানি বাড়বে। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে চীনে মাত্র ৯ দিনে সামুদ্রিক পথে পণ্য পরিবহন করা সম্ভব। তাই কম খরচে ও কম সময়ে চীনা আমদানিকারকরা বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি করতে পারবে।"
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন এর সাবেক সদস্য ড. মোস্তফা আবিদ টিবিএসকে বলেন, "আমাদের তৈরি পোশাক ছাড়া আর কোনো রপ্তানি পণ্য নেই। সে কারণে চীন সুবিধা দিলেও আমরা তা কোনো কাজে লাগাতে পারছি না। তাছাড়া, চীনের বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে শুল্কও কম, মাত্র ৬ শতাংশ। তাই শুল্কমুক্ত সুবিধা পেলেও চীনা আরএমজির তুলনায় বাংলাদেশের আরএমজি খুব বেশি প্রতিযোগিতা সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি।"
"বাংলাদেশ বহুবছর ধরে রপ্তানি ডাইভারসিফিকেশনের (বৈচিত্র্য) কথা বললেও সেজন্য কার্যকর কোনো পলিসি গ্রহণ করেনি সরকার। চীনারা পাটপণ্য খুব বেশি ব্যবহার করে না। তাই সেখানে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি বাড়ানোর সুযোগ কম। তবে লেদার রপ্তানির বড় সুযোগ রয়েছে। সে সুযোগ কীভাবে কাজে লাগানো যায়, তা নিয়ে সরকারি ও বেসরকারিভাবে পরিকল্পনা নিতে হবে," বলেন তিনি।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডাব্লিউটিও সেলের সাবেক মহাপরিচালক মো. হাফিজুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "চীনারা শুল্কমুক্ত সুবিধা দিলেও নানা ধরনের নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ার ও কঠোর রুলস অব অরিজিনের শর্ত আরোপ করায় বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি বাড়ছে না।"
চীনের রুলস অব অরিজিনের শর্ত হলো— দেশটিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পেতে হলে ন্যূনতম ৪০এস শতাংশ ভ্যালু অ্যাডিশন থাকতে। বাংলাদেশ নিটওয়্যার ছাড়া আর কোনো ধরনের পোশাক এই শর্ত পূরণ করতে পারে না। এছাড়া, নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ার হিসেবে চীন আমদানি পণ্যে বিভিন্ন রকমের টেস্টিং রিকোয়ারমেন্ট ইম্পোজ করে। এছাড়া, চীনা কাস্টমসে পণ্য অনেক দিন আটকে রাখা হয়। ফলে রপ্তানিকারকরা চীনে পণ্য রপ্তানিতে আগ্রহী হন না।
তবে বাংলাদেশ থেকে ইন্টারমিডিয়ারি পণ্য রপ্তানি বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন তিনি। এক সময় রহিম আফরোজ চীনে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ এলইডি ব্যাটারি রপ্তানি করতো। বর্তমানে কোম্পানিটি দুর্বল হয়ে পড়ায় রপ্তানির পরিমাণও কমছে। লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রনিক্স আইটেম, ফ্লোট গ্লাস রপ্তানি বাড়ানো যেতে পারে। চীনে গলদা চিংড়ির খুব একটা চাহিদা নেই। তবে বাংলাদেশ ভেন্নামি চিংড়ির চাষ শুরু করেছে– যা চীনে রপ্তানি হতে পারে। তবে এখানে মনে রাখা জরুরি, এখনও চীন বিশ্বে সবচেয়ে কম খরচে পণ্য উৎপাদন করে।
গবেষণা সংস্থা র্যাপিড এর চেয়ারম্যান প্রফেসর এম এ রাজ্জাক টিবিএসকে বলেন, "চীন বিশ্ববাজার থেকে বছরে মাত্র ১০ বিলিয়ন ডলারের আরএমজি আমদানি করে। এর মধ্যে বেশিরভাগই উচ্চমূল্যের পণ্য। এর বাইরে শুধু ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া থেকে কিছু আইটেম আমদানি করে, যেটা মূলত চাইনিজ কোম্পানিগুলোই রপ্তানি করে থাকে।"
"আলিবাবাডটকম ওয়েবসাইট যেসব পণ্য যে দামে বিক্রি করছে, বাংলাদেশ ওই সব পণ্য ওই দামে তৈরিই করতে পারে না। তাই চায়না মার্কেট ধরতে হলে চাইনিজ ইনভেস্টমেন্ট লাগবে। চীনা ইনভেস্টমেন্টে শুধু বড় বড় ব্রিজ, রাস্তা করলে হবে না," যোগ করেন তিনি।