হারুনসহ নির্বিচারে গুলি চালানোর ‘নির্দেশদাতা’ শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তারা কি দেশ ছেড়েছেন?
জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে নির্বিচারে গুলি চালানোর নির্দেশ দেয়া অন্তত এক ডজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার হদিস মিলছে না। এর মধ্যে জানা যাচ্ছে, তারা পুলিশ-প্রশাসনকে 'ম্যানেজ' করে দেশ ছেড়েছেন।
লালমনিরহাট সীমান্ত দিয়ে বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার দেশত্যাগের তথ্য মিলেছে একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে। এর মধ্যে আছেন অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার প্রলয় কুমার জোয়ার্রদার ও পুলিশের বিশেষ শাখার সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলামসহ আরো অন্তত চারজন।
এরই মধ্যে একটি বেসরকারি টেলিভিশনে দেয়া ফোন ইন্টারভিউতে মনিরুল ইসলাম বলেছিলেন, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তিনি আইজিপির সাথে হেলিকপ্টারে করে সেনানিবাসে আশ্রয় নেন। এরপর পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে সেখান থেকে বেরিয়ে এক আত্মীয়ের বাসায় উঠেন।
তবে পুলিশ সূত্র বলছে, আত্মীয়ের বাসায় উঠলেও দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতির মধ্য সুযোগ বুঝে দেশ ছাড়েন তিনি। এতে তাকে সহযোগিতা করেন পুলিশের বর্তমান ও সাবেক কিছু কর্মকর্তা।
তবে এসব সংবাদ সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে জানতে পারেনি টিবিএস।
তবে যার দেশত্যাগ সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে জানা গেছে, তেমন একটি ঘটনা হচ্ছে ট্যুরিস্ট পুলিশের সাবেক প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক রেজাউল আলমের। গত ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে রাত সাড়ে ১০টার দিকে মালয়েশিয়াগামী এমএইচ-ওয়ান-জিরো-থ্রি ফ্লাইটে সিডনির উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন তিনি। তিনি ৫ আগস্টের পর হওয়া একটি হত্যা মামলায় অভিযুক্ত। ৪ আগস্ট রাজধানীর পল্টনে হোটেল লিভিংয়ের সামনে হামলা-হত্যার ঘটনায় এ মামলা করা হয়। সেই মামলার ৩৭ নম্বরে আসামি সাবেক ট্যুরিস্ট পুলিশ প্রধান রেজাউল আলম।
এছাড়া, ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানও এর মধ্যে দেশের পূর্বাঞ্চলের একটি সীমান্ত দিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। কেন্দ্রীয় যুবলীগের একজন নেতা তাকে ভারতের একটি হোটেলে দেখেছেন বলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন। তবে রেজাউলের পালিয়ে যাওয়ার দুদিন পর চেষ্টা করেও দেশে ছাড়তে পারেননি ডিএমপির আরেক সাবেক কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক—এমনটাও জানা গেছে।
এছাড়া আগস্টের মাঝামাঝিতে দেশের পূর্বাঞ্চলের আরেকটি জেলার সীমান্ত দিয়ে দেশ ছাড়েন ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান।
সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে দেশ ছাড়েন ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ও সাবেক ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ ও বিপ্লব কুমার সরকার। জানা গেছে, তারা ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন।
কাজে যোগ দেননি ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার মেহেদী হাসান ও লিটন কুমার দাস। তাদের অবস্থান সর্ম্পকে কোনো সূত্র নির্ভরযোগ্য খবর জানাতে পারেনি।
পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা এখনো কর্মস্থলে অনুপস্থিত রয়েছেন। পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, এমন সদস্যের সংখ্যা ১৮৭ জন। অনুপস্থিত কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন অতিরিক্ত ডিআইজি ও ডিআইজি পদমর্যাদার কয়েকজন কর্মকর্তা, যারা দেশত্যাগ করেছেন বলে শোনা যাচ্ছে।
গুরুতর অভিযোগ থাকা এমন কর্মকর্তাদের দেশ ছেড়ে যাওয়ার ঘটনার সমালোচনা করে অপরাধ বিশ্লেষকেরা বলছেন, পুলিশের বিশেষ শাখাসহ (এসবি) গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অপেশাদার আচরণের কারণে তারা দেশ ছাড়তে পেরেছেন।
পুলিশ সদর দপ্তরের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের এআইজি ইনামুল হক সাগর বলেন, 'যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তাদের অবস্থান জানতে আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি। এবং যে ১৮৭ জন পুলিশ সদস্য বিভিন্ন কারণে এখনও অনুপস্থিত— তাদের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়ে গেছে।'
পুলিশ সদর দফতর সূত্রে আরো জানা গেছে, কোন পুলিশ কর্মকর্তা টানা চল্লিশ কর্মদিবস কাজে যোগ না দিলে – তাদের নিখোঁজ ধরে নিয়ে সাধারণ ডায়েরি দায়ের করে – তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নাজমুস সাকিব বলেন, 'যখন বিএনপি ক্ষমতায় ছিল তখন বেশকিছু পুলিশ কর্মকর্তাদের নাম মানুষের মুখে মুখে ছিল। যেমন কোহিনুর মিয়ার নাম আমরা শুনেছিলাম। আওয়ামী লীগ আমলেও এমনটা হয়েছে। এবারের বাস্তবতায় যদি আমরা দেখি, এবার সাধারণ জনগণের মূল লক্ষ্য ছিল পুলিশ।'
পুলিশের অভিযুক্ত এসব কর্মকর্তা জানেন গোয়েন্দাদের কাজের ধরন। সে কারণেই তাদের নজরদারিতে আনা বা শনাক্তে বেগ পেতে হচ্ছে বলেও জানান বিশ্লেষকেরা।
পুলিশের সাবেক-বর্তমান অন্তত ২৬ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারের অনুমতি নিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। তাদের মধ্যে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) থেকে শুরু করে পরিদর্শক পদের কর্মকর্তারা রয়েছেন। তাদের বেশির ভাগই ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রভাবশালী কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্র বলেছে, পুলিশ সদর দপ্তরের কনফিডেনশিয়াল শাখা থেকে সাবেক-বর্তমান এই ২৬ জনকে গ্রেপ্তারের জন্য মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের পুলিশ শাখা-১ থেকে তিন ধাপে অনুমতি নেওয়া হয়েছে। অনুমতি চেয়ে করা আবেদনে গ্রেপ্তারের কারণও ব্যাখ্যা করা হয়।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পুলিশের সাবেক-বর্তমান এই ২৬ কর্মকর্তার বিরুদ্ধেই হত্যার অভিযোগে মামলা হয়েছে। সূত্রগুলো জানায়, তারা ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচার গুলি চালিয়েছেন অথবা তার নির্দেশ দেওয়ার জন্য অভিযুক্ত। তাদের মধ্যে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনসহ সাতজন ইতিমধ্যে গ্রেপ্তারও হয়েছেন। বাকি কর্মকর্তারা আত্মগোপনে রয়েছেন। কেউ কেউ বিদেশে চলে গেছেন বলেও শোনা যাচ্ছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, 'বিভিন্ন মামলায় আসামি হিসেবে নাম থাকা বিগত সময়ের প্রতাপশালী পুলিশ কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তারের সিদ্ধান্ত রয়েছে। খুঁজে না পাওয়ায় অনেককে গ্রেপ্তার করা যাচ্ছে না।'
গ্রেপ্তারের অনুমতির তালিকায় নাম থাকা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, গ্রেপ্তার এড়াতে তিনি আত্মগোপনে আছেন। তার দাবি, 'কিসের ভিত্তিতে আমাকে গ্রেপ্তারের অনুমতি নেওয়া হয়েছে, তা বুঝতে পারছি না। বড় ঘটনার সময় কোনো একটি এলাকায় কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দায়িত্বে থাকেন, সেখানে সব দায় শুধু একজনের ওপর চাপানো ঠিক নয়।'
এই ২৬ জন ছাড়াও বিগত সময়ে প্রভাবশালী এবং অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা আরও কর্মকর্তার নাম তালিকায় রয়েছে। তাদেরও গ্রেপ্তারের জন্য ধাপে ধাপে অনুমতি নেওয়া হবে। কাউকে কাউকে আগে আটক করে পরে গ্রেপ্তারের অনুমতি নেওয়া হচ্ছে বলে পুলিশ সদরের সূত্র জানিয়েছে।
যোগাযোগ করা হলে, পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি-অপারেশনস) মো. রেজাউল করিম বলেন, 'ফৌজদারি মামলায় এজাহারভুক্ত আসামি পুলিশ সদস্যদের কয়েকজনকে গ্রেপ্তারের অনুমতি রয়েছে। যাদের পাওয়া যাচ্ছে, তাঁদের হেফাজতে নেওয়া হচ্ছে।'
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলি করে হত্যার অভিযোগে সারা দেশে এ পর্যন্ত পুলিশের সাবেক তিন আইজিসহ ১৮৪ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ডিএমপির ৯৯ জন।
হত্যা মামলায় পুলিশ কর্মকর্তাদের আসামি করা ও গ্রেপ্তারের বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, 'আইন সবার জন্য সমান। আইন অনুযায়ী, খুনসহ যেকোনো ধরনের ফৌজদারি অপরাধের সঙ্গে যদি কারো সংশ্লিষ্টতা থাকে, সে ক্ষেত্রে তারা আসামি হতেই পারেন।'
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের বিভিন্ন থানায় হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ এবং অস্ত্র-গুলি লুট করা হয়। এসব ঘটনায় নিহত হন পুলিশের ৪৬ সদস্য।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেওয়ার সময় কর্মবিরতিতে ছিল পুলিশ। পরে পুলিশের শীর্ষ পদসহ বিভিন্ন পদে রদবদল, বদলি করা হয়। বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয় বিভিন্ন পর্যায়ের ২৩ কর্মকর্তাকে। পুলিশের অনেক কর্মকর্তা এখনো কর্মস্থলে ফেরেননি। কেউ কেউ কর্মস্থলে যোগ দিয়েই ছুটিতে চলে গেছেন। ফলে পুলিশ বাহিনী এখনো পুরো সক্রিয় হয়ে ওঠেনি।