পাচারকৃত অর্থ ফেরাতে দুদকের তৎপরতা কতটুকু সফল হবে?
বিগত সময়ে দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে জোর তৎপরতা চালাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত তিন সপ্তাহের ব্যবধানে অন্তত চারটি বিদেশি সংস্থার সঙ্গে বৈঠকে এ বিষয়ে সহায়তা চেয়েছেন দুদক কর্মকর্তারা। এছাড়া, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছে আইনি সহায়তা চেয়ে ৭১টি মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) পাঠানো হয়েছে।
২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর অর্থ ছাড়া পাচার হওয়া আর কোনো অর্থ দেশে ফেরত আনতে পারেনি সংস্থাটি।
জানা যায়, গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগ সরকারের ৮৬ মন্ত্রী-এমপিসহ শতাধিক প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। এরমধ্যে বেশিরভাগের বিরুদ্ধেই দুদকের গোয়েন্দা ইউনিটের অনুসন্ধানে অর্থ পাচারের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন-ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনার দেড় দশকের শাসনামালে দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে অন্তত ১৪ হাজার ৯২০ কোটি বা ১৪৯ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী, বাংলাদেশি মুদ্রায় পাচারকৃত এই অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় অন্তত ১৭ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা।
বিপুল পরিমাণ এই অর্থ ফেরত আনতে এরইমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই), ইউনাইটেড নেশনস অফিস ফর ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইম (ইউএনওডিসি) এবং বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আলোচনা করেছে দুদক।
সর্বশেষ মঙ্গলবার (১ অক্টোবর) ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকে দুদকের পক্ষ থেকে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এসব সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকেও সর্বোচ্চ সহায়তার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশকে।
দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন এ বিষয়ে বলেন, "ইউরোপীয় ইউনিয়নের চার সদস্যের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আলাপে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে তাদের সহযোগিতা চেয়েছি। দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্ত কাজে যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, সে বিষয়টি আমরা ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দলের সামনে উপস্থাপন করেছি।"
"বৈঠকে আমরা তাদের যেসব দেশে অর্থ পাচার হয়েছে, সেসব দেশের নাম উল্লেখ করেছি। তারাও আমাদের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন," বলেন তিনি।
দুই দশকে সাফল্য মাত্র একটি
পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনতে অন্যতম ভূমিকা রাখতে পারে দুদক। তবে ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও দুই দশকে সংস্থাটির সফলতা মাত্র একটি।
২০১২ ও ২০১৩ সালে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার প্রয়াত পুত্র আরাফাত রহমান কোকোর পাচার করা ২১ কোটি ৫৫ হাজার টাকা তিন দফায় সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফেরত আনে দুদক। যদিও এজন্য লবিস্ট নিয়োগ করতে হয়েছিল।
পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব ছিল বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
দুদকের সাবেক মহাপরিচালক মইদুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনতে কিছু জটিলতা রয়েছে, তবে অসম্ভব নয়। এরমধ্যে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব।"
তিনি বলেন, "দুদক আদালতের অনুমতি নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) পাঠায়। এরপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে যোগাযোগ করা হয়। সমস্য হলো, এ তৎপরতাটুকুও দেখা যায় না।"
"এরপর যে দেশে টাকা পাচার হয়েছে, সে দেশের পররাষ্ট্রনীতি বা তাদের সাথে সম্পর্কও এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। সবচেয়ে বড় বিষয়, সরকারের সদিচ্ছা থাকতে হবে টাকা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে। সদিচ্ছার অভাবেই মূলত কোকো ছাড়া আর কারও অর্থ ফেরত আনা সম্ভব হয়নি," যোগ করেন তিনি।
তবে দুদককে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সাথে যোগাযোগের পাশাপাশি মৌলিক কাজগুলোতে গুরুত্ব দিতে হবে জানিয়ে মইদুল ইসলাম আরও বলেন, "আগে আদালতের অনুমতি, এমএলএআর এবং সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে যোগাযোগ করতে হবে। এখানে আরও জোর তৎপরতা চালানো প্রয়োজন।"
পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে ৭১টি এমএলএআর
দুদক সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারসহ আইনগত সহায়তা চেয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ পর্যন্ত মোট ৭১টি মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) পাঠিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
এর মধ্যে ২৭টির জবাব পাওয়া গেছে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সিঙ্গাপুর, আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায়।
দুদকের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন বলেন, "অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না। ৭১টি এমএলএআরের মধ্যে জবার এসেছে মাত্র ২৭টির। এ কারণে আমরা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সাথে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে সহযোগিতা চেয়েছি। তারাও আমাদের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে।"